শ্রীরামকৃষ্ণ ও আচার্য শ্রীবেচারাম – বেদান্ত ও ব্রহ্মতত্ত্ব প্রসঙ্গে
সন্ধ্যার পর আদিসমাজের আচার্য শ্রীযুক্ত বেচারাম বেদীতে বসিয়া উপাসনা করিলেন। মাঝেমাঝে ব্রহ্মসঙ্গীত ও উপনিষদ্ হইতে পাঠ হইতে লাগিল। উপাসনান্তে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে বসিয়া আচার্য অনেক আলাপ করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – আচ্ছা, নিরাকারও সত্য আর সাকারও সত্য; আপনি কি বল?
[সাকার-নিরাকার চিন্ময়রূপ ও ভক্ত ]
আচার্য – আজ্ঞা, নিরাকার যেমন Electric Current (তড়িৎ-প্রবাহ) চক্ষে দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ, দুই সত্য। শুধু নিরাকার বলা কিরূপ জানো? যেমন রোশনচৌকির একজন পোঁ ধরে থাকে – তার বাঁশির সাত ফোকর সত্ত্বেও। কিন্তু আর-একজন দেখ কত রাগ-রাগিণী বাজায়! সেরূপ সাকারবাদীরা দেখ ঈশ্বরকে কতভাবে সম্ভোগ করে! শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য, মধুর – নানাভাবে।
“কি জানো, অমৃতকুণ্ডে কোনও রকমে পড়া। তা স্তব করেই হোক অথবা কেউ ধাক্কা মেরেছে আর তুমি কুণ্ডে পড়ে গেছ, একই ফল। দুই জনেই অমর হবে!১
“ব্রাহ্মদের পক্ষে জল বরফ উপমা ঠিক। সচ্চিদানন্দ যেন অনন্ত জলরাশি। মহাসাগরের জল, ঠান্ডা দেশে স্থানে স্থানে যেমন বরফের আকার ধারণ করে, সেইরূপ ভক্তি হিমে সেই সচ্চিদানন্দ (সগুণ ব্রহ্ম) ভক্তের জন্য সাকার রূপ ধারণ করেন। ঋষিরা সেই অতীন্দ্রিয় চিন্ময় রূপ দর্শন করেছিলেন, আবার তাঁর সঙ্গে কথা কয়েছিলেন। ভক্তের প্রেমের শরীর,২ ‘ভাগবতীতনু’ দ্বারা সেই চিন্ময় রূপ দর্শন হয়।
“আবার আছে, ব্রহ্ম অবাঙ্মনসোগোচর। জ্ঞানসূর্যের তাপে সাকার বরফ গলে যায়। ব্রহ্মজ্ঞানের পর, নির্বিকল্পসমাধির পর, আবার সেই অনন্ত, বাক্যমনের অতীত, অরূপ নিরাকার ব্রহ্ম!
“ব্রহ্মের স্বরূপ মুখে বলা যায় না, চুপ হয়ে যায়। অনন্তকে কে মুখে বোঝাবে! পাখি যত উপরে উঠে, তার উপর আরও আছে, আপনি কি বল?”
