ভবঘুরেকথা
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব

বেলঘরের ভক্তকে শিক্ষা – ব্যাকুল হয়ে আর্জি কর – ঠিক ভক্তের লক্ষণ

বেলঘরের ভক্ত – আপনি আমাদের কৃপা করুন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – সকলের ভিতরই তিনি রয়েছেন। তবে গ্যাস কোম্পানিকে আর্জি কর। তোমার ঘরের সঙ্গে যোগ হয়ে যাবে।

“তবে ব্যাকুল হয়ে আর্জি (Prayer) করতে হয়। এমনি আছে, তিন টান একসঙ্গে হলে ঈশ্বরদর্শন হয়। ‘সন্তানের উপর মায়ের টান, সতী স্ত্রীর স্বামীর উপর টান, আর বিষয়ীর বিষয়ের উপর টান।’

“ঠিক ভক্তের লক্ষণ আছে। গুরুর উপদেশ শুনে স্থির হয়ে থাকে। বেহুলার কাছে জাতসাপ স্থির হয়ে শুনে, কিন্তু কেউটে নয়। আর-একটি লক্ষণ – ঠিক ভক্তের ধারণা শক্তি হয়। শুধু কাচের উপর ছবির দাগ পড়ে না, কিন্তু কালি মাখানো কাচের উপর ছবি উঠে, যেমন ফটোগ্রাফ; ভক্তিরূপ কালি।

“আর-একটি লক্ষণ। ঠিক ভক্ত জিতেন্দ্রিয় হয়, কামজয়ী হয়। গোপীদের কাম হত না।

“তা তোমরা সংসারে আছ তাহলেই বা; এতে সাধনের আরও সুবিধা, যেমন কেল্লা থেকে যুদ্ধ করা। যখন শবসাধন করে, মাঝে মাঝে শবটা হাঁ করে ভয় দেখায়। তাই চাল, ছোলাভাজা রাখতে হয়। তার মুখে মাঝে মাঝে দিতে হয়। শবটা ঠাণ্ডা হলে, তবে নিশ্চিন্ত হয়ে জপ করতে পারবে। তাই পরিবারদের ঠাণ্ডা রাখতে হয়। তাদের খাওয়া-দাওয়ার যোগাড় করে দিতে হয়, তবে সাধন-ভজনের সুবিধা হয়।

“যাদের ভোগ একটু বাকী আছে, তারা সংসারে থেকেই তাঁকে ডাকবে। নিতাই-এর ব্যবস্থা ছিল, মাগুর মাছের ঝোল, ঘোর যুবতীর কোল, বোল হরি বোল।

“ঠিক ঠিক ত্যাগীর আলাদা কথা; মৌমাছি ফুল বই আর কিছুতেই বসবে না। চাতকের কাছে ‘সব জল ধুর’; কোন জল খাবে না কেবল স্বাতী-নক্ষত্রের বৃষ্টির জন্য হাঁ করে আছে। ঠিক ঠিক ত্যাগী অন্য কোন আনন্দ নেবে না, কেবল ঈশ্বরের আনন্দ। মৌমাছি কেবল ফুলে বসে। ঠিক ঠিক ত্যাগী সাধু যেন মৌমাছি। গৃহীভক্ত যেন এই সব মাছি – সন্দেশেও বসে, আবার পচা ঘায়েও বসে।

“তোমরা এত কষ্ট করে এখানে এসেছ, তোমরা ঈশ্বরকে খুঁজে বেড়াচ্ছ। সব লোক বাগান দেখেই সন্তুষ্ট, বাগানের কর্তার অনুসন্ধান করে দু-একজন। জগতের সৌন্দর্যই দেখে, কর্তাকে খোঁজে না।”

[হঠযোগ, রাজযোগ ও বেলঘরের ভক্ত – ষড়চক্র ভেদ ও সমাধি ]

