গুরুশিষ্য-সংবাদ – গুহ্যকথা
সন্ধ্যা হইল। ফরাশ ৺কালীমন্দিরে ও ৺রাধামন্দিরে ও অন্যান্য ঘরে আলো জ্বালিয়া দিল। ঠাকুর ছোট খাটটিতে বসিয়া জগন্মাতার চিন্তা ও তৎপরে ঈশ্বরের নাম করিতেছেন। ঘরে ধুনো দেওয়া হইয়াছে। একপার্শ্বে একটি পিলসুজে প্রদীপ জ্বলিতেছে। কিয়ৎক্ষণ পরে শাঁখঘন্টা বাজিয়া উঠিল। ৺কালীবাড়িতে আরতি হইতেছে। শুক্লা দশমী তিথি, চর্তুদিকে চাঁদের আলো।
আরতির কিয়ৎক্ষণ পরে শ্রীরামকৃষ্ণ ছোট খাটটিতে বসিয়া মণির সহিত একাকী নানা বিষয়ে কথা কহিতেছেন। মণি মেঝেতে বসিয়া।
[“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন” ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) – নিষ্কামকর্ম করবে। ঈশ্বর বিদ্যাসাগর যে-কর্ম করে সে ভাল কাজ – নিষ্কামকর্ম করবার চেষ্টা করে।
মণি – আজ্ঞা হাঁ। আচ্ছা, যেখানে কর্ম সেখানে কি ঈশ্বর পাওয়া যায়? রাম আর কাম কি এক সঙ্গে হয়? হিন্দীতে একটা কথা সেদিন পড়লাম।
“যাহাঁ রাম তাহাঁ নাহি কাম, যাহাঁ কাম তাঁহা নাহি রাম।”
শ্রীরামকৃষ্ণ – কর্ম সকলেই করে – তাঁর নামগুণ করা এও কর্ম – সোঽহংবাদীদের ‘আমিই সেই’ এই চিন্তাও কর্ম – নিঃশ্বাস ফেলা, এও কর্ম। কর্মত্যাগ করবার জো নাই। তাই কর্ম করবে, কিন্তু ফল ঈশ্বরে সমর্পণ করবে।
মণি – আজ্ঞা, যাতে অর্থ বেশি হয় এ-চেষ্টা কি করতে পারি?
শ্রীরামকৃষ্ণ – বিদ্যার সংসারের জন্য পারা যায়। বেশি উপায়ের চেষ্টা করবে। কিন্তু সদুপায়ে। উপার্জন করা উদ্দেশ্য নয়। ঈশ্বরের সেবা করাই উদ্দেশ্য। টাকাতে যদি ঈশ্বরের সেবা হয় তো সে টাকায় দোষ নাই।
মণি – আজ্ঞা, পরিবারদের উপর কর্তব্য কতদিন?
শ্রীরামকৃষ্ণ – তাদের খাওয়া পরার কষ্ট না থাকে। কিন্তু সন্তান নিজে সমর্থ হলে তাদের ভার লবার দরকার নাই, পাখির ছানা খুঁটে খেতে শিখলে, আবার মার কাছে খেতে এলে, মা ঠোক্কর মারে।
মণি – কর্ম কতদিন করতে হবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ – ফললাভ হলে আর ফুল থাকে না। ঈশ্বরলাভ হলে কর্ম আর করতে হয় না। মনও লাগে না।
“মাতাল বেশি মদ খেয়ে হুঁশ রাখতে পারে না। – দু-আনা খেলে কাজকর্ম চলতে পারে! ঈশ্বরের দিকে যতই এগুবে ততই তিনি কর্ম কমিয়ে দেবেন। ভয় নাই। গৃহস্থের বউ অন্তঃসত্ত্বা হলে শাশুড়ি ক্রমে ক্রমে কর্ম কমিয়ে দেয়। দশমাস হলে আদপে কর্ম করতে দেয় না। ছেলেটি হলে ওইটিকে নিয়ে নাড়াচাড়া করে।
“যে-কটা কর্ম আছে, সে-কটা শেষ হয়ে গেলে নিশ্চিন্ত। গৃহিণী বাড়ির রাঁধাবাড়া আর কাজকর্ম সেরে যখন নাইতে গেল, তখন আর ফেরে না – তখন ডাকাডাকি করলেও আর আসবে না।
