ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

ঠাকুরের সমাধি ও জগন্মাতার সহিত কথা – প্রেমতত্ত্ব

এই গান গাহিতে গাহিতে ঠাকুর সমাধিস্থ হইলেন। ভক্তেরা সকলে নিস্তব্ধ হইয়া দর্শন করিতেছেন। কিয়ৎক্ষণ পরে কিঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ হইয়া মার সঙ্গে কথা কহিতেছেন।

“মা, উপর থেকে (সহস্রার থেকে?) এইখানে নেমে এস! – কি জ্বালাও! – চুপ করে বস!

“মা, যার যা (সংস্কার) আছে, তাই তো হবে! – আমি আর এদের কি বলব! বিবেক-বৈরাগ্য না হলে কিছু হয় না।

“বৈরাগ্য অনেকপ্রকার। একরকম আছে মর্কটবৈরাগ্য! – সংসারের জ্বালায় জ্বলে বৈরাগ্য – সে বৈরাগ্য বেশিদিন থাকে না। আর ঠিক ঠিক বৈরাগ্য – সব আছে, কিছুর অভাব নাই, অথচ সব মিথ্যাবোধ।

“বৈরাগ্য একেবারে হয় না। সময় না হলে হয় না। তবে একটি কথা আছে – শুনে রাখা ভাল। সময় যখন হবে তখন মনে হবে – ও! সেই শুনেছিলাম!

“আর একটি কথা। এ-সব কথা শুনতে শুনতে বিষয়বাসনা একটু একটু করে কমে। মদের নেশা কমাবার জন্য একটু একটু চালুনির জল খেতে হয়। তাহলে ক্রমে ক্রমে নেশা ছুটতে থাকে।

“জ্ঞানলাভের অধিকারী বড়ই কম। গীতায় বলেছে – হাজার হাজার লোকের ভিতর একজন তাঁকে জানতে ইচ্ছা করে। আবার যারা জানতে ইচ্ছা করে, সেইরূপ হাজার হাজার লোকের ভিতর একজন জানতে পারে।”

তান্ত্রিকভক্ত – ‘মনুষ্যাণাং সহস্রেষু কশ্চিৎ যততি সিদ্ধয়ে’ ইত্যাদি।

শ্রীরামকৃষ্ণ – সংসারে আসক্তি যত কমবে, ততই জ্ঞান বাড়বে। কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি।

সাধুসঙ্গ, শ্রদ্ধা, নিষ্ঠা, ভক্তি, ভাব, মহাভাব, প্রেম

“প্রেম সকলের হয় না। গৌরাঙ্গের হয়েছিল। জীবের ভাব হতে পারে – এই পর্যন্ত। ঈশ্বরকোটির – যেমন অবতার আদির – প্রেম হয়। প্রেম জলে জগৎ মিথ্যা তো বোধ হইবেই, আবার শরীর যে এত ভালবাসার জিনিস, তা ভুল হয়ে যায়!

“পার্শী বইয়ে (হাফেজে) আছে, চামড়ার ভিতর মাংস, মাংসের ভিতর হাড়, হাড়ের ভিতর মজ্জা, তারপরে আরও কত কি! সকলের ভিতর প্রেম।

“প্রেমে কোমল, নরম হয়ে যায়। প্রেমে, কৃষ্ণ ত্রিভঙ্গ হয়েছেন।

“প্রেম হলে সচ্চিদানন্দকে বাঁধবার দড়ি পাওয়া যায়। যাই দেখতে চাইবে দড়ি ধরে টানলেই হয়। যখন ডাকবে তখন পাবে।

“ভক্তি পাকলে ভাব। ভাব হলে সচ্চিদানন্দকে ভেবে অবাক্‌ হয় যায়। জীবের এই পর্যন্ত। আবার ভাব পাকলে মহাভাব, – প্রেম। যেমন কাঁচা আম আর পাকা আম।

“শুদ্ধাভক্তিই সার, আর সব মিথ্যা!

