ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

শ্রীরামকৃষ্ণ অধরের বাড়ি দুর্গাপূজা মহোৎসবে

শ্রীযুক্ত অধরের বাড়িতে ৺নবমীপূজার দিনে ঠাকুরদালানে শ্রীরামকৃষ্ণ দণ্ডায়মান। সন্ধ্যার পর শ্রীশ্রীদুর্গার আরতি দর্শন করিতেছেন। অধরের বাড়ি দুর্গাপূজা মহোৎসব, তাই তিনি ঠাকুরকে নিমন্ত্রণ করিয়া আনিয়াছেন।

আজ বুধবার, ১০ই অক্টোবর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ, ২৪শে আশ্বিন। শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে আসিয়াছেন, তন্মধ্যে বলরামের পিতা ও অধরের বন্ধু অবসরপ্রাপ্ত স্কুল ইনস্পেক্টর সারদাবাবু আসিয়াছেন। অধর প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের ৺পূজা উপলক্ষে নিমন্ত্রণ করিয়াছেন, তাঁহারাও অনেকে আসিয়াছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ সন্ধ্যার আরতি দর্শন করিয়া ভাবাবিষ্ট হইয়া ঠাকুরদালানে দাঁড়াইয়া আছেন। ভাবাবিষ্ট হইয়া মাকে গান শুনাইতেছেন।

অধর গৃহীভক্ত, আবার অনেক গৃহীভক্ত উপস্থিত, ত্রিতাপে তাপিত। তাই বুঝি শ্রীরামকৃষ্ণ সকলের মঙ্গলের জন্য জগন্মাতাকে স্তব করিতেছেন:

তার তারিণী। এবার তারো ত্বরিত করিয়ে,
তপন-তনয়-ত্রাসে ত্রাসিত, যায় মা প্রাণী ৷৷

জগত অম্বে জন-পালিনী, জন-মোহিনী জগত-জননী।
যশোদা জঠরে জনম লইয়ে সহায় হরিলীলায় ৷৷
বৃন্দাবনে রাধাবিনোদিনী, ব্রজবল্লভবিহারকারিণী।
রাসরঙ্গিনী রসময়ী হয়ে রাস করিলে লীলাপ্রকাশ ৷৷

গিরিজা গোপজা গোবিন্দ মোহিনী তুমি মা গঙ্গে গতিদায়িনী;
গান্ধার্বিকে গৌরবরণী গাওয়ে গোলকে গুণ তোমার।
শিবে সনাতনী সর্বাণী ঈশানী সদানন্দময়ী সর্বস্বরূপিণী,
সগুণা নির্গুণা সদাশিবপ্রিয়ে কে জানে মহিমা তোমার!

শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবাবেশে জগন্মাতার সঙ্গে কথা 

শ্রীরামকৃষ্ণ অধরের বাড়ির দ্বিতল বৈঠকখানায় গিয়া বসিয়াছেন। ঘরে অনেক নিমন্ত্রিত ব্যক্তি আসিয়াছেন।

বলরামের পিতা ও সারদাবাবু প্রভৃতি কাছে বসিয়া আছেন।

ঠাকুর এখনও ভাবাবিষ্ট। নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন, “ও বাবুরা, আমি খেয়েছি, এখন তোমরা নিমন্ত্রণ খাও।”

অধরের নৈবেদ্য পূজা মা গ্রহণ করিয়াছেন, তাই কি শ্রীরামকৃষ্ণ জগন্মাতার আবেশে বলিতেছেন, “আমি খেয়েছি, এখন তোমরা প্রসাদ পাও?”

ঠাকুর জগন্মাতাকে ভাবাবিষ্ট হইয়া বলিতেছেন, “মা আমি খাব? না, তুমি খাবে? মা কারণানন্দরূপিণী।”

শ্রীরামকৃষ্ণ কি জগন্মাতাকে ও আপনাকে এক দেখিতেছেন? যিনি মা তিনিই কি সন্তানরূপে লোকশিক্ষার জন্য অবতীর্ণ হইয়াছেন? তাই কি ঠাকুর “আমি খেয়েছি” বলছেন?

