ভক্তসঙ্গে কীর্তনানন্দে
এইবার কীর্তন আরম্ভ হইল। বৈষ্ণবচরণ অভিসার আরম্ব করিয়া রাসকীর্তন করিয়া পালা সমাপ্ত করিলেন। শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের মিলন কীর্তন যাই আরম্ভ হইল, ঠাকুর প্রেমানন্দে নৃত্য করিতে লাগিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভক্তেরাও তাঁহাকে বেড়িয়া নাচিতে লাগিলেন ও সংকীর্তন করিতে লাগিলেন। কীর্তনান্তে সকলে আসন গ্রহণ করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিজয়ের প্রতি) – ইনি বেশ গান!
এই বলিয়া বৈষ্ণবচরণকে দেখাইয়া দিলেন ও তাঁহাকে ‘শ্রীগৌরাঙ্গসুন্দর’ এই গানটি গাহিতে বলিলেন। বৈষ্ণবচরণ গান ধরিলেন:
শ্রীগৌরাঙ্গসুন্দর নব নটবর, তপত কাঞ্চনকায় ইত্যাদি।
গান সমাপ্ত হইলে ঠাকুর বিজয়কে বলিলেন, ‘কেমন?’ বিজয় বলিলেন, ‘আশ্চর্য।’ ঠাকুর গৌরাঙ্গের ভাবে নিজে গান ধরিলেন:
ভাব হবে বইকি রে!
ভাবনিধি শ্রীগৌরাঙ্গের ভাব হবে বইকিরে ৷৷
ভাবে হাসে কাঁদে নাচে গায়।
বন দেখে বৃন্দাবন ভাবে; সমুদ্র দেখে শ্রীযমুনা ভাবে।
যার অন্তঃকৃষ্ণ বহির্গৌর (ভাব হবে) ।
গোরা ফুকরি ফুকরি কান্দে; গোরা আপনার পায় আপনি ধরে।
বলে কোথা রাই প্রেমময়ী।
মণি সঙ্গে সঙ্গে গাইতেছেন।
ঠাকুরের গান সমাপ্ত হইলে বৈষ্ণবচরণ আবার গাইলেন-
হরি হরি বল রে বীণে!
হরির করুণা বিনে, পরম তত্ত্ব আর পাবিনে ৷৷
হরিনামে তাপ হরে, মুখে বল হরে কৃষ্ণ হরে,
হরি যদি কৃপা করে, তবে ভবে আর ভাবিনে!
বীণে একবার হরি বল, হরিনাম বিনে নাই সম্বল,
দাস গোবিন্দ কয়, দিন গেলে, অকূলে যেন ডুবিনে।
ঠাকুর কীর্তনিয়ার মতন গানের সঙ্গে সঙ্গে সুর করিতেছেন। বৈষ্ণবচরণকে বলিতেছেন, ওইরকম করে বলো – কীর্তনিয়া ঢঙে।
বৈষ্ণবচরণ আবার গাইলেন:
শ্রীদুর্গানাম জপ সদা রসনা আমার।
দুর্গমে শ্রীদুর্গা বিনে কে করে নিস্তার ৷৷
দুর্গানাম তরী ভবার্ণব তরিবারে,
ভাসিতেছে, সেই তরী শ্রদ্ধাসরোবরে।
শ্রীগুরু করুণা করি যেই ধন দিলে,
সাধনা করহ তরী মিলিবে গো কূলে ৷৷
যদি বল ছয় রিপু হইয়ে পবন,
ধরিতে না দিবে তরী করিবে তুফান।
তুফানেতে কি করিবে শ্রীদুর্গানাম যার তরী,
তুমি স্বর্গ, তুমি মর্ত্য মা, তুমি সে পাতাল;
তোমা হতে হরি ব্রহ্মা দ্বাদশ গোপাল।
দশ মহাবিদ্যা মাতা দশ অবতার,
এবার কোনরূপে আমায় করিতে হবে পার ৷৷
চল অচল তুমি মা তুমি সূক্ষ্ম স্থূল,
সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় তুমি মা তুমি বিশ্বমূল।
ত্রিলোকজননী তুমি, ত্রিলোক তারিণী;
সকলের শক্তি তুমি মা তোমার শক্তি তুমি ৷৷
ঠাকুর গায়কের সঙ্গে পুনঃ পুনঃ গাহিতে লাগিলেন-
চল অচল তুমি মা তুমি সূক্ষ্ম স্থূল,
সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় তুমি মা তুমি বিশ্বমূল,
ত্রিলোকজননী তুমি, ত্রিলোক তারিণী;
সকলের শক্তি তুমি মা তোমার শক্তি তুমি ৷৷
কীর্তনীয়া আবার আরম্ভ করিলেন-
বায়ু অন্ধকার আদি শূন্য আর আকাশ,
রূপ দিক্ দিগন্তর তোমা হ’তে প্রকাশ।
ব্রহ্মা, বিষ্ণু আদি করি যতেক অমরে,
তব শক্তি প্রকাশিছে সকল শরীরে ৷৷
ইড়া পিঙ্গলা সুষুম্না বজ্রা চিত্রিণীতে,
ক্রমযোগে আছে জেগে সহস্রা হইতে।
চিত্রিণীর মধ্যে ঊর্ধ্বে আছে পদ্ম সারি সারি,
শুক্লবর্ণ সুবর্ণবর্ণ বিদ্যুতাদি করি ৷৷
দুই পদ্ম প্রস্ফুটিত একপদ্ম কোঢ়া,
অধোমুখে ঊর্ধ্ব মুখে আছে দুই পদ্ম জোড়া।
হংসরূপে বিহার তথায় কর গো আপনি,
আধার কমলে হও মা কুলকুণ্ডলিনী ৷৷
তদূর্ধ্বে মণিপুর নাম নাভিস্থল,
রক্তবর্ণ পদ্ম তাহে আছে দশদল।
সেই পদ্মে তব শক্তি অনল আছয়,
সে অনল নিবৃত্তি হ’লে সকলই নিভায় ৷৷
হৃদিপদ্মে আছে মানস সরোবর,
অনাহত পদ্ম ভাসে তাহার উপর।
সুবর্ণবর্ণ দ্বাদশদল তথায় শিব বাণ,
যেই পদ্মে তব শক্তি জীব আর আণ ৷৷
তদূর্ধ্বে কণ্ঠদেশ ধুম্রবর্ণ পদ্ম,
ষোড়শদল নাম তাঁর পদ্ম বিশুদ্ধাখ্য।
সেই পদ্মে তব শক্তি আছয়ে আকাশ,
সে আকাশ রুদ্ধ হঞ্চলে সকলি আকাশ ৷৷
তদূর্ধে শিরসি মধ্যে পদ্ম সহস্রদল,
গুরুদেবের স্থান সেই অতি গুহ্য স্থল।
সেই পদ্মে বিম্বরূপে পরমশিব বিরাজে,
একা আছেন শুক্লবর্ণ সহস্রদল পঙ্কজে ৷৷
ব্রহ্মরন্ধ্র আছে যথা শিব বিম্বরূপ,
তুমি তথা গেলে, শিব হন স্বীয়রূপ।
তথাশিবসঙ্গে রঙ্গে কর গো বিহার,
বিহার সমাপনে শিব হন বিম্বাকার ৷৷
-১৮৮৪, ১লা অক্টোবর-
……………
রামকৃষ্ণ কথামৃত : ত্রিংশ অধ্যায় : দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….