জ্ঞান ও বিজ্ঞান – ঠাকুর ও বেদোক্ত ঋষিগণ
পণ্ডিত ফিরিয়া আসিয়া আবার ভক্তদের সঙ্গে মেঝেতে বসিলেন। ঠাকুর ছোট খাটটিতে বসিয়া আবার কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (পণ্ডিতের প্রতি) – তোমাকে এইটে বলি। আনন্দ তিন প্রকার – বিষয়ানন্দ, ভজনানন্দ ও ব্রহ্মানন্দ। যা সর্বদাই নিয়ে আছে – কামিনী-কাঞ্চনের আনন্দ – তার নাম বিষয়ানন্দ। ঈশ্বরের নামগুণগান করে যে আনন্দ তার নাম ভজনান্দ। আর ভগবান দর্শনের যে আনন্দ তার নাম ব্রহ্মানন্দ। ব্রহ্মানন্দলাভের পর ঋষিদের স্বেচ্ছাচার হয়ে যেত।
“চৈতন্যদেবের তিনরকম অবস্থা হত – অন্তর্দশা, অর্ধবাহ্যদশা ও বাহ্যদশা। অন্তর্দশায় ভগবানদর্শন করে সমাধিস্থ হতেন, – জড়সমাধির অবস্থা হত। অর্ধবাহ্যে একটু বাহিরের হুঁশ থাকত। বাহ্যদশায় নামগুণকীর্তন করতে পারতেন।”
হাজরা (পণ্ডিতের প্রতি) – এইতো সব সন্দেহ ঘুচান হল।
শ্রীরামকৃষ্ণ (পণ্ডিতের প্রতি) – সমাধি কাকে বলে? – যেখানে মনের লয় হয়। জ্ঞানীর জড়সমাধি হয়, – ‘আমি’ থাকে না। ভক্তিযোগের সমাধিকে চেতনসমাধি বলে। এতে সেব্য-সেবকের ‘আমি’ থাকে – রস-রসিকের ‘আমি’ – আস্বাদ্য-আস্বাদকের ‘আমি’। ঈশ্বর সেব্য – ভক্ত সেবক; ঈশ্বর রসস্বরূপ – ভক্ত রসিক; ঈশ্বর আস্বাদ্য – ভক্ত আস্বাদক। চিনি হব না, চিনি খেতে ভালবাসি।
পণ্ডিত – তিনি যদি সব ‘আমি’ লয় করেন তাহলে কি হবে? চিনি যদি করে লন?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – তোমার মনের কথা খুলে বল। “মা কৌশল্যা, একবার প্রকাশ করে বল!” (সকলের হাস্য) তবে কি নারদ, সনক, সনাতন, সনন্দ, সনৎকুমার শাস্ত্রে নাই?
পণ্ডিত – আজ্ঞা হাঁ, শাস্ত্রে আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ – প্রার্থনা কর। তিনি দয়াময়। তিনি কি ভক্তের কথা শুনেন না? তিনি কল্পতরু। তাঁর কাছে গিয়ে যে যা চাইবে তাই পাবে।
পণ্ডিত – আমি তত এ-সব চিন্তা করি নাই। এযন সব বুঝছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ – ব্রহ্মজ্ঞানের পরও ঈশ্বর একটু ‘আমি’ রেখে দেন। সেই ‘আমি’ – “ভক্তের আমি” “বিদ্যার আমি।” তা হতে এ অনন্ত লীলা আস্বাদন হয়। মুষল সব ঘষে একটু তাতেই আবার উলুবনে পড়ে কুলনাশন – যদুবংশ ধ্বংস হল। বিজ্ঞানী তাই এই “ভক্তের আমি” “বিদ্যার আমি” রাখে আস্বাদনের জন্য, লোকশিক্ষার জন্য।
ঋষিরা ভয়তরাসে – A new light on the Vedanta