(গায়ককে দেখাইয়া) – ইনি ষড়চক্রের গান গাইলেন। সে-সব যোগের কথা। হঠযোগ আর রাজযোগ। হঠযোগী শরীরের কতকগুলো কসরৎ করে; উদ্দেশ্য – সিদ্ধাই, দীর্ঘ আয়ু হবে, অষ্টসিদ্ধি হবে; এই সব উদ্দেশ্য। রাজযোগের উদ্দেশ্য – ভক্তি, প্রেম, জ্ঞান, বৈরাগ্য। রাজযোগই ভাল।

“বেদান্তের সপ্তভূমি, আর যোগশাস্ত্রের ষড়চক্র অনেক মেলে। বেদের প্রথম তিনভূমি, আর ওদের মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর। এই তিন ভূমিতে গুহ্য, লিঙ্গ, নাভির মনের বাস। মন যখন চতুর্থভূমিতে উঠে অর্থাৎ অনাহত পদ্মে, জীবাত্মাকে তখন শিখার ন্যায় দর্শন হয়, আর জ্যোতিঃদর্শন হয়। সাধক বলে, ‘এ কি! এ কি!’

“পঞ্চভূমিতে মন উঠলে, কেবল ঈশ্বরের কথাই শুনতে ইচ্ছা হয়। এখানে বিশুদ্ধচক্র। ষষ্ঠভূমি আর আজ্ঞাচক্র এক। সেখানে মন গেলে ঈশ্বরদর্শন হয়। কিন্তু যেমন লণ্ঠনের ভিতর আলো – ছুঁতে পারে না, মাঝে কাচ ব্যবধান আছে বলে।

“জনক রাজা পঞ্চভূমি থেকে ব্রহ্মজ্ঞানের উপদেশ দিতেন। তিনি কখনও পঞ্চমভূমি, কখনও ষষ্ঠভূমিতে থাকতেন।

“ষড়চক্র ভেদের পর সপ্তমভূমি। মন সেখানে গেলে মনের লয় হয়। জীবাত্মা পরমাত্মা এক হয়ে যায় – সমাধি হয়। দেহবুদ্ধি চলে যায়, বাহ্যশূন্য হয়; নানা জ্ঞান চলে যায়; বিচার বন্ধ হয়ে যায়।

“ত্রৈলঙ্গ স্বামী বলেছিল, বিচারে অনেক বোধ হচ্ছে; নানা বোধ হচ্ছে। সমাধির পর শেষে একুশদিনে মৃত্যু হয়।

“কিন্তু কুলকুণ্ডলিনী জাগরণ না হলে চৈতন্য হয় না!”

[ঈশ্বরদর্শনের লক্ষণ ]

“যে ঈশ্বরলাভ করেছে, তার লক্ষণ আছে। সে হয়ে যায় – বালকবৎ, উন্মাদবৎ, জড়বৎ, পিশাচবৎ। আর তার ঠিক বোধ হয় ‘আমি যন্ত্র আর তিনি যন্ত্রী; তিনিই কর্তা, আর সকলেই অকর্তা।’ শিখরা যেমন বলেছিল, পাতাটি নড়ছে সেও ঈশ্বরের ইচ্ছা। রামের ইচ্ছাতেই সব হচ্ছে – এই বোধ।

তাঁতী যেমন বলেছিল, রামের ইচ্ছাতেই কাপড়ের দাম এক টাকা ছয় আনা, রামের ইচ্ছাতেই ডাকাতি হল; রামের ইচ্ছাতেই ডাকাত ধরা পড়ল। রামের ইচ্ছাতেই আমাকে পুলিশে নিয়ে গেল, আবার রামের ইচ্ছাতেই আমাকে ছেড়ে দিল।”

সন্ধ্যা আগত প্রায়। ঠাকুর একবারও বিশ্রাম করেন নাই। ভক্তসঙ্গে অবিশ্রান্ত হরিকথা হইতেছে। এইবার মণিরামপুর ও বেলঘরের ভক্তেরা ও অন্যান্য ভক্তেরা তাঁহাকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া, ঠাকুরবাড়িতে ঠাকুরদের দর্শন করিয়া নিজ নিজ স্থানে প্রত্যাগমন করিতেছেন।

-১৮৮৩, ১০ই জুন-

………………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : দ্বাদশ অধ্যায় : একাদশ পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!