আচার্য – আজ্ঞা হাঁ, বেদান্তে ওইরূপ কথাই আছে।
[নির্গুণ ব্রহ্ম ‘অবাঙ্মনসোগোচরম্’ – ত্রিগুণাতীতম্ ]
শ্রীরামকৃষ্ণ – লবণপুত্তলিকা সাগর মাপতে গিছিল, ফিরে এসে আর খবর দিলে না। এক মতে আছে শুকদেবাদি দর্শন-স্পর্শন করেছিল, ডুব দেয় নাই।
“আমি বিদ্যাসগরকে বলেছিলাম, সব জিনিস এঁটো হয়ে গেছে, কিন্তু ব্রহ্ম উচ্ছিষ্ট হয় নাই।৩ অর্থাৎ ব্রহ্ম কি, কেউ মুখে বলতে পারে নাই। মুখে বললেই জিনিসটা এঁটো হয়। বিদ্যাসাগর পণ্ডিত, শুনে ভারী খুশি।
“কেদারের ওদিকে শুনেছি বরফে ঢাকা পাহাড় আছে। বেশি উচ্চে উঠলে আর ফিরতে হয় না। যারা বেশি উচ্চেতে কি আছে, গেলে কিরূপ অবস্থা হয় – এ-সব জানতে গিয়েছে, তারা ফিরে এসে, আর খবর দেয় নাই।
“তাঁকে দর্শন হলে মানুষ আনন্দে বিহ্বল হয়ে যায়, চুপ৪ হয়ে যায়। খবর কে দেবে? বুঝাবে কে?
“সাত দেউড়ির পর রাজা। প্রত্যেক দেউড়িতে এক-একজন মহা ঐশ্বর্যবান পুরুষ বসে আছেন। প্রত্যেক দেউড়িতেই শিষ্য জিজ্ঞাসা করছে, এই কি রাজা? গুরুও বলছেন, না; নেতি নেতি। সপ্তম দেউড়িতে গিয়ে যা দেখলে, একেবারে অবাক!৫ আনন্দে বিহ্বল। আর জিজ্ঞাসা করতে হল না ‘এই কি রাজা?’ দেখেই সব সংশয় চলে গেল।”
আচার্য – আজ্ঞে হাঁ, বেদান্তে এইরূপই সব আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ – যখন তিনি সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় করেন তখন তাঁকে সগুণ ব্রহ্ম, আদ্যাশক্তি বলি। যখন তিনি তিন গুণের অতীত তখন তাঁকে নির্গুণ ব্রহ্ম, বাক্য-মনের অতীত বলা যায়; পরব্রহ্ম।
প্রথম ডাকাতটি তমোগুণ, যে বলেছিল, ‘একে রেখে আর কি হবে, মেরে ফেল।’ তমোগুণে বিনাশ হয়। দ্বিতীয় ডাকাতটি রজোগুণ; রজোগুণে মানুষ সংসারে বদ্ধ হয়, নানা কাজ জড়ায়। রজোগুণ ঈশ্বরকে ভুলিয়ে দেয়। সত্ত্বগুণ যেন সিঁড়ির শেষ ধাপ। তারপরেই ছাদ। মানুষের স্বধাম হচ্ছে পরব্রহ্ম। ত্রিগুনাতীত না হলে ব্রহ্মজ্ঞান হয় না।
“মানুষ তাঁর মায়াতে পড়ে স্ব-স্বরূপকে ভুলে যায়। সে যে বাপের অনন্ত ঐশ্বর্যের অধিকারী তা ভুলে যায়। তাঁর মায়া ত্রিগুণময়ী। এই তিনগুণই ডাকাত, সর্বস্ব হরণ করে; স্ব-স্বরূপকে ভুলিয়ে দেয়। সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ – তিন গুণ। এদের মধ্যে সত্ত্বগুণই ঈশ্বরের পথ দেখিয়ে দেয়। কিন্তু ঈশ্বরের কাছে সত্ত্বগুণও নিয়ে যেতে পারে না।