[ঈশ্বরলাভ ও ঈশ্বরদর্শন কি? উপায় কি? ]
মণি – আজ্ঞা, ঈশ্বরলাভ-এর মানে কি? আর ঈশ্বরদর্শন কাকে বলে? আর কেমন করে হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ – বৈষ্ণবরা বলে যে, ঈশ্বরের পথে যারা যাচ্ছে আর যারা তাঁকে লাভ করেছে তাদের থাক থাক আছে – প্রবর্তক, সাধক, সিদ্ধ আর সিদ্ধের সিদ্দ। যিনি সবে পথে উঠছেন তাকে প্রবর্তক বলে। যে সাধন-ভজন করছে – পূজা, জপ, ধ্যান, নামগুণকীর্তণ করছে – সে ব্যক্তি সাধক। যে-ব্যক্তি ঈশ্বর আছেন বোধে বোধ করেছে, তাকেই সিদ্ধ বলে। যেমন বেদান্তের উপমা আছে – অন্ধকার ঘর, বাবু শুয়ে আছে।
বাবুকে একজন হাতড়ে হাতড়ে খুঁজছে। একটা কৌচে হাত দিয়ে বলছে, এ নয়, জানালায় হাত দিয়ে বলছে, এ নয়, দরজায় হাত দিয়ে বলছে, এ নয়। নেতি, নেতি, নেটি। শেষে বাবুর গায়ে হাত পড়েছে, তখন বলছে, ‘ইহ’ এই বাবু – অর্থাৎ ‘অস্তি’ বোধ হয়েছে। বাবুকে লাভ হয়েছে, কিন্তু বিশেষরূপে জানা হয় নাই।
“আর-এক থাক আছে, তাকে বলে সিদ্ধের সিদ্ধ। বাবুর সঙ্গে যদি বিশেষ আলাপ হয় তাহলে আর একরকম অবস্থা – যদি ঈশ্বরের সঙ্গে প্রেমভক্তির দ্বারা বিশেষ আলাপ হয়। যে সিদ্ধ সে ঈশ্বরকে পেয়েছে বটে, যিনি সিদ্ধের সিদ্ধ তিনি ঈশ্বরের সঙ্গে বিশেষরূপে আলাপ করেছেন।
“কিন্তু তাঁকে লাভ করতে হলে একটা ভাব আশ্রয় করতে হয়। শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য বা মধুর।
“শান্ত – ঋষিদের ছিল। তাদের অন্য কিছু ভোগ করবার বাসনা ছিল না। যেমন স্ত্রীর স্বামীতে নিষ্ঠা, – সে জানে আমার পতি কন্দর্প।
“দাস্য – যেমন হনুমানের। রামের কাজ করবার সময় সিংহতুল্য। স্ত্রীরও দাস্যভাব থাকে, – স্বামীকে প্রাণপণে সেবা করে। মার কিছু কিছু থাকে – যশোদারও ছিল।
“সখ্য – বন্ধুর ভাব; এস, এস কাছে এসে বস। শ্রীদামাদি কৃষ্ণকে কখন এঁটো ফল খাওয়াচ্ছে, কখন ঘাড়ে চড়ছে।
“বাৎসল্য – যেমন যশোদার। স্ত্রীরও কতকটা থাকে, – স্বামীকে প্রাণ চিরে খাওয়ায়। ছেলেটি পেট ভরে খেলে তবেই মা সন্তুষ্ট। যশোদা কৃষ্ণ খাবে বলে ননী হাতে করে বেড়াতেন।
“মধুর – যেমন শ্রীমতীর। স্ত্রীরও মধুরভাব। এ-ভাবের ভিতরে সকল ভাবই আছে – শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য।”
মণি – ঈশ্বরকে দর্শন কি এই চক্ষে হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ – তাঁকে চর্মচক্ষে দেখা যায় না। সাধনা করতে করতে একটি প্রেমের শরীর হয় – তার প্রেমের চক্ষু, প্রেমের কর্ণ। সেই চক্ষে তাঁকে দেখে, – সেই কর্ণে তাঁর বাণী শুনা যায়। আবার প্রেমের লিঙ্গ যোনি হয়।