এইবার ভাবাবেশে দেহের মধ্যে ষট্‌চক্র, তার মধ্যে মাকে দেখিতেছেন! তাই আবার ভাবে বিভোর হইয়া গান গাইতেছেন:

ভুবন ভুলাইলি মা, হরমোহিনী।
মূলাধারে মহোৎপলে, বীণাবাদ্য-বিনোদিনী ৷৷
শরীর শারীর যন্ত্রে সুষুম্নাদি ত্রয় তন্ত্রে,
গুণভেদ মহামন্ত্রে গুণত্রয়বিভাগিনী ৷৷
আধার ভৈরবাকার, ষড়্‌ দলে শ্রীরাগ আর।

মণিপুরেতে মহ্লার বসন্তে হৃৎপ্রকাশিনী ৷৷
বিশুদ্ধ হিল্লোল সুরে, কর্ণাটক আজ্ঞাপুরে।
তান-লয়-মান-সুরে ত্রিসপ্ত-সুরভেদিনী ৷৷
মহামায়া মোহপাশে বদ্ধ কর আনায়াসে।
তত্ত্ব লয়ে তত্ত্বাকাশে স্থির আছে সৌদামিনী ৷৷

শ্রীনন্দকুমারে কয়, তত্ত্ব না নিশ্চয় হয়।
তব তত্ত্ব গুণত্রয় কাকীমুখ-আচ্ছাদিনী ৷৷

গান – ভাব কি ভেবে পরাণ গেল।
যাঁর নামে হরে কাল, পদে মহাকাল, তাঁর কেন কালরূপ হল ৷৷
কালরূপ অনেক আছে, এ-বড় আশ্চর্য কালো,
যাঁরে হৃদিমাঝে রাখলে পরে হৃদপদ্ম করে আলো ৷৷

রূপে কালী, নামে কালী কাল হতে অধিক কালো।
ও-রূপ যে দেখেছে, সে মজেছে অন্যরূপ লাগে না ভাল ৷৷
প্রসাদ বলে কুতুহলে এমন মেয়ে কোথায় ছিল।
না দেখে নাম শুনে কানে মন গিয়ে তায় লিপ্ত হল ৷৷

অভয়ার শরণাগত হলে সকল ভয় যায়, তাই বুঝি ভক্তদের অভয় দিতেছেন ও গান গাইতেছেন:

অভয় পদে প্রাণ সঁপেছি।
আমি আর কি যমের ভয় রেখেছি ৷৷

শ্রীযুক্ত সারদাবাবু পুত্রশোকে অভিভূত, তাই তাঁর বন্ধু অধর তাঁহাকে ঠাকুরের কাছে লইয়া আসিয়াছেন। তিনি গৌরাঙ্গ ভক্ত। তাঁহাকে দেখিয়া শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রীগৌরাঙ্গের উদ্দীপন হইয়াছে। ঠাকুর গাহিতেছেন-

আমার অঙ্গ কেন গৌর হল।
কি করলে রে ধনী, অকালে সকাল কৈলে, অকালেতে বরণ ধরালে ৷৷
এখন তো গৌর হতে দিন, বাকি আছে!
এখন তো দ্বাপর লীলা, শেষ হয় নাই!
একি হল রে! কোকিল ময়ূর, সকলই গৌর।
যেদিকে ফিরাই আঁখি (একি হল রে)।

একি, একি, গৌরময় সকল দেখি ৷৷
রাই বুঝি মথুরায় এল, তাইতো অঙ্গ বুঝি গৌর হল!
ধনী কুমুরিয়ে পোকা ছিল, তাইতে আপনার বরণ ধরাইল।
এখনি যে অঙ্গ কালো ছিল, দেখতে দেখতে গৌর হল!
রাই ভেবে কি রাই হলাম। (একি রে)

