ব্রাহ্মভক্তসঙ্গে
এইবার পাতা হইতেছে। দক্ষিণের বারান্দায়। ঠাকুর মহিমাচরণকে বলিতেছেন, আপনি একবার যাও, দেখো ওরা সব কি করছে। আর আপনাকে আমি বলতে পারি না, না হয় একটু পরিবেশন করলে? মহিমাচরণ বলিতেছেন, “নিয়ে আসুক না তারপর দেখা যাবে,” এই বলিয়া ‘হুঁ হুঁ করিয়া একটু দালানের দিকে গেলেন, কিন্তু কিয়ৎক্ষণ পরে ফিরিয়া আসিলেন।
ঠাকুর ভক্তসঙ্গে পরমানন্দে আহার করিতে বসিলেন। আহারান্তে ঘরে আসিয়া বিশ্রাম করিতেছেন। ভক্তেরাও দক্ষিণের পুষ্করিণীর বাঁধা ঘাটে আচমন করিয়া পান খাইতে খাইতে আবার ঠাকুরের কাছে আসিয়া জুটিলেন। সকলেই আসন গ্রহণ করিলেন। বেলা দুইটার পর প্রতাপ আসিয়া উপস্থিত। তিনি একজন ব্রাহ্মভক্ত। আসিয়া ঠাকুরকে অভিবাদন করিলেন। ঠাকুরও মস্তক অবনত করিয়া নমস্কার করিলেন। প্রতাপের সহিত অনেক কথাবার্তা হইতেছে।
প্রতাপ – মহাশয়! আমি পাহাড়ে গিয়েছিলাম। (দার্জিলিং-এ)
শ্রীরামকৃষ্ণ – কিন্তু তোমার শরীর তো তত ভাল হয় নাই। তোমার কি অসুখ হয়েছে?
প্রতাপ – আজ্ঞা, তাঁর যে অসুখ ছিল, আমারও সেই অসুখ হয়েছে।
কেশবের ওই অসুখ ছিল। কেশবের অন্যান্য কথা হইতে লাগিল। প্রতাপ বলিতে লাগিলেন, কেশবের বৈরাগ্য বাল্যকাল থেকেই দেখা গিয়েছিল। তাঁকে আহ্লাদ আমোদ করতে প্রায় দেখা যেত না। হিন্দু কলেজে পড়তেন, সেই সময় সত্যেন্দ্রের সঙ্গে তাঁর খুব বন্ধুত্ব হয়। আর ওই সূত্রে শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আলাপ হয়। কেশবের দুই-ই ছিল। যোগও ছিল, ভক্তিও ছিল। সময়ে সময়ে তাঁর ভক্তির এত উচ্ছ্বাস হত যে মাঝে মাঝে মূর্ছা হত। গৃহস্থদের ভিতর ধর্ম আনা তাঁর জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল।
লোকমান্য ও অহংকার – “আমি কর্তা” “আমি গুরু” – দর্শনের লক্ষণ
একটি মহারাষ্ট্রদেশীয় স্ত্রীলোক সম্বন্ধে কথা হইতেছে।
প্রতাপ – এ-দেশের মেয়েরাও কেউ কেউ বিলেতে গেছে। একটি মহারাষ্ট্র দেশের মেয়ে, খুব পণ্ডিত, বিলেতে গিছিল। তিনি কিন্তু খ্রীষ্টান হয়েছেন। মহাশয় কি তাঁর নাম শুনেছেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ – না; তবে তোমার মুখে যা শুনলুম তাতে বোধ হচ্ছে যে, তার লোকমান্য হবার ইচ্ছা। এরূপ অহংকার ভাল নয়। ‘আমি করছি’, এটি অজ্ঞান থেকে হয়; হে ঈশ্বর, তুমি করছ – এইটি জ্ঞান। ঈশ্বরই কর্তা আর সব অকর্তা।