“ঋষিরা ভয়তরাসে। তাদের ভাব কি জান? আমি জো-সো করে যাচ্ছি আবার কে আসে? যদি কাঠ আপনি জো-সো করে ভেসে যায় – কিন্তু তার উপর একটি পাখি বসলে ডুবে যায়। নারদাদি বাহাদুরী কাঠ, আপনিও ভেসে যায়, আবার অনেক জীবজন্তুকেও নিয়ে যেতে পারে। স্টীমবোট (কলের জাহাজ) – আপনিও পার হয়ে যায় এবং অপরকে পার করে নিয়ে যায়।
“নারদাদি আচার্য বিজ্ঞানী, – অন্য ঋষিদের চেয়ে সাহসী। যেমন পাকা খেলোয়াড় ছকবাঁধা খেলা খেলতে পারে। কি চাও, ছয় না পাঁচ? ফি বারেই ঠিক পড়ছে! – এমনি খেলোয়াড়! – সে আবার মাঝে মাঝে গোঁপে তা দেয়।
“শুধু জ্ঞানী যারা, তারা ভয়তরাসে। যেমন সতরঞ্চ খেলায় কাঁচা লোকেরা ভাবে, জো-সো করে একবার ঘুঁটি উঠলে হয়। বিজ্ঞানীর কিছুতেই ভয় নাই। সে সাকার-নিরাকার সাক্ষাৎকার করেছে! – ঈশ্বরের আনন্দ সম্ভোগ করেছে!
“তাঁকে চিন্তা করে, অখণ্ডে মন লয়ে হলেও আনন্দ, – আবার মন লয় না হলেও লীলাতে মন রেখেও আনন্দ।
“শুধু জ্ঞানী একঘেয়ে, – কেবল বিচার কচ্চে ‘এ নয় এ নয়, – এ-সব স্বপ্নবৎ।’ আমি দুহাত ছেড়ে দিয়েছি, তাই সব লই।
“একজন ব্যানের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। ব্যান তখন সুতা কাটছিল, নানারকমের রেশমের সুতা। ‘ব্যান’ তার ব্যানকে দেখে খুব আনন্দ করতে লাগল; – আর বললে – ‘ব্যান, তুমি এসেছ বলে আমার যে কি আনন্দ হয়েছে, তা বলতে পারি না, – যাই তোমার জন্য কিছু জলখাবার আনিগে।’ ব্যান জলখাবার আনতে গেছে, – এদিকে নানা রঙের রেশমের সুতা দেখে এ-ব্যানের লোভ হয়েছে।
সে একতাড়া সুতা বগলে করে লুকিয়ে ফেললে। ব্যান জলখাবার নিয়ে এল; – আর অতি উৎসাহের সহিত – জল খাওয়াতে লাগল। কিন্তু সুতার দিকে দৃষ্টিপাত করে বুঝতে পারলে যে, একতাড়া সুতো ব্যান সরিয়েছেন। তখন সে সুতোটা আদায় করবার একটা ফন্দি ঠাওরালে।
“সে বলছে, ‘ব্যান, অনেকদিনের পর তোমার সহিত সাক্ষাৎ হল। আজ ভারী আনন্দের দিন। আমার ভারী ইচ্ছা কচ্ছে যে দুজনে নৃত্য করি।’ সে বললে – ‘ভাই, আমারও ভারী আনন্দ হয়েছে।’ তখন দুই ব্যানে নৃত্য করতে লাগল। ব্যান দেখলে যে, ইনি বাহু না তুলে নৃত্য করছেন। তখন তিনি বললেন, ‘এস ব্যান দুহাত তুলে আমরা নাচি, – আজ ভারী আনন্দের দিন।’ কিন্তু তিনি একহাতে বগল টিপে আর-একটি হাত তুলে নাচতে লাগলেন! তখন ব্যান বললেন, ‘ব্যান ওকি! একহাত তুলে নাচা কি, এস দুহাত তুলে নাচি। এই দেখ, আমি দুহাত তুলে নাচছি।’ কিন্তু তিনি বগল টিপে হেসে হেসে একহাত তুলেই নাচতে লাগলেন আর বললেন, ‘যে যেমন জানে ব্যান!’
