শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রের বাগানে মহোৎসব
আজ ঠাকুর সুরেন্দ্রের বাগানে আসিয়াছেন। রবিবার (২রা আষাঢ়), জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণা ষষ্ঠী তিথি, ১৫ই জুন, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ। ঠাকুর সকাল নয়টা হইতে ভক্তসঙ্গে আনন্দ করিতেছেন।
সুরেন্দ্রের বাগান কলিকাতার নিকটস্থ কাঁকুড়গাছি নামক পল্লীর অন্তর্গত। নিকটেই রামের বাগান – যে বাগানে ঠাকুর প্রায় ছয় মাস পূর্বে শুভাগমন করিয়াছিলেন। আজ সুরেন্দ্রের বাগানে মহোৎসব।
সকাল হইতেই সংকীর্তন আরম্ভ হইয়াছে। কীর্তনিয়াগণ মাথুর গাহিতেছে। গোপীদের প্রেম, শ্রীকৃষ্ণ বিরহে শ্রীমতীর শোচনীয় অবস্থা – সমস্ত বর্ণিত হইতেছিল। ঠাকুর মুহুর্মুহু ভাবাবিষ্ট হইতেছেন। ভক্তগণ উদ্যানগৃহমধ্যে চতুর্দিকে কাতার দিয়া দাঁড়াইয়া আছেন।
উদ্যানগৃহমধ্যে প্রধান প্রকোষ্ঠে সংকীর্তন হইতেছে। ঘরের মেঝেতে সাদা চাদর পাতা ও মাঝে মাঝে তাকিয়া রহিয়াছে। এই প্রকোষ্ঠের পূর্বে ও পশ্চিমে একটি করিয়া কামরা এবং উত্তরে ও দক্ষিণে বারান্দা আছে। উদ্যান গৃহের সম্মুখে অর্থাৎ দক্ষিণদিকে একটি বাঁধাঘাটবিশিষ্ট সুন্দর পুষ্করিণী। গৃহ ও পুষ্করিণী ঘাটের মধ্যবর্তী পূর্ব-পশ্চিমে উদ্যান পথ। পথের দুই ধারে পুষ্পবৃক্ষ ও ক্রোটনাদি গাছ।
উদ্যানগৃহের পূর্বধার হইতে উত্তরে ফটক পর্যন্ত আর-একটি রাস্তা গিয়াছে। লাল সুরকির রাস্তা। তাহারও দুই পার্শ্বে নানাবিধ পুষ্পবৃক্ষ ও ক্রোটনাদি গাছ। ফটকের নিকট ও রাস্তার ধারে আর-একটি বাঁধাঘাট পুষ্করিণী। পল্লীবাসী সাধারণ লোকে এখানে স্নানাদি করে এবং পানীয় জল লয়; উদ্যান গৃহের পশ্চিম ধারেও উদ্যান পথ, সেই পথের দক্ষিণ-পশ্চিমে রন্ধনশালা। আজ এখানে খুব ধুমধাম, ঠাকুর ও ভক্তদের সেবা হইবে। সুরেশ ও রাম সর্বদা তত্ত্বাবধান করিতেছেন।
উদ্যানগৃহের বারান্দাতেও ভক্তদের সমাবেশ হইয়াছে। কেহ কেহ একাকী বা বন্ধুসঙ্গে প্রথমোক্ত পুষ্করিণীর ধারে বেড়াইতেছেন। কেহ কেহ বাঁধাঘাটে মাঝে মাঝে আসিয়া বিশ্রাম করিতেছেন।
সংকীর্তন চলিতেছে। সংকীর্তন গৃহমধ্যে ভক্তের জনতা হইয়াছে। ভবনাথ, নিরঞ্জন, রাখাল, সুরেন্দ্র, রাম, মাস্টার, মহিমাচরণ ও মণি মল্লিক ইত্যাদি অনেকেই উপস্থিত। অনেকগুলি ব্রাহ্মভক্তও উপস্থিত।
মাথুর গান হইতেছে। কীর্তনিয়া প্রথমে গৌরচন্দ্রিকা গাহিতেছেন। গৌরাঙ্গ সন্ন্যাস করিয়াছেন – কৃষ্ণপ্রেমে পাগল হইয়াছেন। তাঁর অদর্শনে নবদ্বীপের ভক্তেরা কাতর হইয়া কাঁদিতেছেন। তাই কীর্তনিয়া গাহিতেছেন – গৌর একবার চল নদীয়ায়।
তৎপরে শ্রীমতীর বিরহ অবস্থা বর্ণনা করিয়া আবার গাহিতেছেন।
ঠাকুর ভাবাবিষ্ট। হঠাৎ দণ্ডায়মান হইয়া অতি করুণ স্বরে আখর দিতেছেন – “সখি! হয় প্রাণবল্লভকে আমার কাছে নিয়ে আয়, নয় আমাকে সেখানে রেখে আয়।” ঠাকুরের শ্রীরাধার ভাব হইয়াছে। কথাগুলি বলিতে বলিতেই নির্বাক্ হইলেন; দেহ স্পন্দহীন, অর্ধনিমীলিতনেত্র। সম্পূর্ণ বাহ্যশূন্য; ঠাকুর সমাধিস্থ হইয়াছেন!