“একজন ধনী বনপথ দিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় তিনজন ডাকাত এসে তাকে ঘিরে ফেলল ও তার সর্বস্ব হরণ করলে। সব কেড়ে-কুড়ে নিয়ে একজন ডাকাত বললে, ‘আর একে রেখে কি হবে? একে মেরে ফেল’ – এই বলে তাকে কাটতে এল। দ্বিতীয় ডাকাত বললে, ‘মেরে ফেলে কাজ নেই, একে আষ্টে-পিষ্টে বেঁধে এইখানেই ফেলে রেখে যাওয়া যাক। তাহলে পুলিসকে খবর দিতে পারবে না।’
এই বলে ওকে বেঁধে রেখে ডাকাতরা চলে গেল। খানিকক্ষণ পরে তৃতীয় ডাকাতটি ফিরে এল। এসে বললে, ‘আহা তোমার বড় লেগেছে, না? আমি তোমার বন্ধন খুলে দিচ্ছি।’ বন্ধন খুলবার পর লোকটিকে সঙ্গে করে নিয়ে ডাকাত পথ দেখিয়ে দেখিয়ে চলতে লাগল। সরকারী রাস্তার কাছে এসে বললে, ‘এই পথ ধরে যাও, এখন তুমি অনায়াসে নিজের বাড়িতে যেতে পারবে।’
লোকটি বললে, ‘সে কি মহাশয়, আপনিও চলুন; আপনি আমার কত উপকার করলেন। আমাদের বাড়িতে গেলে আমরা কত আনন্দিত হব।’ ডাকাতটি বললে, ‘না, আমার ওখানে যাবার জো নাই, পুলিশে ধরবে।’ এই বলে সে পথ দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল।
“প্রথম ডাকাতটি তমোগুণ, যে বলেছিল, ‘একে রেখে আর কি হবে, মেরে ফেল।’ তমোগুণে বিনাশ হয়। দ্বিতীয় ডাকাতটি রজোগুণ; রজোগুণে মানুষ সংসারে বদ্ধ হয়, নানা কাজ জড়ায়। রজোগুণ ঈশ্বরকে ভুলিয়ে দেয়। সত্ত্বগুণ যেন সিঁড়ির শেষ ধাপ। তারপরেই ছাদ। মানুষের স্বধাম হচ্ছে পরব্রহ্ম। ত্রিগুনাতীত না হলে ব্রহ্মজ্ঞান হয় না।”
আচার্য – বেশ সব কথা হল।
শ্রীরামকৃষ্ণ – (সহাস্যে) – ভক্তের স্বভাব কি জানো? আমি বলি তুমি শুন, তুমি বল আমি শুনি! তোমরা আচার্য, কত লোককে শিক্ষা দিচ্ছ। তোমরা জাহাজ, আমরা জেলেডিঙি। (সকলের হাস্য)
-১৮৮৩, ২২শে এপ্রিল-
…………………..
রামকৃষ্ণ কথামৃত : একাদশ অধ্যায় : পঞ্চম পরিচ্ছেদ
……………………………………………………
১ অমৃত কুণ্ড – ব্রহ্মৈবেদমমৃতং পুরস্তাদ্ব্রহ্ম পশ্চাদ্ব্রহ্ম দক্ষিণতশ্চোত্তরেণ ৷
অধশ্চোর্ধ্বঞ্চ প্রসৃতং ব্রহ্মৈবেদং বিশ্বমিদং বরিষ্ঠম্ ৷৷ [মুন্ডকোপনিষদ্, ২।২।১১]
২ নারদ বলিলেন – আমি শুদ্ধা সর্বময়ী ভাগবতীতনু প্রাপ্ত হলাম।
প্রযুজ্যমানে ময়ি তাং শুদ্ধাং ভাগবতীতনুম্।
আরব্ধকর্মনির্বাণো নাপতং পাঞ্চভৌতিকঃ। [শ্রীমদ্ভাগবত, ১।৬।২৯]
৩ উচ্ছিষ্ট হয় নাই – অচিন্ত্যমব্যপদেশ্যম্ … অদ্বৈতম্ [মাণ্ডুক্যোপনিষদ্, ৭]
৪ যতো বাচো নির্বতন্তে। অপ্রাপ্য মনসা সহ। [তৈত্তরীয়োপনিষদ্, ২।৪]
৫ ছিদ্যন্তে সর্বসংশয়াঃ .. তস্মিন্ দৃষ্টে পরাবরে। [মুণ্ডকোপিনিষদ্, ২।২।৮]
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….