“আমি বগলে হাত দিয়ে টিপি না, – আমি দুহাত ছেড়ে দিয়েছি – আমার ভয় নাই। তাই আমি নিত্য-লীলা দুই লই।”
ঠাকুর কি বলিতেছেন যে জ্ঞানীর লোকমান্য হবার কামনা জ্ঞানীর মুক্তি কামনা – এই সব থাকে বলে দুহাত তুলে নাচতে পারে না? নিত্য-লীলা দুই নিতে পারে না? আর জ্ঞানীর ভয় আছে, বদ্ধ হই, – বিজ্ঞানীর ভয় নাই?
শ্রীরামকৃষ্ণ – কেশব সেনকে বললা যে, ‘আমি’ ত্যাগ না করলে হবে না। সে বললে, তাহলে মহাশয় দলটল থাকে না। তখন আমি বললাম, “কাঁচা আমি,” “বজ্জাত আমি” – ত্যাগ করতে বলছি, কিন্তু “পাকা আমি” – “বালকের আমি”, “ঈশ্বরের দাস আমি”, “বিদ্যার আমি” – এতে দোষ নাই। “সংসারীর আমি” – “অবিদ্যার আমি” – “কাঁচা আমি” – একটা মোটা লাঠির ন্যায়।
সচ্চিদানন্দসাগরের জল ওই লাঠি যেন দুই ভাগ করেছে। কিন্তু “ঈশ্বরের দাস আমি,” “বালকের আমি,” “বিদ্যার আমি” জলের উপর রেখার ন্যায়। জল এক, বেশ দেখা যাচ্ছে – শুধু মাঝখানে একটি রেখা, যেন দুভাগ জল। বস্তুতঃ একজল, – দেখা যাচ্ছে।
“শঙ্করাচার্য ‘বিদ্যার আমি’ রেখেছিলেন – লোকশিক্ষার জন্য।”
ব্রহ্মজ্ঞানলাভের পর “ভক্তের আমি” – গোপীভাব
“ব্রহ্মজ্ঞানলাভের পরেও অনেকের ভিতর তিনি ‘বিদ্যার আমি’ – ‘ভক্তের আমি’ রেখে দেন। হনুমান সাকার-নিরাকার সাক্ষাৎকার করবার পর সেব্য-সেবকের ভাবে, ভক্তের ভাবে থাকতেন। রামচন্দ্রকে বলেছিলেন, ‘রাম, কখন ভাবি তুমি পূর্ণ, আমি অংশ; কখন ভাবি তুমি সেব্য, আমি সেবক; আর রাম, যখন তত্ত্বজ্ঞান হয় তখন দেখি তুমিই আমি, আমিই তুমি!’
“যশোদা কৃষ্ণ বিরহে কাতর হয়ে শ্রীমতীর কাছে গেলেন। তাঁর কষ্ট দেখে শ্রীমতী তাঁকে স্বরূপে দেখা দিলেন – আর বললেন, ‘কৃষ্ণ চিদাত্মা আমি চিচ্ছক্তি। মা তুমি আমার কাছে বর লও।’ যশোদা বললেন, মা আমার ব্রহ্মজ্ঞান চাই না – কেবল এই বর দাও যেন ধ্যানে গোপালের রূপ সর্বদা দর্শন হয়, আর কৃষ্ণভক্তসঙ্গ যেন সর্বদা হয়, আর ভক্তদের যেন আমি সেবা করতে পারি, – আর তাঁর নামগুনকীর্তন যেন আমি সর্বদা করতে পারি।
“গোপীদের ইছা হয়েছিল, ভগবানের ঈশ্বরীয় রূপদর্শন করে। কৃষ্ণ তাদের যমুনায় ডুব দিতে বললেন। ডুব দেওয়ায় যা অমনি বৈকুণ্ঠে সব্বাই উপস্থিত; – ভগবানের সেই ষড়ৈশ্বর্যপূর্ণ রূপ দর্শন হল; – কিন্তু ভাল লাগল না। তখন কৃষ্ণকে তারা বললে, আমাদের গোপালকে দর্শন, গোপালের সেবা এই যেন থাকে আর আমারা কিছুই চাই না।
“মথুরা যাবার আগে কৃষ্ণ ব্রহ্মজ্ঞান দিবার উদ্যোগ করেছিলেন। বলেছিলেন, আমি সর্বভূতের অন্তরে বাহিরে আছি। তোমরা কি একটি রূপ কেবল দেখছ? গোপীরা বলে উঠল, ‘কৃষ্ণ, তবে কি আমাদের ত্যাগ করে যাবে তাই ব্রহ্মজ্ঞানের উপদেশ দিচ্ছ?’
