আচার্যের কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ
আচার্যের কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ, তবে লোকশিক্ষার অধিকার – সন্ন্যাসীর কঠিন নিয়ম – ব্রাহ্ম মণিলালকে শিক্ষা
শ্রীরামকৃষ্ণ – যাদের দ্বারা তিনি লোকশিক্ষা দেবেন, তাদের সংসারত্যাগ দরকার। তা না হলে উপদেশ গ্রাহ্য হয় না। শুধু ভিতরে ত্যাগ হলে হবে না। বাহিরে ত্যাগও চাই, তবে লোকশিক্ষা হয়। তা না হলে লোকে মনে করে, ইনি যদিও কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করতে বলছেন, ইনি নিজে ভিতরে ভিতরে ওই সব ভোগ করেন।
“একজন কবিরাজ ঔষধ দিয়ে রোগীকে বললে, তুমি আর-একদিন এসো, খাওয়া-দাওয়ার কথা বলে দিব। সেদিন তাঁর ঘরে অনেকগুলি গুড়ের নাগরি ছিল। রোগীর বাড়ি অনেক দূরে। সে আর-একদিন এসে দেখা করলে। কবিরাজ বললে ‘খাওয়া দাওয়া সাবধানে করবি, গুড় খাওয়া ভাল নয়।’ রোগী চলে গেলে একজন বৈদ্যকে বললে, ‘ওকে অত কষ্ট দিয়ে আনা কেন?
সেই দিন বললেই তো হত!’ বৈদ্য হেসে বললে, ‘ওর মানে আছে। সেদিন ঘরে অনেকগুলি গুড়ের নাগরি ছিল। সেদিন যদি বলি, রোগীর বিশ্বাস হত না। সে মনে করত ওঁর ঘরে যেকালে এত গুড়ের নাগরি, উনি নিশ্চয় কিছু খান। তাহলে গুড় জিনিসটা এত খারাপ নয়।’ আজ আমি গুড়ের নাগরি লুকিয়ে ফেলেছি, এখন বিশ্বাস হবে।
“আদি সমাজের আচার্যকে দেখলাম। শুনলাম নাকি দ্বিতীয় না তৃতীয় পক্ষের বিয়ে করেছে! – বড় বড় ছেলে!
“এই সব আচার্য! এরা যদি বলে ‘ঈশ্বর সত্য, আর সব মিথ্যা’ কে বিশ্বাস করবে! – এদের শিষ্য যা হবে, বুঝতেই পারছ।
“হেগো গুরু তার পেদো শিষ্য! সন্ন্যাসীও যদি মনে তাগ করে, বাহিরে কামিনী-কাঞ্চন লয়ে থাকে – তার দ্বারা লোকশিক্ষা হয় না। লোকে বলবে লুকিয়ে গুড় খায়।”
শ্রীরামকৃষ্ণের কাঞ্চনত্যাগ – কবিরাজের পাঁচটাকা প্রত্যর্পণ
“সিঁথির মহেন্দ্র (কবিরাজ) রামলালের কাছে পাঁচটা টাকা দিয়ে গিছল – আমি জানতে পারি নাই।
“রামলাল বললে পর, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কাকে দিয়েছে? সে বললে, এখানকার জন্য। আমি প্রথমটা ভাবলুম, দুধের দেনা আছে না হয় সেইটে শোধ দেওয়া যাবে। ও মা! খানিক রাত্রে ধড়মড় করে উঠে পড়েছি। বুকে যেন বিল্লি আঁচড়াচ্ছে! রামলালকে তখন গিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলুম, – ‘তোর খুড়ীকে কি দিয়েছে?’ সে বললে, ‘না’। তখন তাকে বললাম, ‘তুই এক্ষণই ফিরিয়ে দিয়ে আয়!’ রামলাল তার পরদিন টাকা ফিরিয়ে দিলে।
“সন্ন্যাসীর পক্ষে টাকা লওয়া বা লোভে আসক্ত হওয়া কিরূপ জানো? যেমন ব্রাহ্মণের বিধবা অনেক কাল হবিষ্য খেয়ে, ব্রহ্মচর্য করে, বাগ্ দী উপপতি করেছিল! (সকলে স্তম্ভিত)
“ও-দেশে ভগী তেলীর অনেক শিষ্য সামন্ত হল। শূদ্রকে সব্বাই প্রণাম করে দেখে, জমিদার একটা দুষ্ট লোক লাগিয়ে দিলে। সে তার ধর্ম নষ্ট করে দিলে – সাধন-ভজন সব মাটি হয়ে গেল। পতিত সন্ন্যাসী সেইরূপ।”
সাধুসঙ্গের পর শ্রদ্ধা – কেশব সেন ও বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী
“তোমারা সংসারে আছ, তোমাদের সৎসঙ্গ (সাধুসঙ্গ) দরকার।
“আগে সাধুসঙ্গ, তারপর শ্রদ্ধা। সাধুরা যদি তাঁর নামগুণানুকীর্তন না করে, তাহলে কেমন করে লোকের ঈশ্বরে শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, ভক্তি হবে? তিন পুরুষে আমির জানলে তবে তো লোকে মানবে?
