ব্রহ্ম ও শক্তি অভেদ – মানুষলীলা
এইবার কেশব উচ্চৈঃস্বরে বলছেন, “আমি এসেছি”, “আমি এসেছি!” এই বলিয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের বাম হাত ধারণ করিলেন ও সেই হাতে হাত বুলাইতে লাগিলেন। ঠাকুর ভাবে গরগর মাতোয়ারা। আপনা-আপনি কত কথা বলিতেছেন। ভক্তেরা সকলে হাঁ করিয়া শুনিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – যতক্ষণ উপাধি, ততক্ষণ নানা বোধ। যেমন কেশব, প্রসন্ন, অমৃত – এই সব। পূর্ণজ্ঞান হলে এক চৈতন্য-বোধ হয়।
“আবার পূর্ণজ্ঞানে দেখে যে, সেই এক চৈতন্য এই জীবজগৎ, এই চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়েছেন।
“তবে শক্তিবিশেষ। তিনিই সব হয়েছেন বটে, কিন্তু কোনখানে বেশি শক্তির প্রকাশ, কোনখানে কম শক্তির প্রকাশ।
“বিদ্যাসাগর বলেছিল, ‘তা ঈশ্বর কি কারুকে বেশি শক্তি, কারুকে কম শক্তি দিয়েছেন?’ আমি বললুম, ‘তা যদি না হতো, তাহলে একজন লোক পঞ্চাশজন লোককে হারিয়ে দেয় কেমন করে, আর তোমাকেই বা আমরা দেখতে এসেছি কেন?’
“তাঁর লীলা যে আধারে প্রকাশ করেন, সেখানে বিশেষ শক্তি।
“জমিদার সব জায়গায় থাকেন। কিন্তু অমুক বৈঠকখানায় তিনি প্রায় বসেন। ভক্ত তাঁর বৈঠকখানা। ভক্তের হদয়ে তিনি লীলা করতে ভালবাসেন। ভক্তের হৃদয়ে তাঁর বিশেষ শক্তি অবতীর্ণ হয়।
“তাঁর লক্ষণ কি? যেখানে কার্য বেশি, সেখানে বিশেষ শক্তির প্রকাশ।
“এই আদ্যাশক্তি আর পরব্রহ্ম অভেদ। একটিকে ছেড়ে আর-একটিকে চিন্তা করবার জো নাই। যেমন জ্যোতিঃ আর মণি! মণিকে ছেড়ে মণির জ্যোতিঃকে ভাববার জো নাই, আবার জ্যোতিঃকে ছেড়ে মণিকে ভাববার জো নাই। সাপ আর তির্যগ্গতি। সাপকে ছেড়ে তির্যগ্গতি ভাববার জো নাই, আবার সাপের তির্যগ্গতি ছেড়ে সাপকে ভাববার জো নাই।”
ব্রাহ্মসমাজ ও মানুষে ঈশ্বরদর্শন – সিদ্ধ ও সাধকের প্রভেদ
“আদ্যাশক্তিই এই জীবজগৎ, এই চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়েছেন। অনুলোম, বিলোম। রাখাল, নরেন্দ্র আর আর ছোকরাদের জন্য ব্যস্ত হই কেন? হাজরা বললে, তুমি ওদের জন্য ব্যস্ত হয়ে বেড়াচ্ছ; তা ঈশ্বরকে ভাববে কখন? (কেশব ও সকলের ঈষৎ হাস্য)
তখন মহা চিন্তিত হলুম। বললুম, মা একি হল। হাজরা বলে, ওদের জন্য ভাব কেন? তারপর ভোলানাথকে জিজ্ঞাসা করলুম। ভোলানাথ বললে, ভারতে১ ওই কথা আছে। সমাধিস্থ লোক সমাধি থেকে নেমে কোথায় দাঁড়াবে? তাই সত্ত্বগুণী ভক্ত নিয়ে থাকে। ভারতের এই নজির পেয়ে তবে বাঁচলুম! (সকলের হাস্য)
