ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও কামিনী – সন্ন্যাসীর কঠিন নিয়ম
[পূর্বকথা – শ্বশুরঘর যাবার সাধ – উলোর বামনদাসের সঙ্গে দেখা ]
সাধুরা দর্শন করিয়া চলিয়া গেলেন।
ঠাকুর ও বাবুরাম, মাস্টার, মুখুজ্জেদের হরি প্রভৃতি ভক্তেরা ঘরে ও বারান্দায় বেড়াইতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারকে) – নবীন সেনের ওখানে তুমি গিছলে?
মাস্টার – আজ্ঞা, গিছলাম। নিচে বসে সব গান শুনেছিলাম।
শ্রীরামকৃষ্ণ – তা বেশ করেছ। তোমার ওরা গিছল। কেশব সেন ওদের খুড়তাতো ভাই?
মাস্টার – একটু তফাত আছে।
শ্রীযুক্ত নবীন সেনেরা একজন ভক্তের শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কীয় লোক।
মণির সহিত বেড়াইতে বেড়াইতে ঠাকুর নিভৃতে কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – লোকে শ্বশুরবাড়ি যায়। এত ভেবেছিলুম, বিয়ে করব, শ্বশুরঘর যাব – সাধ আহ্লাদ করব! কি হয়ে গেল!
মণি – আজ্ঞা, ‘ছেলে যদি বাপকে ধরে, সে পড়তে পারে; বাপ যে ছেলেকে ধরেছেন সে আর পড়ে না।’ – এই কথা আপনি বলেন। আপনারও ঠিক সেই অবস্থা। মা আপনাকে ধরে রয়েছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – উলোর বামনদাসের সঙ্গে – বিশ্বাসদের বাড়িতে – দেখা হল। আমি বললাম, আমি তোমাকে দেখতে এসেছি। যখন চলে এলাম, শুনতে পেলাম, সে বলছে, ‘বাবা, বাঘ যেমন মানুষকে ধরে, তেমনই ঈশ্বরী এঁকে ধরে রয়েছেন!’ তখন সমর্থ বয়স – খুব মোটা। সর্বদাই ভাবে!
“আমি মেয়ে বড় ভয় করি। দেখি যেন বাঘিনী খেতে আসছে! আর অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ, ছিদ্র সব খুব বড় বড় দেখি। সব রাক্ষসীর মতো দেখি।
“আগে ভারী ভয় ছিল! কারুকে কাছে আসতে দিতাম না। এখন তবু অনেক করে মনকে বুঝিয়ে, মা আনন্দময়ীর এক-একটি রূপ বলে দেখি।
“ভগবতীর অংশ। কিন্তু পুরুষের পক্ষে – সাধুর পক্ষে – ভক্তের পক্ষে – ত্যাজ্য।
“হাজার ভক্ত হলেও মেয়েমানুষকে বেশিক্ষণ কাছে বসতে দিই না। একটু পরে, হয়ে বলি, ঠাকুর দেখো গে যাও; তাতেও যদি না উঠে, তামাক খাবার নাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি।
“দেখতে পাই, কারু কারু মেয়েমানুষের দিকে আদপে মন নাই। নিরঞ্জন বলে, ‘কই আমার মেয়েমানুষের দিকে মন নাই’।”
হরিবাবু, নিরঞ্জন, পাঁড়ে খোট্টা, জয়নারায়ণ
“হরি (উপেন ডাক্তারের ভাই)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, সে বলে, ‘না, মেয়েমানুষের দিকে মন নাই।’
“যে মন ভগবানকে দিতে হবে, সে মনের বারো আনা মেয়েমানুষ নিয়ে ফেলে। তারপর তার ছেলে হলে প্রায় সব মনটাই খরচ হয়ে যায়। তাহলে ভগবানকে আর কি দেবে?
“আবার কারু কারু তাকে আগলাতে আগলাতেই প্রাণ বেরিয়ে যায়। পাঁড়ে জমাদার খোট্টা বুড়ো – তার চৌদ্দ বছরের বউ! বুড়োর সঙ্গে তার থাকতে হয়! গোলপাতার ঘর। গোলপাতা খুলে খুলে লোক দেখে। এখন মেয়েটা বেরিয়ে এসেছে।
“একজনের বউ – কোথায় রাখে এখন ঠিক পাচ্ছে না। বাড়িতে বড় গোল কয়েছিল। মহা ভাবিত। সে কথা আর কাজ নাই।
“আর মেয়েমানুষের সঙ্গে থাকলেই তাদের বশ হয়ে যেতে হয়। সংসারীরা মেয়েদের কথায় উঠতে বললে উঠে, বসতে বললে বসে। সকলেই আপনার পরিবারদের সুখ্যাত করে।
“আমি একজায়গায় যেতে চেয়েছিলাম। রামলালের খুড়ীকে জিজ্ঞাসা করাতে বারণ করলে, আর যাওয়া হল না। খানিক পরে ভাবলুম – উঃ, আমি সংসার করি নাই, কামিনী-কাঞ্চনত্যাগী, তাতেই এই! – সংসারীরা না জানি পরিবারদের আছে কিরকম বশ!”
