প্রতাপকে শিক্ষা – ব্রাহ্মসমাজ ও কামিনী-কাঞ্চন
প্রতাপ – যারা মহাশয়ের কাছে আসেন, তাঁদের ক্রমে ক্রমে উন্নতি হচ্ছে তো?
শ্রীরামকৃষ্ণ – আমি বলি যে, সংসার করতে দোষ কি? তবে সংসারে দাসীর মতো থাক।
গৃহস্থের সাধন
“দাসী মনিবের বাড়ির কথায় বলে, ‘আমাদের বাড়ি’। কিন্তু তার নিজের বাড়ি হয়তো কোন পাড়াগাঁয়ে। মনিবের বাড়িকে দেখিয়ে মুখে বলে, ‘আমাদের বাড়ি’। মনে জানে যে ও-বাড়ি আমাদের নয়, আমাদের বাড়ি সেই পাড়াগাঁয়ে। আবার মনিবের ছেলেকে মানুষ করে, আর বলে, ‘হরি আমার বড় দুষ্টু হয়েছে’; ‘আমার হরি মিষ্টি খেতে ভালবাসে না।’ ‘আমার হরি’ মুখে বলে বটে, কিন্তু জানে যে, হরি আমার নয়, মনিবের ছেলে।
“তাই যারা আসে, তাদের আমি বলি, সংসার কর না কেন, তাতে দোষ নাই। তবে ঈশ্বরেতে মন রেখে কর, জেনো যে বাড়িঘর পরিবার আমার নয়; এ-সব ঈশ্বরের। আমার ঘর ঈশ্বরের কাছে। আর বলি যে, তাঁর পাদপদ্মে ভক্তির জন্য ব্যাকুল হয়ে সর্বদা প্রার্থনা করবে।”
বিলাতের কথা আবার পড়িল। একজন ভক্ত বলিলেন, আজকাল বিলাতের পণ্ডিতেরা নাকি ঈশ্বর আছেন এ-কথা মানেন না।
প্রতাপ – মুখে যে যা বলুন, আন্তরিক তাঁরা যে কেউ নাস্তিক তা আমার বোধ হয় না। এই জগতের ব্যাপারের পেছনে যে একটা মহাশক্তি আছে, এ-কথা অনেককেই মানতে হয়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ – তাহলেই হল; শক্তি তো মানছে? নাস্তিক কেন হবে?
প্রতাপ – তা ছাড়া ইওরোপের পণ্ডিতেরা moral government (সৎকার্যের পুরস্কার আর পাপের শাস্তি এই জগতে হয়) এ-কথাও মানেন।
অনেক কথাবার্তার পর প্রতাপ বিদায় লইতে গাত্রোত্থান করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (প্রতাপের প্রতি) – আর কি বলব তোমায়? তবে এই বলা যে, আর ঝগড়া-বিবাদের ভিতর থেকো না।
“আর-এককথা – কামিনী-কাঞ্চনই ঈশ্বর থেকে মানুষকে বিমুখ করে। সেদিকে যেতে দেয় না। এই দেখ না, সকলেই নিজের পরিবারকে সুখ্যাত করে। (সকলের হাস্য) তা ভালই হোক আর মন্দই হোক, – যদি জিজ্ঞাসা কর, তোমার পরিবারটি কেমন গা, অমনি বলে, ‘আজ্ঞে খুব ভাল’ – ”
প্রতাপ – তবে আমি আসি।
প্রতাপ চলিয়া গেলেন। ঠাকুরের অমৃতময়ী কথা, কামিনী-কাঞ্চনত্যাগের কথা সমাপ্ত হইল না। সুরেন্দ্রের বাগানের বৃক্ষস্থিত পত্রগুলি দক্ষিণাবায়ু সংঘাতে দুলিতেছিল ও মর্মর শব্দ করিতেছিল। কথাগুলি সেই শব্দের সঙ্গে মিশাইয়া গেল। একবার মাত্র ভক্তদের হৃদয়ে আঘাত করিয়া অবশেষে অনন্ত আকাশে লয়প্রাপ্ত হইল।
কিন্তু প্রতাপের হৃদয়ে কি এ-কথা প্রতিধ্বনিত হয় নাই?
কিয়ৎক্ষণ পরে শ্রীযুক্ত মণিলাল মল্লিক ঠাকুরকে বলিতেছেন –
মহাশয়, এই বেলা দক্ষিণেশ্বরে যাত্রা করুন। আজ সেখানে কেশব সেনের মা ও বাড়ির মেয়েরা আপনাকে দর্শন করতে যাবেন। তাঁরা আপনাকে না দেখতে পেলে হয়তো দুঃখিত হয়ে ফিরে আসবেন।
কয় মাস হইল কেশব স্বর্গারোহন করিয়াছেন। তাই তাঁহার বৃদ্ধা মাতাঠাকুরানী, পরিবার ও বাড়ির অন্যান্য মেয়েরা ঠাকুরকে দর্শন করিতে যাইবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণি মল্লিকের প্রতি) – রোসো বাপু, একে আমার ঘুম-টুম হয় নাই; – তাড়াতাড়ি করতে পারি না। তারা গেছে তা আর কি করব। আর সেখানে তারা বাগানে বেড়াবে, চ্যাড়াবে – বেশ আনন্দ হবে।
কিয়ৎক্ষণ বিশ্রাম করিয়া ঠাকুর যাত্রা করিতেছেন – দক্ষিণেশ্বরে যাইবেন। খাইবার সময় সুরেন্দ্রের কল্যাণ চিন্তা করিতেছেন। সব ঘরে এক-একবার যাইতেছেন আর মৃদু মৃদু নামোচ্চারণ করিতেছেন। কিছু অসম্পূর্ণ রাখিবেন না, তাই দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়াই বলিতেছেন, “আমি তখন নুচি খাই নাই, একটু নুচি এনে দাও।” কণিকামাত্র লইয়া খাইতেছেন আর বলিতেছেন, “এর অনেক মানে আছে। নুচি খাই নাই মনে হলে আবার আসবার ইচ্ছা হবে।” (সকলের হাস্য)
মণি মল্লিক (সহাস্যে) – বেশ তো আমরাও আসতাম।
ভক্তেরা সকলে হাসিতেছেন।
-১৮৮৪, ১৫ই জুন-
…………………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : ঊনবিংশ অধ্যায় : অষ্টম পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….