ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীযুক্ত অধরের বাড়িতে নরেন্দ্রাদি ভক্তসঙ্গে
নরেন্দ্রাদি ভক্তসঙ্গে কীর্তনানন্দে। সমাধিমন্দিরে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ অধরের বাটীর বৈঠকখানায় ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। বৈঠকখানা দ্বিতলের উপর। শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র, মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয়, ভবনাথ, মাস্টার, চুনিলাল, হাজরা প্রভৃতি ভক্তেরা তাঁর কাছে বসিয়া আছেন। বেলা ৩টা হইবে। আজ শনিবার, ২২শে ভাদ্র, ১২৯১; ৬ই সেপ্টেম্বর, ১৮৮৪। কৃষ্ণা প্রতিপদ তিথি।
ভক্তেরা প্রণাম করিতেছেন। মাস্টার প্রণাম করিলে পর, ঠাকুর অধরকে বলিতেছেন, ‘নিতাই ডাক্তার আসবে না?’
শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র গান গাইবেন, তাহার আয়োজন হইতেছে। তানপুরা বাঁধিতে গিয়া তার ছিঁড়িয়া গেল। ঠাকুর বলিতেছেন, ওরে কি করলি। নরেন্দ্র বাঁয়া তবলা বাঁধিতেছেন। ঠাকুর বলিতেছেন। তোর বাঁয়া যেন গালে চড় মারছে!
কীর্তনাঙ্গের গান সম্বন্ধে কথা হইতেছে। নরেন্দ্র বলিতেছেন, “কীর্তনে তাল সম্ এ-সব নাই – তাই অত Popular – লোকে ভালবাসে।”
শ্রীরামকৃষ্ণ – সে কি বললি! করুণ বলে তাই অত – লোকে ভালবাসে।
নরেন্দ্র গান গাইতেছেন-
গান – সুন্দর তোমার নাম দীনশরণ হে।
গান – যাবে কি হে দিন আমার বিফলে চলিয়ে।
আছি নাথ দিবানিশি আশাপথে নিরখিয়ে।।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাজরার প্রতি, সহাস্যে) – প্রথম এই গান করে!
নরেন্দ্র আরও দুই-একটি গান করবার পর বৈষ্ণবচরণ গান গাইতেছেন-
চিনিব কেমনে হে তোমায় (হরি),
ওহে বঙ্কুরায়, ভুলে আছ মথুরায়।
হাতিচড়া জোড়াপরা, ভুলেছ কি ধেনুচরা,
ব্রজের মাখন চুরি করা, মনে কিছু হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ – “হরি হরি বল রে বীণে” ওইটে একবার হোক না।
বৈষ্ণবচরণ গাইতেছেন-
হরি হরি বল রে বীণে!
শ্রীহরির চরণ বিনে পরম তত্ত্ব আর পাবিনে।।
হরিনামে তাপ হরে, মুখে বল হরে কৃষ্ণ হরে,
হরি যদি কৃপা করে, তবে ভবে আর ভাবিনে।
বীণে একবার হরি বল, হরি নাম বিনে নাহি সম্বল,
দাস গোবিন্দ কয় দিন গেল, অকুলে যেন ভাসিনে।।
ঠাকুরের মুহুর্মুহুঃ সমাধি ও নৃত্য
গান শুনিতে শুনিতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাবিষ্ট হইয়া বলিতেছেন – আহা! আহা! হরি হরি বল!