অনেক্ষণ পরে প্রকৃতিস্থ হইলেন। আবার সেই করুণ স্বর। বলিতেছেন, “সখি! তাঁর কাছে লয়ে গিয়ে তুই আমাকে কিনে নে। আমি তোদের দাসী হব! তুই তো কৃষ্ণপ্রেম শিখায়েছিলি! প্রাণবল্লভ!”
কীর্তনিয়াদিগের গান চলিতে লাগিল। শ্রীমতী বলিতেছেন, “সখি! যমুনার জল আনতে আমি যাব না। কদম্বতলে প্রিয় সখাকে দেখেছিলাম, সেখানে গেলেই আমি বিহ্বল হই!”
ঠাকুর আবার ভাবাবিষ্ট হইতেছেন। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া কাতর হইয়া বলিতেছেন, ‘আহা’ ‘আহা’!
কীর্তন চলিতেছে – শ্রীমতির উক্তি –
গান – শীতল তছু অঙ্গ হেরি সঙ্গসুখ লালসে (হে)।
মাঝে মাঝে আখর দিতেছেন (না হয় তোদের হবে, আমায় একবার দেখা গো)। (ভূষণের ভূষণ গেছে আর ভূষণে কাজ নাই)। (আমার সুদিন গিয়ে দুর্দিন হয়েছে) (দুর্দশার দিন কি দেরি হয় না)।
ঠাকুর আখর দিতেছেন – (সে কাল কি আজও হয় নাই)।
কীর্তনিয়া আখর দিতেছেন – (এতকাল গেল, সে কাল কি আজও হয় নাই)।
গান – মরিব মরিব সখি, নিশ্চয় মরিব,
(আমার) কানু হেন গুণনিধি কারে দিয়ে যাব।
না পোড়াইও রাধা অঙ্গ, না ভাসাইও জলে,
(দেখো যেন অঙ্গ পোড়াইও না গো)
(কৃষ্ণ বিলাসের অঙ্গ ভাসাইও না গো)
(কৃষ্ণ বিলাসের অঙ্গ জলে না ডারবি, অনলে না দিবি)
মরিলে তুলিয়ে রেখ তমালের ডালে।
(বেঁধে তমালে রাখবি) (তাতে পরশ হবে)
(কালোতে পরশ হবে) (কৃষ্ণ কালো তমাল কালো)
(কালো বড় ভালবাসি) (শিশুকাল হ’তে)
(আমার কানু অনুগত তনু)
(দেখ যেন কানু ছাড়া করো না গো)।
শ্রীমতীর দশম দশা – মূর্ছিতা হইয়া পড়িয়াছেন।
গান – ধনি ভেল মূরছিত, হরল গেয়ান, (নাম করিতে করিতে) (হাট কি ভাঙলি রাই) তখনই তো প্রাণসখি মুদলি নয়ান। (ধনি কেন এমন হল) (এই যে কথা কইতেছিল) কেহ কেহ চন্দন দেয় ধনির অঙ্গে; কেহ কেহ রোউত বিষাদতরঙ্গে। (সাধের প্রাণ যাবে বলে) কেহ কেহ জল ঢালি দেয় রাইয়ের বদনে (যদি বাঁচে) (যে কৃষ্ণ অনুরাগে মরে, সে কি জলে বাঁচে)।
মূর্ছিতা দেখিয়া সখীরা কৃষ্ণনাম করিতেছেন। শ্যামনামে তাঁহার সংজ্ঞা হইল। তমাল দেখে ভাবছেন বুঝি সম্মুখে কৃষ্ণ এসেছেন।
গান – শ্যামনামে প্রাণ পেয়ে, ধনি ইতি উতি চায়, না দেখি সে চাঁদমুখ কাঁদে উভরায়। (বলে, কইরে শ্রীদাম) (তোরা যার নাম শুনাইলি কই) (একবার এনে দেখা গো) সম্মুখে তমাল তরু দেখিবারে পায়। (তখন) সেই তমালতরু করি নিরীক্ষণ (বলে ওই যে চূড়া) (আমার কৃষ্ণের ওই যে চূড়া দেখা যায়)।
