ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

নরেন্দ্র প্রভৃতিকে স্ত্রীলোক লইয়া সাধন নিষেধ বামাচার নিন্দা

পূর্বকথা – তীর্থদর্শন; কাশীতে ভৈরবী চক্র – ঠাকুরের সন্তানভাব

ঘরে ছোট তক্তপোষটিতে ঠাকুর বসিয়াছেন। নরেন্দ্র, ভবনাথ, বাবুরাম, মাস্টার মেঝেতে বসিয়া আছেন। ঘোষপাড়া ও পঞ্চনামী এই সব মতের কথা নরেন্দ্র তুলিলেন। ঠাকুর তাহাদের বর্ণনা করিয়া নিন্দা করিতেছেন। বলিতেছেন, “ঠিক ঠিক সাধন করিতে পারে না, ধর্মের নাম করিয়া ইন্দ্রিয় চরিতার্থ করে।

(নরেন্দ্রের প্রতি) – “তোর আর এ-সব শুনে কাজ নাই।

“ভৈরব, ভৈরবী, এদেরও ওইরকম। কাশীতে যখন আমি গেলুম, তখন একদিন ভৈরবীচক্রে আমায় নিয়ে গেল। একজন করে ভৈরব, একজন করে ভৈরবী। আমায় কারণ পান করতে বললে। আমি বললাম, মা, আমি কারণ ছুঁতে পারি না। তখন তারা খেতে লাগল। আমি মনে করলাম, এইবার বুঝি জপ-ধ্যান করবে। তা নয়, নৃত্য করতে আরম্ভ করলে! আমার ভয় হতে লাগল, পাছে গঙ্গায় পড়ে যায়। চক্রটি গঙ্গার ধারে হয়েছিল।

স্বামী-স্ত্রী যদি ভৈরব-ভৈরবী হয়, তবে তাদের বড় মান।

(নরেন্দ্রাদি ভক্তের প্রতি) – “কি জান? আমার ভাব মাতৃভাব, সন্তানভাব। মাতৃভাব অতি শুদ্ধভাব, এতে কোন বিপদ নাই। ভগ্নীভাব, এও মন্দ নয়। স্ত্রীভাব – বীরভাব বড় কঠিন। তারকের বাপ ওইভাবে সাধন করত। বড় কঠিন। ঠিক ভাব রাখা যায় না।

নানা পথ ঈশ্বরের কাছে পৌঁছিবার। মত পথ। যেমন কালীঘরে যেতে নানা পথ দিয়ে যাওয়া যায়। তবে কোনও পথ শুদ্ধ, কোনও পথ নোংরা, শুদ্ধ পথ দিয়ে যাওয়াই ভাল।

অনেক মত – অনেক পথ – দেখলাম। এ-সব আর ভাল লাগে না। পরস্পর সব বিবাদ করে। এখানে আর কেউ নাই; তোমরা আপনার লোক, তোমাদের বলছি, শেষ এই বুঝেছি, তিনি পূর্ণ আমি তাঁর অংশ; তিনি প্রভু ‘আমি’ তাঁর দাস; আবার এক-একবার ভাবি, তিনিই আমি আমিই তিনি!”

ভক্তেরা নিস্তব্ধ হইয়া এই কথাগুলি শুনিতেছেন।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও মানুষের উপর ভালবাসা – Love of Mankind

ভবনাথ (বিনীতভাবে) – লোকের সঙ্গে মনান্তর থাকলে, মন কেমন করে। তাহলে সকলকে তো ভালবাসতে পারলুম না।

শ্রীরামকৃষ্ণ – প্রথমে একবার কথাবার্তা কইতে – তাদের সঙ্গে ভাব করতে – চেষ্টা করবে। চেষ্টা করেও যদি না হয়, তারপর আর ও-সব ভাববে না। তাঁর শরণাগত হও – তাঁর চিন্তা কর – তাঁকে ছেড়ে অন্য লোকের জন্য মন খারাপ করবার দরকার নাই।

ভবনাথ – ক্রাইস্ট, চৈতন্য, এঁরা সব বলে গেছেন যে, সকলকে ভালবাসবে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – ভাল তো বাসবে, সর্বভূতে ঈশ্বর আছেন বলে। কিন্তু যেখানে দুষ্টলোক, সেখানে দূর থেকে প্রণাম করবে। কি, চৈতন্যদেব? তিনিও “বিজাতিয় লোক দেখে প্রভু করেন ভাব সংবরণ।” শ্রীবাসের বাড়িতে তাঁর শাশুরীকে চুল ধরে বার করা হয়েছিল।

ভবনাথ – সে অন্য লোক বার করেছিল।

শ্রীরামকৃষ্ণ – তাঁর সম্মতি না থা কলে পারে?

“কি করা যায়? ধদি অন্যের মন পাওয়া না গেল। তো রাতদিন কি ওই ভাবতে হবে? যে মন তাঁকে দেব, সে মন এদিক-ওদিক বাজে খরচ করব? আমি বলি, মা, আমি নরেন্দ্র, ভবনাথ, রাখাল কিছুই চাই না, কেবল তোমায় চাই! মানুষ নিয়ে কি করব?

“ঘরে আসবেন চণ্ডী, শুনব কত চণ্ডী,
কত আসবেন দণ্ডী যোগী জটাধারী!

“তাঁকে পেলে সবাইকে পাব। টাকা মাটি, মাটিই টাকা – সোনা মাটি, মাটিই সোনা – এই বলে ত্যাগ কল্লুম; গঙ্গার জলে ফেলে দিলুম। তখন ভয় হল যে, মা লক্ষ্মী যদি রাগ করেন। লক্ষ্মীর ঐশ্বর্য অবজ্ঞা কল্লুম। যদি খ্যাঁট বন্ধ করেন। তখন বললুম, মা তোমায় চাই, আর কিছু চাই না; তাঁকে পেলে তবে সব পাব।”

ভবনাথ (হাসিতে হাসিতে) – এ পাটোয়ারী!

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – হাঁ ওইটুকু পাটোয়ারী!

“ঠাকুর সাক্ষাৎকার হয়ে একজনকে বললেন, তোমার তপস্যা দেখে বড় প্রসন্ন হয়েছি। এখন একটি বর নাও। সাধক বললেন ঠাকুর যদি বর দেবেন তো এই বর দিন, যেন সোনার থালে নাতির সঙ্গে বসে খাই। এক বরেতে অনেকগুলি হল। ঐশ্বর্য হল, ছেলে হল, নাতি হল!” (সকলের হাস্য)

-১৮৮৪, ২৯শে সেপ্টেম্বর-

…………………
রামকৃষ্ণ কথামৃত : ঊনত্রিংশ অধ্যায় : চতুর্থ পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!