এই কথা শুনিয়া মণি হো-হো করিয়া হাসিয়া ফেলিলেন। ঠাকুর বিরক্ত না হইয়া আবার বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – এই প্রেমের শরীরে আত্মার সহিত রমণ হয়।
মণি আবার গম্ভীর হইলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – ঈশ্বরের প্রতি খুব ভালবাসা না এলে হয় না। খুব ভালবাসা হলে তবেই তো চারিদিক ঈশ্বরময় দেখা যায়। খুব ন্যাবা হলে তবেই চারিদিক হলদে দেখা যায়।
“তখন আবার ‘তিনিই আমি’ এইটি বোধ হয়। মাতালের নেশা বেশি হলে বলে, ‘আমিই কালী’।
“গোপীরা প্রেমোন্মত্ত হয়ে বলতে লাগল, ‘আমিই কৃষ্ণ।’
“তাঁকে রাতদিন চিন্তা করলে তাঁকে চারিদিকে দেখা যায়, যেমন – প্রদীপের শিখার দিকে যদি একদৃষ্টে চেয়ে থাক, তবে খানিকক্ষণ পরে চারিদিক শিখাময় দেখা যায়।”
[ঈশ্বরদর্শন কি মস্তিষ্কের ভুল? “সংশয়াত্মা বিনশ্যতি” ]
মণি ভাবিতেছেন যে, সে শিখা তো সত্যকার শিখা নয়।
ঠাকুর অন্তর্যামী, বলিতেছেন, চৈতন্যকে চিন্তা করলে অচৈতন্য হয় না। শিবনাথ বলেছিল, ঈশ্বরকে একশোবার ভাবলে বেহেড হয়ে যায়। আমি তাকে বললাম, চৈতন্যকে চিন্তা করলে কি অচৈতন্য হয়?
মণি – আজ্ঞা, বুঝেছি। এ-তো অনিত্য কোন বিষয় চিন্তা করা নয়? -যিনি নিত্যচৈতন্যস্বরূপ তাঁতে মন লাগিয়ে দিলে মানুষ কেন অচৈতন্য হবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ (প্রসন্ন হইয়া) – এইটি তাঁর কৃপা – তাঁর কৃপা না হলে সন্দেহ ভঞ্জন হয় না।
“আত্মার সাক্ষাৎকার না হলে সন্দেহ ভঞ্জন হয় না।
“তাঁর কৃপা হলে আর ভয় নাই। বাপের হাত ধরে গেলেও বরং ছেলে পড়তে পারে? কিন্তু ছেলের হাত যদি বাপ ধরে, আর ভয় নাই। তিনি কৃপা করে যদি সন্দেহ ভঞ্জন করেন, আর দেখা দেন আর কষ্ট নাই। – তবে তাঁকে পাবার জন্য খুব ব্যাকুল হয়ে ডাকতে ডাকতে – সাধনা করতে করতে তবে কৃপা হয়। ছেলে অনেক দৌড়াদৌড়ি কচ্ছে, দেখে মার দয়া হয়। মা লুকিয়া ছিল, এসে দেখা দেয়।”
মণি ভাবিতেছেন, তিনি দৌড়াদৌড়ি কেন করান। – ঠাকুর অমনি বলিতেছেন, “তাঁর ইচ্ছা যে খানি দৌড়াদৌড়ি হয়; তবে আমোদ হয়। তিনি লীলায় এই সংসার রচনা করেছেন। এরি নাম মহামায়া। তাই সেই শক্তিরূপিণী মার শরণাগত হতে হয়। মায়াপাশে বেঁধে ফেলেছে, এই পাশ ছেদন করতে পারলে তবেই ঈশ্বরদর্শন হতে পারে।”
[আদ্যাশক্তি মহামায়া ও শক্তিসাধনা ]