“হাজরার দোষ নাই। সাধক অবস্থায় সব মনটা ‘নেতি’ ‘নেতি’ করে তাঁর দিকে দিতে হয়। সিদ্ধ অবস্থায় আলাদা কথা, তাঁকে লাভ করবার পর অনুলোম বিলোম। ঘোল ছেড়ে মাখন পেয়ে, তখন বোধ হয়, ‘ঘোলেরই মাখন, মাখনেরই ঘোল।’ তখন ঠিক বোধ হয়, তিনিই সব হয়েছেন। কোনখানে বেশি প্রকাশ, কোনখানে কম প্রকাশ।
“ভাবসমুদ্র উথলালে ডাঙায় একবাঁশ জল। আগে নদী দিয়ে সমুদ্রে আসতে হলে এঁকেবেঁকে ঘুরে আসতে হত। বন্যে এলে ডাঙায় একবাঁশ জল। তখন সোজা নৌকা চালিয়ে দিলেই হল। আর ঘুরে যেতে হয় না। ধানকাটা হলে, আর আলের উপর দিয়ে ঘুরে ঘুরে আসতে হয় না! সোজা একদিক দিয়ে গেলেই হয়।
“লাভের পর তাঁকে সবতাতেই দেখা যায়। মানুষে তাঁর বেশি প্রকাশ। মানুষের মধ্যে সত্ত্বগুণী ভক্তের ভিতের আরও বেশি প্রকাশ – যাদের কামিনী-কাঞ্চন ভোগ করবার একেবারে ইচ্ছা নাই। (সকলে নিস্তব্ধ) সমাধিস্থ ব্যক্তি যদি নেমে আসে, তাহলে সে কিসে মন দাঁড় করাবে? তাই কামিনী-কাঞ্চনত্যাগী সত্ত্বগুণী শুদ্ধভক্তের সঙ্গ দরকার হয়। না হলে সমাধিস্থ লোক কি নিয়ে থাকে?”
ব্রাহ্মসমাজ ও ঈশ্বরের মাতৃভাব – জগতের মা
“যিনি ব্রহ্ম, তিনিই আদ্যাশক্তি। যখন নিষ্ক্রিয়, তখন তাঁকে ব্রহ্ম বলি। পুরুষ বলি। যখন সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় এই সব করেন তাঁকে শক্তি বলি। প্রকৃতি বলি। পুরুষ আর প্রকৃতি। যিনিই পুরুষ তিনিই প্রকৃতি। আনন্দময় আর আনন্দময়ী।
“যার পুরুষ জ্ঞান আছে, তার মেয়ে জ্ঞানও আছে। যার বাপ জ্ঞান আছে, তার মা জ্ঞানও আছে। (কেশবের হাস্য)
“যার অন্ধকার জ্ঞান আছে, তার আলো জ্ঞানও আছে। যার রাত জ্ঞান আছে, তার দিন জ্ঞানও আছে। যার সুখ জ্ঞান আছে, তার দুঃখ জ্ঞানও আছে। তুমি ওটা বুঝেছ?”
“কেশব (সহাস্যে) – হাঁ বুঝেছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ – মা – কি মা? জগতের মা। যিনি জগৎ সৃষ্টি করেছেন, পালন করছেন। যিনি তাঁর ছেলেদের সর্বদা রক্ষা করছেন। আর ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ – যে যা চায়, তাই দেন। ঠিক ছেলে মা ছাড়া থাকতে পারে না। তার মা সব জানে। ছেলে খায়, দায়, বেড়ায়; অত শত জানে না।
কেশব – আজ্ঞে হাঁ।
………………………………………
১ ‘ভারত’ অর্থাৎ মহাভারত। শ্রীযুক্ত ভোলানাথ তখন কালীবাড়ির মুহুরী, ঠাকুরকে ভক্তি করিতেন ও মাঝে মাঝে গিয়া মহাভারত শুনাইতেন। ৺দীননাথ খাজাঞ্চীর পরলোকের পর ভোলানাথ কালীবাড়ির খাজাঞ্চী হইয়াছিলেন।
-১৮৮৩, ২৮শে নভেম্বর-
………………..
রামকৃষ্ণ কথামৃত : পঞ্চদশ অধ্যায় : সপ্তম পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….