(মাস্টারের প্রতি) – “জ্ঞান হলেও সর্বদা অনুশীলন চাই। ন্যাংটা বলত, ঘটি একদিন মাজলে কি হবে – ফেলে রাখলে আবার কলঙ্ক পড়বে!
“তোমার বাড়িটায় একবার যেতে হবে। তোমার আড্ডাটা জানা থাকলে, সেখানে আরও ভক্তদের সঙ্গে দেখা হবে। ঈশানের কাছে একবার যাবে।
(মণিলালের প্রতি) – “কেশব সেনের মা এসেছিল। তাদের বাড়ির ছোকরারা হরিনাম করলে। সে তাদের প্রদক্ষিণ করে হাততালি দিতে লাগল। দেখলাম শোকে কাতর হয় নাই। এখানে এসে একাদশী করলে, মালাটি লয়ে জপ করে! বেশ ভক্তি দেখলাম।”
মণিলাল – কেশববাবুর পিতামহ রামকমল সেন ভক্ত ছিলেন। তুলসীকাননের মধ্যে বসে নাম করতেন। কেশবের বাপ প্যারীমোহনও ভক্ত বৈষ্ণব ছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – বাপ ওরূপ না হলে ছেলে অমন ভক্ত হয় না। দেখো না, বিজয়ের অবস্থা।
“বিজয়ের বাপ ভাগবত পড়তে পড়তে ভাবে অজ্ঞান হয়ে যেত। বিজয় মাঝে মাঝে ‘হরি! হরি!’ বলে উঠে পড়ে।
“আজকাল বিজয় যা সব (ঈশ্বরীয় রূপ) দর্শন করছে, সব ঠিক ঠিক!
“সাকার-নিরাকারের কথা বিজয় বললে – যেমন বহুরূপীর রঙ – লাল, নীল, সবুজও হচ্ছে – আবার কোনও রঙই নাই । কখন সগুণ কখন নির্গুণ।”
বিজয় সরল – “সরল হলে ঈশ্বরলাভ হয়”
“বিজয় বেশ সরল – খুব উদার সরল না হলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না।
“বিজয় কাল অধর সেনের বাড়িতে গিছল। তা যেন আপনার বাড়ি – সবাই যেন আপনার।
“বিষয়বুদ্ধি না গেলে উদার সরল হয় না।
এই বলিয়া ঠাকুর গান গাহিতেছেন –
“অমূল্যধন পাবি রে মন হলে খাঁটি!
“মাটি পাট করা না হলে হাঁড়ি তৈয়ার হয় না। ভিতরে বালিঢিল থাকলে হাঁড়ি ফেটে যায়। তাই কুমোর আগে মাটি পাট করে।
“আরশিতে ময়লা পড়ে থাকলে মুখ দেখা যায় না। চিত্তশুদ্ধি না হলে স্ব-স্বরূপদর্শন হয় না।
“দেখো না, যেখানে অবতার, সেখানেই সরল। নন্দঘোষ, দশরথ, বসুদেব – এঁরা সব সরল।
“বেদান্তে বলে শুদ্ধবুদ্ধি না হলে ঈশ্বরকে জানতে ইচ্ছা হয় না। শেষ জন্ম বা অনেক তপস্যা না থাকলে উদার সরল হয় না।”
-১৮৮৪, ২রা অক্টোবর-
………………..
রামকৃষ্ণ কথামৃত : একত্রিংশ অধ্যায় : দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….