এই কথা বলিতে বলিতে ঠাকুর সমাধিস্থ হইলেন। ভক্তেরা চতুর্দিকে বসিয়া আছেন ও দর্শন করিতেছেন। ঘর লোকে পরিপূর্ণ হইয়াছে।
কীর্তনিয়া ওই গান সমাপ্ত করিয়া নূতন গান ধরিলেন।
শ্রীগৌরাঙ্গ সুন্দর নব নটবর, তপত কাঞ্চন কায়।
কীর্তনিয়া যখন আখর দিচ্ছেন, “হরিপ্রেমের বন্যে ভেসে যায়,” ঠাকুর দণ্ডায়মান হইয়া নৃত্য করিতে লাগিলেন। আবার বসিয়া বাহু প্রসারিত করিয়া আখর দিতেছেন। – (একবার হরি বল রে)
ঠাকুর আখর দিতে দিতে ভাবাবিষ্ট হইলেন ও হেঁটমস্তক হইয়া সমাধিস্থ হইলেন। তাকিয়াটি সম্মুখে। তাহার উপর শিরদেশ ঢলিয়া পড়িয়াছে। কীর্তনিয়া আবার গাইতেছেন:
‘হরিনাম বিনে আর কি ধন আছে সংসারে, বল মাধাই মধুর স্বরে।’
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।
গান – হরি বলে আমার গৌর নাচে।
নাচে রে গৌরাঙ্গ আমার হেমগিরির মাঝে।
রাঙ্গাপায়ে সোনার নূপুর রুণু ঝুণু বাজে।।
থেকো রে বাপ নরহরি থেকো গৌরের পাশে।
রাধার প্রেমে গড়া তনু, ধূলায় পড়ে পাছে।।
বামেতে অদ্বৈত আর দক্ষিণে নিতাই।
তার মাঝে নাচে আমার চৈতন্য গোঁসাই।।
ঠাকুর আবার উঠিয়াছেন ও আখর দিয়া নাচিতেছেন।
(প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে রে)!
সেই অপূর্ব নৃত্য দেখিয়া নরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তেরা আর স্থির থাকিতে পারিলেন না, সকলেই ঠাকুরের সঙ্গে নাচিতে লাগিলেন।
নাচিতে নাচিতে ঠাকুর এক-একবার সমাধিস্থ হইতেছেন। তখন অন্তর্দশা। মুখে একটি কথা নাই। শরীর সমস্ত স্থির। ভক্তেরা তখন তাঁহাকে বেড়িয়া বেড়িয়া নাচিতেছেন।
কিয়ৎক্ষণ পরেই অর্ধবাহ্যদশা – চৈতন্যদেবের যেরূপ হইত, – অমনি ঠাকুর সিংহবিক্রমে নৃত্য করিতেছেন। তখনও মুখে কথা নাই – প্রেমে উন্মত্তপ্রায়!
যখন একটু প্রকৃতিস্থ হইতেছেন – অমনি একবার আখর দিতেছেন।
আজ অধরের বৈঠকখানার ঘর শ্রীবাসের আঙিনা হইয়াছে। হরিনামের রোল শুনিতে পাইয়া রাজপথে অসংখ্য লোক জমিয়া গিয়াছে।
ভক্তসঙ্গে অনেকক্ষণ নৃত্যের পর ঠাকুর আবার আসন গ্রহণ করিয়াছেন। এখনও ভাবাবেশ। সেই অবস্থায় নরেন্দ্রকে বলিতেছেন – সেই গানটি – “আমায় দে মা পাগল করে।”
ঠাকুরের আজ্ঞা পাইয়া নরেন্দ্র গান গাইতেছেন-
আমায় দে মা পাগল করে (ব্রহ্মময়ী)
আর কাজ নাই জ্ঞানবিচারে।।
তোমার প্রেমের সুরা, পানে কর মাতোয়ারা।
ও মা ভক্ত চিত্তহরা ডুবাও প্রেমসাগরে।।
তোমার এ পাগলা গারদে, কেহ হাসে কেহ কাঁদে,
কেহ নাচে আনন্দ ভরে।
ঈশা মুসা শ্রীচৈতন্য, ওমা প্রেমের ভরে অচৈতন্য,
হায় কবে হব মা ধন্য, (ওমা) মিশে তার ভিতরে।।
স্বর্গেতে পাগলের মেলা, যেমন গুরু তেমনি চেলা,
প্রেমের খেলা কে বুঝতে পারে।
তুই প্রেমে উন্মাদিনী, ওমা পাগলের শিরোমণি,
প্রেমধনে কর মা ধনী, কাঙ্গাল প্রেমদাসেরে।।
শ্রীরামকৃষ্ণ – আর ওইটি “চিদানন্দ সিন্ধুনীরে।”
নরেন্দ্র গাইতেছেন:
চিদানন্দ সিন্ধুনীরে প্রেমানন্দের লহরী।
মহাভাব রসলীলা কি মাধুরী মরি মরি।।
মহাযোগে সমুদায় একাকার হইল।
দেশ-কাল ব্যবধান ভেদাভেদ ঘুচিল।।
এখন আনন্দে মাতিয়া দুবাহু তুলিয়া,
বল রে মন হরি হরি।।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি) – আর ‘চিদাকাশে’? – না, ওটা বড় লম্বা, না? আচ্ছা, একটু আস্তে আস্তে!