শ্রীরামকৃষ্ণ – তাঁর কৃপা পেতে গেলে আদ্যাশক্তিরূপিণী তাঁকে প্রসন্ন করতে হয়। তিনি মহামায়া। জগৎকে মুগ্ধ করে সৃষ্টি স্থিতি প্রলায় করছেন। তিনি অজ্ঞান করে রেখে দিয়েছেন। সেই মহামায়া দ্বার ছেড়ে দিলে তবে অন্দরে যাওয়া যায়। বাহিরে পড়ে থাকলে বাহিরের জিনিস কেবল দেখা যায় – সেই নিত্য সচ্চিদানন্দ পুরুষকে জানতে পারা যায় না। তাই পুরাণে কথা আছে – চন্ডীতে – মধুকৈটভ১ বধের সময় ব্রহ্মাদি দেবতারা মহামায়ার স্তব করছেন।
“শক্তিই জগতের মূলাধার। সেই আদ্যাশক্তির ভিতরে বিদ্যা ও অবিদ্যা দুই আছে, – অবিদ্যা – মুগ্ধ করে। অবিদ্যা – যা থেকে কামিনী-কাঞ্চন – মুগ্ধ করে। বিদ্যা – যা থেকে ভক্তি, দয়া, জ্ঞান, প্রেম – ঈশ্বরের পথে লয়ে যায়।
“সেই অবিদ্যাকে প্রসন্ন করতে হবে। তাই শক্তির পূজা পদ্ধতি।
“তাঁকে প্রসন্ন করবার জন্য নানাভাবে পূজা – দাসীভাব, বীরভাব, সন্তানভাব। বীরভাব – অর্থাৎ রমণ দ্বারা তাঁকে প্রসন্ন করা।
“শক্তিসাধনা – সব ভারী উৎকট সাধনা ছিল, চালাকি নয়।
“আমি মার দাসীভাবে, সখীভাবে দুই বৎসর ছিলাম। আমার কিন্তু সন্তানভাব, স্ত্রীলোকের স্তন মাতৃস্তন মনে করি।
“মেয়েরা এক-একটি শক্তির রূপ। পশ্চিমে বিবাহের সময় বরের হাতে ছুরি থাকে, বাংলা দেশে জাঁতি থাকে; – অর্থাৎ ওই শক্তিরূপা কন্যার সাহায্যে বর মায়াপাশ ছেদন করবে। এটি বীরভাব। আমি বীরভাবে পূজা করি নাই। আমার সন্তানভাব।
“কন্যা শক্তিরূপা। বিবাহের সময় দেখ নাই – বর-বোকাটি পিছনে বসে থাকে? কন্যা কিন্তু নিঃশঙ্ক।”
[দর্শনের পর ঐশ্বর্য ভুল হয় – নানা জ্ঞান, অপরা-বিদ্যা – ‘Religion and Science’ -সাত্ত্বিক ও রাজসিক জ্ঞান ]
শ্রীরামকৃষ্ণ – ঈশ্বরলাভ করলে তাঁর বাহিরের ঐশ্বর্য, তাঁর জগতের ঐশ্বর্য ভুল হয়ে যায়; তাঁকে দেখলে তাঁর ঐশ্বর্য মনে থাকে না। ঈশ্বরের আনন্দে মগ্ন হলে ভক্তের আর হিসাব থাকে না। নরেন্দ্রকে দেখলে “তোর নাম কি; তোর বাড়ি কোথা” – এ-সব জিজ্ঞাসা করার দরকার হয় না। জিজ্ঞাসা করবার অবসর কই? হনুমানকে একজন জিজ্ঞাসা করেছিল, আজ কি তিথি? হনুমান বললে, “ভাই, আমি বার তিথি নক্ষত্র – এ-সব কিছুই জানি না, আমি এক ‘রাম’ চিন্তা করি।”
-১৮৮২, ২৪শে অগস্ট-
………………………………………………..
১ ত্বং স্বাহা ত্বং স্বধা ত্বং হি বষট্কারঃ স্বরাত্মিকা ৷সুধা ত্বমক্ষরে নিত্য ত্রিধা মাত্রাত্মিকা স্থিতা ৷৷ [চন্ডী – মধুকৈটভবধ]
…………………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : তৃতীয় পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….