“ ‘আমি’ ‘আমি’ করলে কত যে দুর্গতি হয় বাছুরের অবস্থা ভাবলে বুঝতে পারবে। বাছুর ‘হাম্ মা’ ‘হাম্ মা’ (আমি আমি) করে। তার দুর্গতি দেখ। হয়তো সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লাঙ্গল টানতে হচ্ছে; রোদ নাই, বৃষ্টি নাই। হয়তো কসাই কেটে ফেললে। মাংসগুলো লোকে খাবে। ছালটা চামড়া হবে। সেই চামড়ায় জুতো এই সব তৈয়ার হবে। লোক তার উপর পা দিয়ে চলে যাবে। তাতেও দুর্গতির শেষ হয় না।
চামড়ায় ঢাক তৈয়ার হয়। আর ঢাকের কাঠি দিয়ে অনবরত চামড়ার উপর আঘাত করে। অবশেষে কিনা নাড়ীভুঁড়িগুলো নিয়ে তাঁত তৈয়ার করে; যখন ধুনুরীর তাঁত তৈয়ার হয় তখন ধোনবার সময় ‘তুঁহু তুঁহু’ বলে। আর ‘হাম্ মা, হাম্ মা’ বলে না। তুঁহু তুঁহু বলে, তবেই নিস্তার, তবেই তার মুক্তি। কর্মক্ষেত্রে আর আসতে হয় না।
“জীবও যখন বলে, ‘হে ঈশ্বর, আমি কর্তা নই, তুমিই কর্তা – আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী’, তখনই জীবের সংসার-যন্ত্রণা শেষ হয়। তখনই জীবের মুক্তি হয়, আর এ কর্মক্ষেত্রে আসতে হয় না।”
একজন ভক্ত – জীবের অহংকার কেমন করে যায়?
শ্রীরামকৃষ্ণ – ঈশ্বরকে দর্শন না করলে অহংকার যায় না। যদি কারু অহংকার গিয়ে থাকে, তার অবশ্য ঈশ্বরদর্শন হয়েছে।
একজন ভক্ত – মহাশয়! কেমন করে জানা যায় যে, ঈশ্বরদর্শন হয়েছে?
শ্রীরামকৃষ্ণ – ঈশ্বরদর্শনের লক্ষণ আছে। শ্রীমদ্ভাগবতে আছে, যে ব্যক্তি ঈশ্বরদর্শন করেছে, তার চারিটি লক্ষণ হয়, (১) বালকবৎ, (২) পিশাচবৎ, (৩) জড়বৎ, (৪) উন্মাদবৎ।
“যার ঈশ্বরদর্শন হয়েছে, তার বালকের স্বভাব হয়। সে ত্রিগুণাতীত – কোন গুণের আঁট নাই। আবার শুচি অশুচি তার কাছে দুই সমান – তাই পিশাচবৎ। আবার পাগলের মতো ‘কভু হাসে, কভু কাঁদে’; এই বাবুর মতো সাজে-গোজে, আবার খানিক পরে ন্যাংটা; বগলের নিচে কাপড় রেখে বেড়াচ্ছে – তাই উন্মাদবৎ। আবার কখনও বা জড়ের ন্যায় চুপ করে বসে আছে – জড়বৎ।”
একজন ভক্ত – ঈশ্বরদর্শনের পর কি অহংকার একেবারে যায়?
শ্রীরামকৃষ্ণ – কখন কখন তিনি অহংকার একেবারে পুঁছে ফেলেন – যেমন সমাধি অবস্থায়। আবার প্রায় অহংকার একটু রেখে দেন। কিন্তু সে অহংকারে দোষ নাই। যেমন বালকের অহংকার। পাঁচ বছরের বালক ‘আমি’ ‘আমি’ করে কিন্তু কারু অনিষ্ট করতে জানে না।
“পরশমণি ছুঁলে লোহা সোনা হয়ে যায়। লোহার তরোয়াল সোনার তরোয়াল হয়ে যায়। তরোয়ালের আকার থাকে, কারু অনিষ্ট করে না। সোনার তরোয়ালে মারা কাটা চলে না।”
-১৮৮৪, ১৫ই জুন-
…………………..
রামকৃষ্ণ কথামৃত : ঊনবিংশ অধ্যায় : পঞ্চম পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….