নরেন্দ্র গাইতেছেন:
চিদাকাশে হল পূর্ণ প্রেমচন্দ্রোদয় হে।
উথলিল প্রেমসিন্ধু কি আনন্দময় হে।।
শ্রীরামকৃষ্ণ – আর ওইটে – ‘হরিরস মদিরা?’
নরেনদ্র – হরিরস মদিরা পিয়ে মম মানস মাত রে।
লুটায়ে অবনীতল, হরি হরি বলি কাঁদ রে।।
ঠাকুর আখর দিতেছেন:
প্রেমে মত্ত হয়ে, হরি হরি বলি কাঁদ রে।
ভাবে মত্ত হয়ে, হরি হরি বলি কাঁদ রে!
ঠাকুর ও ভক্তেরা একটু বিশ্রাম করিতেছেন। নরেন্দ্র আস্তে আস্তে ঠাকুরকে বলিতেছেন – “আপনি সেই গানটি একবার গাইবেন? -”
শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেছেন – ‘আমার গলাটা একটু ধরে গেছে -’
কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর আবার নরেন্দ্রকে বলিতেছেন – ‘কোন্টি?’
নরেন্দ্র – ভুবনরঞ্জনরূপ।
ঠাকুর আস্তে আস্তে গাইতেছেন-
ভুবনরঞ্জনরূপ নদে গৌর কে আনিল রে (অলকা আবৃত মুখ)
(মেঘের গায়ে বিজলী) (আন হেরিতে শ্যাম হেরি)
ঠাকুর আর-একটি গান গাহিতেছেন-
শ্যামের নাগাল পেলাম না লো সই।
আমি কি সুখে আর ঘরে রই।।
শ্যাম যদি মোর হতো মাথার চুল।
যতন করে বাঁধতুম বেণী সই, দিয়ে বকুল ফুল।।
(কেশব-কেশ যতনে বাঁধতুম সই)
(কেউ নক্তে পারত না সই)
(শ্যাম কালো আর কেশ কালো)
(কালোয় কালোয় মিশে যেতো গো)।
শ্যাম যদি মোর বেশর হইত, নাসা মাঝে সতত রহিত, –
(অধর চাঁদ অধরে র’ত সই)
(যা হবা নয়, তা মনে হয় গো)
(শ্যাম কেন বেশর হবে সই?)।
শ্যাম যদি মোর কঙ্কণ হতো বাহু মাঝে সতত রহিত
(কঙ্কণ নাড়া দিয়ে চলে যেতুম সই) (বাহু নাড়া দিয়ে)
(শ্যাম-কঙ্কণ হাতে দিয়ে, চলে যেতুম সই) (রাজপথে)
-১৮৮৪, ৬ই সেপ্টেম্বর-
……………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : চতুর্বিংশ অধ্যায় : প্রথম পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….