“নারদ স্তব করাতে বললেন, তুমি বর লও। নারদ চাইলেন, শুদ্ধাভক্তি। আর বললেন – রাম, যেন তোমার জগৎমোহিনী মায়ার মুগ্ধ না হই! রাম বললেন, ও তো হল, আর কিছু বর লও।

“নারদ বললেন, আর কিছু চাই না, কেবল ভক্তি!

“এই ভক্তি কিরূপে হয়? প্রথমে সাধুসঙ্গ করতে হয়। সাধুসঙ্গ করলে ঈশ্বরীয় বিষয়ে শ্রদ্ধা হয়। শ্রদ্ধার পর নিষ্ঠা, ঈশ্বরকথা বই আর কিছু শুনতে ইচ্ছা করে না; তাঁরই কাজ করতে ইচ্ছা করে।

“নিষ্ঠার পর ভক্তি। তারপর ভাব, – মহাভাব, প্রেম – বস্তুলাভ।

“মহাভাব, প্রেম, অবতার আদির হয়। সংসারী জীবের জ্ঞান, ভক্তের জ্ঞান, আর অবতারের জ্ঞান সমান নয়। সংসারী জীবের জ্ঞান যেন প্রদীপের আলো, – শুধু ঘরের ভিতরটি দেখা যায়। সে জ্ঞানে খাওয়া-দাওয়া, ঘর করা, শরীররক্ষা, সন্তানপালন – এই সব হয়।

“ভক্তের জ্ঞান, যেন চাঁদের আলো। ভিতর বার দেখা যায়, কিন্তু অনেক দূরের জিনিস, কি খুব ছোট জিনিস, দেখা যায় না। অবতার আদির জ্ঞান যেন সূর্যের আলো। ভিতর বার, ছোট বড় – তাঁরা সব দেখতে পান।

“তবে সংসারী জীবের মন ঘোলা জল হয়ে আছে বটে, কিন্তু নির্মলি ফেললে আবার পরিষ্কার হতে পারে। বিবেক-বৈরাগ্য নির্মলি।”

এইবার ঠাকুর শিবপুরের ভক্তদের সহিত কথা কহিতেছেন।

ঈশ্বরকথা শ্রবণের প্রয়োজন। “সময়-সাপেক্ষ”। ঠাকুরের সহজাবস্থা

শ্রীরামকৃষ্ণ – আপনাদের কিছু জিজ্ঞাসা থাকে বলো।

ভক্ত – আজ্ঞা, সব তো শুনলাম।

শ্রীরামকৃষ্ণ – শুনে রাখা ভাল, কিন্তু সময় না হলে হয় না।

“যখন খুব জ্বর, তখন কুনাইন দিলে কি হবে? ফিবার মিকশ্চার দিয়ে বাহ্যে-টাহ্যে হয়ে একটু কম পড়লে তখন কুনাইন দিতে হয়। আবার কারু কারু অমনি সেরে যায়, কুনাইন না দিলেও হয়।

“ছেলে ঘুমবার সময় বলেছিল, ‘মা আমার যখন হাগা পাবে তখন তুলো।’ মা বললে, ‘বাবা, আমায় তুলতে হবে না, হাগায় তোমায় তুলবে।’

“কেউ কেউ এখানে আসে দেখি, কোন ভক্তসঙ্গে নৌকা করে এসেছে। ঈশ্বরীয় কথা তাদের ভাল লাগে না। কেবল বন্ধুর গা টিপছে, ‘কখন যাবে, কখন যাবে?’ যখন বন্ধু কোনরকমর উঠলো না, তখন বলে, ‘তবে ততক্ষণ আমি নৌকায় গিয়ে বসে থাকি।’

“যাদের প্রথম মানুষ জন্ম, তাদের ভোগের দরকার। কতকগুলো কাজ করা না থাকলে চৈতন্য হয় না।”

ঠাকুর ঝাউতলায় যাইবেন। গোল বারান্দায় মাস্টারকে বলিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – আচ্ছা, আমার কিরকম অবস্থা।?

