বলরামের বাড়ি, শশধর প্রভৃতি ভক্তগণ – ঠাকুরের সমাধি
শ্রীযুক্ত শশধর দু-একটি বন্ধু সঙ্গে ঘরে প্রবেশ করিলেন ও ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া উপবিষ্ট হিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – আমরা সকলে বাসকসজ্জা জেগে আছি – কখন বর আসবে!
পণ্ডিত হাসিতেছেন। ভক্তের মজলিস। বলরামের পিতাঠাকুর উপস্থিত আছেন। ডাক্তার প্রতাপও আসিয়াছেন। ঠাকুর আবার কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (শশধরের প্রতি) – জ্ঞানের চিহ্ন, প্রথম – শান্ত স্বভাব; দ্বিতীয় – অভিমানশূন্য স্বভাব। তোমার দুই লক্ষণই আছে।
“জ্ঞানীর আর কতকগুলি লক্ষণ আছে। সাধুর কাছে ত্যাগী, কর্মস্থলে – যেমন লেকচার দিবার সময় – সিংহতুল্য, স্ত্রীর কাছে রসরাজ, রসপণ্ডিত। (পণ্ডিত ও অন্যান্য সকলের হাস্য)
“বিজ্ঞানীর স্বভাব আলাদা। যেমন চৈত্যদেবের অবস্থা। বালকবৎ, উন্মাদবৎ, জড়বৎ, পিশাচবৎ।
“বালকের অবস্থার ভিতর আবার বাল্য, পৌগণ্ড, যৌবন! পৌগণ্ড অবস্থায় ফচকিমি। উপদেশ দিবার সময় যুবার ন্যায়।”
পণ্ডিত – কিরূপ ভক্তি দ্বারা তাঁকে পাওয়া যায়?
শশধর ও ভক্তিতত্ত্ব-কথা – জ্বলন্ত বিশ্বাস চাই – বৈষ্ণবদের দীনভাব
শ্রীরামকৃষ্ণ – প্রকৃতি অনুসারে ভক্তি তিনরকম! ভক্তির সত্ত্ব, ভক্তির রজঃ, ভক্তির তমঃ।
“ভক্তির সত্ত্ব – ঈশ্বরই টের পান। সেরূপ ভক্ত গোপন ভালবাসে, – হয়তো মশারির ভিতর ধ্যান করে, কেউ টের পায় না। সত্ত্বের সত্ত্ব – বিশুদ্ধ সত্ত্ব – হলে ঈশ্বরদর্শনের আর দেরি নাই; – যেমন অরুণোদয় হলে বুঝা যায় যে, সূর্যোদয়ের আর দেরি নাই।
“ভক্তির রজঃ যাদের হয়, তাদের একটু ইচ্ছা হয় – লোকে দেখুক আমি ভক্ত। সে ষোড়শোপচার দিয়ে পূজা করে, গরদ পরে ঠাকুরঘরে যায়, – গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, – মালায় মুক্তা, মাঝে মাঝে একটি সোনার রুদ্রাক্ষ।
“ভক্তির তমঃ – যেমন ডাকাতপড়া ভক্তি। ডাকাত ঢেঁকি নিয়ে ডাকাতি করে, আটটা দারোগার ভয় নাই, – মুখে ‘মারো! লোটো!’ উন্মাদের ন্যায় বলে – ‘হর, হর, হর; ব্যোম, ব্যোম! জয় কালী!’ মনে খুব জোর জ্বলন্ত বিশ্বাস!
“শাক্তদের ওইরূপ বিশ্বাস। – কি, একবার কালীনাম, দুর্গানাম করেছি – একবার রামনাম করেছি, আমার আবার পাপ!
“বৈষ্ণবদের বড় দীনহীনভাব। যারা কেবল মালা জপে, (বলরামের পিতাকে লক্ষ্য করিয়া) কেঁদে ককিয়ে বলে, ‘হে কৃষ্ণ দয়া কর, – আমি অধম, আমি পাপী!’
“এমন জ্বলন্ত বিশ্বাস চাই যে, তাঁর নাম করেছি আমার আবার পাপ! – রাতদিন হরিনাম করে, আমার বলে – আমার পাপ!’
কথা কহিতে কহিতে ঠাকুর প্রেমে উন্মত্ত হইয়া গান গাহিতেছেন-
আমি দুর্গা দুর্গা বলে মা যদি মরি।
আখেরে এ দীনে না তারো কেমনে, জানা যাবে গো শংকরী।।
নাশি গো ব্রাহ্মণ, হত্যা করি ভ্রূণ, সুরাপানাদি বিনাশী নারী।
এ-সব পাতক না ভাবি তিলেক, (ও মা) ব্রহ্মপদ নিতে পারি।।
গান – শিব সঙ্গে সদারঙ্গে আনন্দে মগনা।
সুধাপানে ঢল ঢল কিন্তু ঢলে পড়ে না মা!
গান শুনিয়া শশধর কাঁদিতেছেন।
দুর্গানাম জপ সদা রসনা আমার,
দুর্গমে শ্রীদুর্গা বিনে কে করে নিস্তার।
তুমি স্বর্গ তুমি মর্ত্য তুমি সে পাতাল,
তোমা হতে হরি ব্রহ্মা দ্বাদশ গোপাল।
দশমহাবিদ্যা মাতা দশ অবতার,
এবার কোনরূপে আমায় করিতে হবে পার।
চল অচল তুমি মা তুমি সূক্ষ্ম স্থূল,
সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় তুমি তুমি বিশ্বমূল।
ত্রিলোকজননী তুমি ত্রিলোকতারিণী,
সকলের শক্তি তুমি (মা গো) তোমার শক্তি তুমি।
এই কয় চরণ গান শুনিয়া ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়াছেন, গান সমাপ্ত হইলে ঠাকুর নিজে গান ধরিলেন-
যশোদা নাচাতো শ্যামা বলে নীলমণি,
সেরূপ লুকালে কোথা করালবদনী।
বৈষ্ণবচরণ এইবার কীর্তন গাইতেছেন। সুবোল-মিলন। যখন গায়ক আখর দিতেছেন – ‘রা বি ধা বেরোয় না রে!’ – ঠাকুর সমাধিস্থ হইলেন।
শশধর প্রেমাশ্রু বিসর্জন করিতেছেন।
-১৮৮৪, ৩রা জুলাই-
……………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : দ্বাবিংশ অধ্যায় : চতুর্থ পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….