অভ্যাসযোগ – দুই পথ – বিচার ও ভক্তি
বেলা ৩টা। মারোয়াড়ী ভক্তেরা মেঝেতে বসিয়া ঠাকুরকে প্রশ্ন করিতেছেন। মাস্টার, রাখাল ও অন্যান্য ভক্তেরা ঘরে আছেন।
মারোয়াড়ী ভক্ত – মহারাজ, উপায় কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ – দুইরকম আছে। বিচারপথ – আর অনুরাগ বা ভক্তির পথ।
“সৎ-অসৎ বিচার। একমাত্র সৎ বা নিত্যবস্তু ঈশ্বর, আর সমস্ত অসৎ বা অনিত্য। বাজিকরই সত্য, ভেলকি মিথ্যা। এইটি বিচার।
“বিবেক আর বৈরাগ্য। এই সৎ-অসৎ বিচারের নাম বিবেক। বৈরাগ্য অর্থাৎ সংসারের দ্রব্যের উপর বিরক্তি। এটি একবারে হয় না। – রোজ অভ্যাস করতে হয়। – তারপর তাঁর ইচ্ছায় মনের ত্যাগও করতে হয়, বাহিরের ত্যাগও করতে হয়। কলকাতার লোকদের বলবার জো নাই ‘ঈশ্বরের জন্য সব ত্যাগ কর’ – বলতে হয় ‘মনে ত্যাগ কর।’
“অভ্যাসযোগের দ্বারা কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি ত্যাগ করা যায়। গীতায় এ-কথা আছে। অভ্যাস দ্বারা মনে অসাধারণ শক্তি এসে পড়ে, তখন ইন্দ্রিয় সংযম করতে – কাম, ক্রোধ বশ করতে – কষ্ট হয় না। যেমন কচ্ছপ হাত-পা টেনে নিলে আর বাহির করে না; কুড়ুল দিয়ে চারখানা করে কাটলেও আর বাহির করে না।”
মারোয়াড়ী ভক্ত – মহারাজ, দুই পথ বললেন; আর-এক পথ কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ – অনুরাগের বা ভক্তির পথ। ব্যাকুল হয়ে একবার কাঁদ – নির্জনে, গোপনে – দেখা দাও বলে।
“ডাক দেখি মন ডাকার মতো কেমন শ্যামা থাকতে পারে!”
মারোয়াড়ী ভক্ত – মহারাজ, সাকারপূজার মানে কি? আর নিরাকার, নির্গুণ – এর মানেই বা কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ – যেমন বাপের ফটোগ্রাফ দেখলে বাপকে মনে পড়ে, তেমনি প্রতিমায় পূজা করতে করতে সত্যের রূপ উদ্দীপন হয়।
“সাকাররূপ কিরকম জান? যেমন জলরাশির মাঝ থেকে ভুড়ভুড়ি উঠে সেইরূপ। মহাকাশ চিদাকাশ থেকে এক-একটি রূপ উঠছে দেখা যায়। অবতারও একটি রূপ। অবতারলীলা সে আদ্যাশক্তিরই খেলা।”
[পাণ্ডিত্য – আমি কে? আমিই তুমি ]
“পাণ্ডিত্যে কি আছে? ব্যাকুল হয়ে ডাকলে তাঁকে পাওয়া যায়। নানা বিষয় জানবার দরকার নাই।
“যিনি আচার্য তাঁরই পাঁচটা জানা দরকার। অপরকে বধ করবার জন্য ঢাল-তরোয়াল চাই; আপনাকে বধ করবার জন্য একটি ছুঁচ বা নরুন হলেই হয়।
”আমি কে, এইটি খুঁজতে গেলে তাঁকেই পাওয়া যায়। আমি কি মাংস, না হাড়, না রক্ত, না মজ্জা – না মন, না বুদ্ধি? শেষে বিচারে দেখা যায় যে, আমি এ-সব কিছুই নয়। ‘নেতি’ ‘নেতি’। আত্মা ধরবার ছোঁবার জো নাই। তিনি নির্গুণ – নিরুপাধি।
“কিন্তু ভক্তি মতে তিনি সগুণ। চিন্ময় শ্যাম, চিন্ময় ধাম – সব চিন্ময়।”
মারোয়াড়ী ভক্তেরা প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।
[দক্ষিণেশ্বরে সন্ধ্যা ও আরতি ]
সন্ধ্যা হইল। ঠাকুর গঙ্গাদর্শন করিতেছেন। ঘরে প্রদীপ জ্বালা হইল, শ্রীরামকৃষ্ণ জগন্মাতার নাম করিতেছেন ও খাটটিতে উপবিষ্ট হইয়া তাঁহার চিন্তা করিতেছেন।
ঠাকুরবাড়িতে এইবার আরতি হইতেছে। যাঁহারা এখনও পোস্তার উপর বা পঞ্চবটী মধ্যে পাদচারণ করিতেছেন তাঁহারা দূর হইতে আরতির মধুর ঘন্টা-নিনাদ শুনিতেছেন। জোয়ার আসিয়াছে – ভাগীরথী কুলকুল শব্দ করিয়া উত্তরবাহিনী হইতেছেন। আরতির মধুর শব্দ কুলকুল শব্দের সহিত মিশ্রিত হইয়া আরও মধুর হইয়াছে। এই সকলের মধ্যে প্রেমোন্মত্ত ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বসিয়া আছেন। সকলই মধুর! হৃদয় মধুময়! মধু, মধু, মধু!
-১৮৮৩, ১লা জানুয়ারি-
…………………..
রামকৃষ্ণ কথামৃত : নবম অধ্যায় : পঞ্চম পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….