মাস্টার (সহাস্যে) – আজ্ঞা, আপনার উপরে সহজাবস্থা – ভিতর গভীর। – আপনার অবস্থা বোঝা ভারী কঠিন!

শ্রীরাককৃষ্ণ (সহাস্যে) – হাঁ; যেমন floor করা মেঝে, লোকে উপরটাই দেখে, মেঝের নিচে কত কি আছে, জানে না!

চাঁদনির ঘাটে বলরাম প্রভৃতি কয়েকটি ভক্ত কলিকাতা যাইবার জন্য নৌকা আরোহন করিতেছেন। বেলা চারিটা বাজিয়াছে। ভাটা পড়িয়াছে, তাহাতে দক্ষিণে হাওয়া। গঙ্গাবক্ষ তরঙ্গমালায় বিভূষিত হইয়াছে।

বলরামের নৌকা বাগবাজার অভিমুখে চলিয়া যাইতেছে, মাস্টার অনেকক্ষণ ধরিয়া দেখিতেছেন।

নৌকা অদৃশ্য হইলে তিনি আবার ঠাকুরের কাছে আসিলেন।

ঠাকুর পশ্চিম বারান্দা হইতে নামিতেছেন – ঝাউতলায় যাইবেন। উত্তর-পশ্চিমে সুন্দর মেঘ হইয়াছে। ঠাকুর বলিতেছেন, বৃষ্টি হবে কি, ছাতাটা আনো দেখি। মাস্টার ছাতা আনিলেন। লাটুও সঙ্গে আছেন।

ঠাকুর পঞ্চবটীতে আসিয়াছেন। লাটুকে বলিতেছেন – ‘তুই রোগা হয়ে যাচ্ছিস কেন?’

লাটু – কিছু খেতে পারি না!

শ্রীরামকৃষ্ণ – কেবল কি ওই – সময় খারাপ পড়েছে – আর বেশি ধ্যান করিস বুঝি?

ঠাকুর মাস্টারের সহিত কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – তোমার ওইটে ভার রইল। বাবুরামকে বলবে, রাখাল গেলে দুই-একদিন মাঝে মাঝে এসে থাকবে। তা না হলে আমার মন ভারী খারাপ হবে।

মাস্টার – যে আজ্ঞা, আমি বলব।

সরল হইলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। ঠাকুর জিজ্ঞাসা করিতেছেন, বাবুরাম সরল কি না!

ঝাউতলা ও পঞ্চবটীতে শ্রীরামকৃষ্ণের সুন্দর রূপ দর্শন

ঠাকুর ঝাউতলা হইতে দক্ষিণাস্য হইয়া আসিতেছেন। মাস্টার ও লাটু পঞ্চবটীতলায় দাঁড়াইয়া উত্তরাস্য হইয়া দেখিতেছেন।

ঠাকুরের পশ্চাতে নবীন মেঘ গগনমণ্ডল সুশোভিত করিয়া জাহ্নবী-জলে প্রতিবিম্বিত হইয়াছে – তাহাতে গঙ্গাজলে কৃষ্ণবর্ণ দেখাইতেছে।

ঠাকুর আসিতেছেন – যেন সাক্ষাৎ ভগবান দেহধারণ করিয়া মর্ত্যলোকে ভক্তের জন্য কলুষবিনাশিনী হরিপাদাম্বুজসম্ভূতা সুরধুনীর তীরে বিচরণ করিতেছেন। সাক্ষাৎ তিনি উপস্থিত। – তাই কি বৃক্ষ, লতা, গুল্ম, উদ্যানপথ, দেবালয়, ঠাকুর-প্রতিমা, সেবকগণ, দৌবারিকগণ, প্রত্যেক ধূলিকণা, এত মধুর হইতেছে!

-১৮৮৪, ৩রা অগস্ট-

………………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : ত্রয়োবিংশ অধ্যায় : দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!