“গোপীদের ভাব কি জান? আমরা রাইয়ের, রাই আমাদের।”
একজন ভক্ত – এই “ভক্তের আমি” কি একেবারে যায় না?
Sri Ramakrishna and the Vedanta
শ্রীরামকৃষ্ণ – ও ‘আমি’ এক-একবার যায়। তখন ব্রহ্মজ্ঞান হয়ে সমাধিস্থ হয়। আমারও যায়। কিন্তু বরাবর নয়। সা রে গা মা পা ধা নি, – কিন্তু ‘নি’তে অনেকক্ষণ থাকা যায় না, – আবার নিচের গ্রামে নামতে হয়। আমি বলি “মা আমায় ব্রহ্মজ্ঞান দিও না।” আগে সাকারবাদীরা খুব আসত। তারপর ইদানীং ব্রহ্মজ্ঞানীরা আসতে আরম্ভ করলে। তখন প্রায় ওইরূপ বেহুঁশ হয়ে সমাধিস্থ হতাম – আর হুঁশ হলেই বলতাম, মা আমায় ব্রহ্মজ্ঞান দিও না।
পণ্ডিত – আমরা বললে তিনি শুনবেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ – ঈশ্বর কল্পতরু। যে যা চাইবে, তাই পাবে। কিন্তু কল্পতরুর কাছে থেকে চাইতে হয়, তবে কথা থাকে।
“তবে একটি কথা আছে – তিনি ভাবগ্রাহী। যে যা মনে করে সাধনা করে তার সেরূপই হয়। যেমন ভাব তেমনি লাভ। একজন বাজিকর খেলা দেখাচ্ছে রাজার সামনে। আর মাঝে মাঝে বলছে রাজা টাকা দেও, কাপড়া দেও। এমন সময়ে তার জিব তালুর মূলের কাছে উলটে গেল। অমনি কুম্ভক হয়ে গেল। আর কথা নাই, শব্দ নাই, স্পন্দন নাই। তখন সকলে তাকে ইটের কবর তৈয়ার করে সেই ভাবেই পুঁতে রাখলে।
হাজার বৎসর পরে সেই কবর কে খুঁড়েছিল। তখন লোকে দেখে যে একজন সমাধিস্থ হয়ে বসে আছে! তারা তাকে সাধু মনে করে পূজা করতে লাগল। এমন সময় নাড়াচাড়া দিতে দিতে তার জিব তালু থেকে সরে এল। তখন তার চৈতন্য হল, আর সে চিৎকার করে বলতে লাগল, লাগ ভেলকি লাগ! রাজা টাকা দেও, কাপড়া দেও!
“আমি কাঁদতাম আর বলতাম, মা বিচারবুদ্ধিতে বজ্রাঘাত হোক!”
পণ্ডিত – তবে আপনারও (বিচারবুদ্ধি) ছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ, একবার ছিল।
পণ্ডিত – তবে বলে দিন, তাহলে আমাদেরও যাবে। আপনার কেমন করে গেল?
শ্রীরামকৃষ্ণ – অমনি একরকম করে গেল।
-১৮৮৪, ৩০শে জুন-
…………………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : একবিংশ অধ্যায় : তৃতীয় পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….