ভাবরাজ্য ও রূপদর্শন
ঠাকুর সমাধিস্থ – অনেকক্ষণ ভাবাবিষ্ট হইয়া বসিয়া আছেন। দেহ নড়িতেছে না – চক্ষু স্পন্দহীন – নিঃশ্বাস পড়িতেছে কিনা – বুঝা যায় না।
অনেকক্ষণ পরে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন – যেন ইন্দ্রিয়ের রাজ্যে আবার ফিরিয়া আসিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (প্রাণকৃষ্ণের প্রতি) – তিনি শুধু নিরাকার নন, তিনি আবার সাকার। তাঁর রূপ দর্শন করা যায়। ভাব-ভক্তির দ্বারা তাঁর সেই অতুলনীয় রূপ দর্শন করা যায়। মা নানারূপে দর্শন দেন।
[গৌরাঙ্গদর্শন – রতির মা বেশে মা ]
“কাল মাকে দেখলাম। গেরুয়া জামা পরা, মুড়ি সেলাই নাই। আমার সঙ্গে কথা কচ্ছেন।
“আর-একদিন মুসলমানের মেয়েরূপে আমার কাছে এসেছিলেন। মাথায় তিলক কিন্তু দিগম্বরী। ছয় সাত বছরের মেয়ে – আমার সঙ্গে সঙ্গে বেড়াতে লাগল ও ফচকিমি করতে লাগল।
“হৃদের বাড়িতে যখন ছিলাম – গৌরাঙ্গদর্শন হয়েছিল – কালোপেড়ে কাপড় পরা।
“হলধারী বলত তিনি ভাব-অভাবের অতীত। আমি মাকে গিয়ে বললাম, মা, হলধারী এ-কথা বলছে, তাহলে রূপ-টুপ কি সব মিথ্যা? মা রতির মার বেশে আমার কাছে এসে বললে, ‘তুই ভাবেই থাক।’ আমিও হলধারীকে তাই বললাম।
“এক-একবার ও-কথা ভুলে যাই বলে কষ্ট হয়। ভাবে না থেকে দাঁত ভেঙে গেল। তাই দৈববাণী বা প্রতক্ষ্য না হলে ভাবেই থাকব – ভক্তি নিয়ে থাকব। কি বল?”
প্রাণকৃষ্ণ – আজ্ঞা
[ভক্তির অবতার কেন? রামের ইচ্ছা ]
শ্রীরামকৃষ্ণ – আর তোমাকেই বা কেন জিজ্ঞাসা করি। এর ভিতরে কে একটা আছে। সেই আমাকে নিয়ে এইরূপ কচ্ছে। মাঝে মাঝে দেবভাব প্রায় হত, – আমি পুজো না করলে শান্ত হতুম না।
“আমি যন্ত্র, তিনি যন্ত্রী। তিনি যেমন করান, তেমনি করি। যেমন বলান, তেমনি বলি।
প্রসাদ বলে ভবসাগরে, বসে আছি ভাসিয়ে ভেলা।
জোয়ার এলে উজিয়ে যাব, ভাটিয়ে যাব ভাটার বেলা ৷৷
ঝড়ের এঁটো পাতা কখনও উড়ে ভাল জায়গায় গিয়ে পড়ল, কখন বা ঝড়ে নর্দমায় গিয়ে পড়ল – ঝড় যেদিকে লয়ে যায়।
তাঁতী বললে, রামের ইচ্ছায় ডাকাতি হল, রামের ইচ্ছায় আমাকে পুলিসে ধরলে – আবার রামের ইচ্ছায় ছেড়ে দিলে।
হনুমান বলেছিল, হে রাম, শরণাগত, শরণাগত; – এই আশীর্বাদ কর যেন তোমার পাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি হয়। আর যেন তোমার ভুবনমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ না হই।
কোলা ব্যাঙ মুমূর্ষ অবস্থায় বললে, রাম, যখন সাপে ধরে তখন ‘রাম রক্ষা কর’ বলে চিৎকার করি। কিন্তু এখন রামের ধনুক বিঁধে মরে যাচ্ছি, তাই চুপ করে আছি।
আগে প্রত্যক্ষ দর্শন হতো – এই চক্ষু দিয়ে – যেমন তোমায় দেখছি। এখন ভাবাস্থায় দর্শন হয়।
ঈশ্বরলাভ হলে বালকের স্বভাব হয়। যে যাকে চিন্তা করে তার সত্তা পায়। ঈশ্বরের স্বভাব বালকের ন্যায়। বালক যেমন খেলাঘর করে, ভাঙে গড়ে – তিনিও সেইরূপ সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় কচ্ছেন। বালক যেমন কোনও গুণের বশ নয় – তিনিও তেমনি সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ তিন গুণের অতীত।
“তাই পরমহংসেরা দশ-পাঁচজন বালক সঙ্গে রাখে, স্বভাব আরোপের জন্য।”
আগরপাড়া হইতে একটি বিশ-বাইশ বছরের ছোকরা আসিয়াছেন। ছেলেটি যখন আসেন ঠাকুরকে ইশারা করিয়া নির্জনে লইয়া যান ও চুপি চুপি মনের কথা কন। তিনি নূতন যাতায়াত করিতেছেন। আজ ছেলেটি কাছে আসিয়া মেঝেতে বসিয়াছেন।
[প্রকৃতিভাব ও কামজয় – সরলতা ও ঈশ্বরলাভ ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (ছেলেটির প্রতি) – আরোপ করলে ভাব বদলে যায়। প্রকৃতিভাব আরোপ করলে ক্রমে কামাদি রিপু নষ্ট হয়ে যায়। ঠিক মেয়েদের মতন ব্যবহার হয়ে দাঁড়ায়। যাত্রাতে যারা মেয়ে সাজে তাদের নাইবার সময় দেখেছি – মেয়েদের মতো দাঁত মাজে, কথা কয়।
“তুমি একদিন শনি-মঙ্গলবারে এস।”
(প্রাণকৃষ্ণের প্রতি) – ব্রহ্ম ও শক্তি অভেদ। শক্তি না মানলে জগৎ মিথ্যা হয়ে যায়, আমি-তুমি, ঘরবাড়ি, পরিবার – সব মিথ্যা। ওই আদ্যাশক্তি আছেন বলে জগৎ দাঁড়িয়ে আছে। কাঠামোর খুঁটি না থাকলে কাঠামোই হয় না – সুন্দর দুর্গা ঠাকুর-প্রতিমা হয় না।
“বিষয়বুদ্ধি ত্যাগ না করলে চৈতন্যই হয় না – ভগবানলাভ হয় না – বিষয়বুদ্ধি থাকলেই কপটতা হয়। সরল না হলে তাঁকে পাওয়া যায় না –
এইসি ভক্তি কর ঘট ভিতর ছোড় কপট চতুরাই।
সেবা বন্দি আউর অধীনতা সহজে মিলি রঘুরাই ৷৷
“যারা বিষয়কর্ম করে – অফিসের কাজ কি ব্যবসা – তাদেরও সত্যেতে থাকা উচিত। সত্যকথা কলির তপস্যা।”
প্রাণকৃষ্ণ – অস্মিন্ ধর্মে মহেশি স্যাৎ সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয়ঃ।
পরোপকারনিরতো নির্বিকারঃ সদাশয়ঃ ৷৷
“মহানির্বাণতন্ত্রে এরূপ আছে।”
শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ, ওইগুলি ধারণা করতে হয়।
-১৮৮৩, ১লা জানুয়ারি-
………………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : নবম অধ্যায় : দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….