মণি – কামিনী-কাঞ্চনের মাঝখানে থাকলেই একটু না একটু গায়ে আঁচ লাগবেই। আপনি বলেছিলেন, জয়নারায়ণ অতো পণ্ডিত – বুড়ো হয়েছিল – আপনি যখন গেলেন, বালিস-টালিস শুকুতে দিচ্ছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – কিন্তু পণ্ডিত বলে অহংকার ছিল না। আর যা বলেছিল, শেষে আইন মাফিক্ কাশীতে গিয়ে বাস হল।
“ছেলেগুনো দেখলাম, বুট পায়ে দেওয়া ইংরাজী পড়া।”
ঠাকুরের প্রেমোন্মাদ প্রভৃতি নানা অবস্থা
ঠাকুর মণিকে প্রশ্নচ্ছলে নিজের অবস্থা বুঝাইতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – আগে খুব উন্মাদ ছিল, এখন কমলো কেন? – কিন্তু মাঝে মাঝে হয়।
মণি – আপনার একরকম অবস্থা তো নয়। যেমন বলেছিলেন, কখনও বালকবৎ – কখনও উন্মাদবৎ – কখনও জড়বৎ – কখনও পিশাচবৎ – এই সব অবস্থা মাঝে মাঝে হয়। আবার মাঝে মাঝে সহজ অবস্থাও হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ, বালকবৎ। আবার ওই সঙ্গে বাল্য, পৌগণ্ড, যুবা – এ-সব অবস্থা হয়। যখন জ্ঞান উপদেশ দেবে, তখন যুবার অবস্থা।
“আবার পৌগণ্ড অবস্থা! বারো-তেরো বছরের ছোকরার মতো ফচকিমি করতে ইচ্ছা হয়। তাই ছোকরাদের নিয়ে ফষ্টিনাষ্টি হয়।”
নারাণের গুণ – কামিনী-কাঞ্চনত্যাগই সন্ন্যাসীর কঠিন সাধনা
“আচ্ছা, নারাণ কেমন?”
মণি – আজ্ঞা, লক্ষণ সব ভাল আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ – নাউ-এর ডোলটা ভাল – তানপুরা বেশ বাজবে।
“সে আমায় বলে, আপনি সবই (অর্থাৎ অবতার) । যার যা ধারণা, সে তাই বলে। কেউ বলে, এমনি শুধু সাধুভক্ত।
“যেটি বারণ করে দিয়েছি, সেটি বেশ ধারণা করে। পরদা গুটোতে বললাম। তা গুটোলে না।
“গেরো দেওয়া, সেলাই করা, পরদা গুটোনো, দোর বাস্ক চাবি দিয়ে বন্ধ করা – এসব বারণ করেছিলাম – তাই ঠিক ধারণা। যে ত্যাগ করবে, তার এই সব সাধন করতে হয়। সন্ন্যাসীর পক্ষে এই সব সাধন।
“সাধনের অবস্থায় ‘কামিনী’ দাবানল স্বরূপ – কালসাপের স্বরূপ। সিদ্ধ অবস্তায় ভগবানদর্শনের পর – তবে মা আনন্দময়ী! তবে মার এক-একটি রূপ বলে দেখবে।”
কয়েকদিন হইল, ঠাকুর নারাণকে কামিনী সম্বন্ধে অনেক সতর্ক করেছিলেন। বলেছিলেন – ‘মেয়েমানুষের গায়ের হাওয়া লাগাবে না; মোটা কাপড় গায়ে দিয়ে থাকবে, পাছে তাদের হাওয়া গায় লাগে; – আর মা ছাড়া সকলের সঙ্গে আটহাত, নয় দুহাত, নয় অন্ততঃ একহাত সর্বদা তফাত থাকবে।”
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) – তার মা নারাণকে বলেছে, তাঁকে দেখে আমরাই মুগ্ধ হই, তুই তো ছেলেমানুষ! আর সরল না হলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। নিরঞ্জন কেমন সরল!
মণি – আজ্ঞা, হাঁ।
নিরঞ্জন, নরেন্দ্র কি সরল?
শ্রীরামকৃষ্ণ – সেদিন কলকাতা যাবার সময় গাড়িতে দেখলে না? সব সময়েই এক ভাব – সরল। লোক ঘরের ভিতর একরকম আবার বাড়ির বাহিরে গেলে আর-একরকম হয়! নরেন্দ্র এখন (বাপের মৃত্যুর পর) সংসারের ভাবনায় পড়েছে। ওর একটু হিসাব বুদ্ধি আছে। সব ছোকরা এদের মতো কি হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ নবীন নিয়োগীর বাড়ি – নীলকণ্ঠের যাত্রা
“নীলকণ্ঠের যাত্রা আজ শুনতে গিছলাম – দক্ষিণেশ্বরে। নবীন নিয়োগীর বাড়ি। সেখানকার ছোঁড়াগুলো বড় খারাপ। কেবল এর নিন্দা, ওর নিন্দা! ওরকম স্থলে ভাব সম্বরণ হয়ে যায়।
“সেবার যাত্রার সময় মধু ডাক্তারের চক্ষে ধারা দেখে, তার দিকে চেয়েছিলাম। আর কারু দিকে তাকাতে পারলাম না।”
-১৮৮৪, ৫ই অক্টোবর-
……………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : দ্বাত্রিংশ অধ্যায় : তৃতীয় পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….