যে রাধামন্ত্র জপ না করে, রাই ধনী কি আপনার বরণ ধরায় তারে।
মথুরায় আমি, কি নবদ্বীপে আমি, কিছু ঠাওরাতে নারি রে!
এখনও তো, মহাদেব অদ্বৈত হয় নাই (আমার অঙ্গ কেন গৌর)।
এখনও তো বলাই দাদা নিতাই হয় নাই, বিশাখা রামানন্দ হয় নাই।
এখনও তো ব্রহ্মা হরিদাস হয় নাই, এখনও তো নারদ শ্রীবাস হয় নাই।
এখনও তো মা যশোদা শচী হয় নাই।

একাই কেন আমি গৌর (যখন বলাইদাদা নিতাই হয় নাই তখন)
তবে রাই বুঝি মথুরায় এল, তাইতে কি অঙ্গ আমার গৌর হল।
(অতএব বুঝি আমি গৌর) এখনও তো, পিতা নন্দ জগন্নাথ হয় নাই।
এখনও তো শ্রীরাধিকা গদাধর হয় নাই। আমার অঙ্গ কেন গৌর হল ৷৷

এইবার শ্রীগৌরাঙ্গের ভাবে আবিষ্ট হইয়া গান গাহিতেছেন। বলিতেছেন, সারদাবাবু এই গান বড় ভালবাসেন:

ভাব হবে বই কি রে (ভাবনিধি শ্রীগৌরাঙ্গের)
ভাবে হাসে কাঁদে নাচে গায়।
বন দেখে বৃন্দাবন ভাবে। সুরধনী দেখে শ্রীযমুনা ভাবে।
গোরা ফুকরি ফুকরি কান্দে! (যার অন্তঃ কৃষ্ণ বহির্গৌর)
গোরা আপনার পা আপনি ধরে ৷৷

গান – পাড়ার লোকে গোল করে মা,
আমায় বলে গৌর কলঙ্কিনী।
একি কইবার কথা কইবো কোথা;
লাজে মলাম ওগো প্রাণ সজনী।

একদিন শ্রীবাসের বাড়ি, কীর্তনের ধুম হুড়াহুড়ি;
গৌরচাঁদ দেন গড়াগড়ি শ্রীবাস আঙিনায়;
আমি একপাশে দাঁড়িয়া ছিলাম, (একপাশে নুকায়ে),
আমি পড়লাম অচেতন হয়ে, চেতন করায় শ্রীবাসের রমণী।

একদিন কাজীর দলন, গৌর করেন নগর কীর্তন,
চণ্ডালাদি যতেক যবন, গৌর সঙ্গেতে;
হরিবোল হরিবোল বলে, চলে যান নদের বাজার দিয়ে,
আমি তাদের সঙ্গে গিয়ে, দেখেছিলাম রাঙা চরণ দুখানি।

একদিন জাহ্নবীর তটে; গৌরচাঁদ দাঁড়ায়ে ঘাটে,
চন্দ্রসূর্য উভয়েতে, গৌর অঙ্গেতে;
দেখে গৌর রূপের ছবি, ভুলে গেল শাক্ত শৈবী,
আমার কলসী পড়ে গেল দৈবী, দেখেছিল পাপ ননদিনী ৷৷

বলরামের পিতা বৈষ্ণব। তাই বুঝি এবার শ্রীরামকৃষ্ণ গোপীদের উদ্‌ভ্রান্ত প্রেমের গান গাহিতেছেন:

শ্যামের নাগাল পেলাম না গো সই।
আমি কি সুখে আর ঘরে রই।
শ্যাম যদি মোর হত মাথার চুল।
যতন করে বাঁধতুম বেণী সই, দিয়ে বকুল ফুল ৷৷

শ্যাম যদি মোর কঙ্কন হত বাহু মাঝে সতত রহিত।
(কঙ্কন নাড়া দিয়ে চলে যেতুম সই) (বাহু নাড়া দিয়ে)
(শ্যাম-কঙ্কন হাতে দিয়ে) (চলে যেতুম সই) (রাজপথে)

-১৮৮৩, ১০ই অক্টোবর-

……………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : চর্তুদশ অধ্যায় : ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!