সখীরা যুক্তি করিয়া মথুরায় দূতী পাঠাইয়াছেন। তিনি একজন মথুরাবাসিনীর সহিত পরিচয় করিলেন –
গান – এক রমণী সমবয়সিনী, নিজ পরিচয় পুছে।
শ্রীমতীর সখী দূতী বলছেন – আমায় ডাকতে হবে না, সে আপনি আসবে। দূতী মথুরাবাসিনীর সঙ্গে যেখানে আছেন সেইখানে যাইতেছেন। তৎপরে ব্যাকুল হয় কেঁদে কেঁদে ডাকছেন –
“কোথায় হরি হে, গোপীজনজীবন! প্রাণপল্লভ! রাধাবল্লভ! লজ্জানিবারণ হরি! একবার দেখা দাও। আমি অনেক গরব করে এদের বলেছি, তুমি আপনি দেখা দিবে।”
গান –
মধুপুর নাগরী, হাঁসী কহত ফিরি, গোকুলে গোপ কোঁয়ারি (হায় গো)
(কেমন করে বা যাবি গো) (এমন কানঙালিনী বেশ)।
সপ্তম দ্বার পারে রাজা বৈঠত, তাঁহা কাঁহা যাওবি নারি।
(কেমন করে বা যাবি) (তোর সাহস দেখে লাজে মরি বল কেমন যাবি)।
হা হা নাগর গোপীজনজীবন (কাঁহা নাগর দেখা দিয়ে দাসীর প্রাণ রাখ!)
(কোথায় গোপীজনজীবন প্রাণবল্লভ!)
(হে মথুরনাথ, দেখা দিয়ে দাসীর মন প্রাণ রাখ হরি, হা হা রাধাবল্লভ!)
(কোথায় আছ হে, হৃদয়নাথ হৃদয়বল্লভ লজ্জানিবারণ হরি)
(দেখা দিয়ে দাসীর মান রাখ হরি)।
হা হা নাগর গোপীজনজীবনধন, দূতী ডাকত উভরায়।
কোথায় গোপীজনজীবন প্রাণবল্লভ! এই কথা শুনিয়া ঠাকুর সমাধিস্থ হইলেন। কীর্তনান্তে কীর্তনিয়ারা উচ্চ সংকীর্তন করিতেছেন। প্রভু আবার দণ্ডায়মান! সমাধিস্থ! কতক সংজ্ঞা লাভ করিয়া অস্ফুট স্বরে বলিতেছেন, “কিট্ন কিট্ন” (কৃষ্ণ কৃষ্ণ)। ভাবে নিমগ্ন। নাম সম্পূর্ণ উচ্চারণ হইতেছে না।
রাধাকৃষ্ণের মিলন হইল। কীর্তনিয়ারা ওই ভাবের গান গাহিতেছেন।
ঠাকুর আখর দিতেছেন –
“ধনি দাঁড়ালো রে
অঙ্গ হেলাইয়ে ধনি দাঁড়ালো রে।
শ্যামের বামে ধনি দাঁড়ালো রে।
তমাল বেড়ি বেড়ি ধনি দাঁড়ালো রে।”
এইবার নামসংকীর্তন। তাহারা খোল-করতাল সঙ্গে গাহিতে লাগিল “রাধে গোবিন্দ জয়!” ভক্তেরা সকলেই উন্মত্ত!
ঠাকুর নৃত্য করিতেছেন। ভক্তেরাও তাঁহাকে বেড়িয়া আনন্দে নাচিতেছেন। মুখে “রাধে গোবিন্দ জয়, রাধে গোবিন্দ জয়।”
-১৮৮৪, ১৫ই জুন-
…………………..
রামকৃষ্ণ কথামৃত : ঊনবিংশ অধ্যায় : প্রথম পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….