শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে রাম, বাবুরাম, মাস্টার, চুনি, অধর, ভবনাথ, নিরঞ্জন প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
শ্রীমুখ-কথিত চরিতামৃত – ঘোষপাড়া ও কর্তাভজাদের মত
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে সেই ঘরে নিজের আসনে ছোট খাটটিতে ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। বেলা এগারটা হইবে, এখনও তাঁহার সেবা হয় নাই।
গতকল্য শনিবার ঠাকুর শ্রীযুক্ত অধর সেনের বাটীতে ভক্তসঙ্গে শুভাগমন করিয়াছিলেন। হরিনাম-কীর্তন মহোৎসব করিয়া সকলকে ধন্য করিয়াছিলেন। আজ এখানে শ্যামদাসের কীর্তন হইবে। ঠাকুরের কীর্তনানন্দ দেখিবার জন্য অনেক ভক্তের সমাগম হইতেছে।
প্রথমে বাবুরাম, মাস্টার, শ্রীরামপুরের ব্রাহ্মণ, মনোমোহন, ভবনাথ, কিশোরী। তৎপরে চুনিলাল, হরিপদ প্রভৃতি; ক্রমে মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয়, রাম, সুরেন্দ্র, তারক, অধর, নিরঞ্জন। লাটু, হরিশ ও হাজরা আজকাল দক্ষিণেশ্বরেই থাকেন।
শ্রীযুক্ত রাম চক্রবর্তী বিষ্ণুঘরে সেবা করেন। তিনিও মাঝে মাঝে আসিয়া ঠাকুরের তত্ত্বাবধান করেন। লাটু, হরিশ ঠাকুরের সেবা করেন। আজ রবিবার, ভাদ্র কৃষ্ণা দ্বিতীয়া তিথি, ২৩শে ভাদ্র, ১২৯১। ৭ই সেপ্টেম্বর, ১৮৮৪।
মাস্টার আসিয়া প্রণাম করিলে পর ঠাকুর বলিতেছেন, “কই নরেন্দ্র এলো না?”
নরেন্দ্র সেদিন আসিতে পারেন নাই। শ্রীরামপুরের ব্রাহ্মণটি রামপ্রসাদের গানের বই আনিয়াছেন ও সেই পুস্তক হইতে মাঝে মাঝে গান পড়িয়া ঠাকুরকে শুনাইতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ব্রাহ্মণের প্রতি) – কই পড় না?
ব্রাহ্মণ – বসন পরো, মা বসন পরো, মা বসন পরো।
শ্রীরামকৃষ্ণ – ও-সব রাখো, আকাট বিকাট! এমন পড় যাতে ভক্তি হয়।
ব্রাহ্মণ – কে জানে কালী কেমন ষড়্দর্শনে না পায় দর্শন।
[ঠাকুরের ‘দরদী’ – পরমহংস, বাউল ও সাঁই ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – কাল অধর সেনের ভাবাবস্থায় একপাশে থেকে পায়ে ব্যথা হয়েছিল। তাই তো বাবুরামকে নিয়ে যাই। দরদী!
এই বলিয়া ঠাকুর গান গাইতেছেন-
মনের কথা কইবো কি সই কইতে মানা। দরদী নইলে প্রাণ বাঁচে না ৷৷
মনের মানুষ হয় যে-জনা, নয়নে তার যায় গো চেনা,
সে দু-এক জনা; সে যে রসে ভাসে প্রেমে ডোবে,
কচ্ছে রসের বেচাকেনা। (ভাবের মানুষ)
মনের মানুষ মিলবে কোথা, বগলে তার ছেঁড়া কাঁথা;
ও সে কয় না গো কথা; ভাবের মানুষ উজান পথে, করে আনাগোনা।
(মনের মানুষ, উজান পথে করে আনাগোনা)।
“বাউলের এই সব গান। আবার আছে –
দরবেশে দাঁড়ারে, সাধের করোয়া ধারী,
দাঁড়ারে, তোর রূপ নেহারি!
“শাক্তমতের সিদ্ধকে বলে কৌল। বেদান্তমতে বলে পরমহংস। বাউল বৈষ্ণবদের মতে বলে সাঁই। ‘সাঁইয়ের পর আর নাই!’
“বাউল সিদ্ধ হলে সাঁই হয়। তখন সব অভেদ। অর্ধেক মালা গোহাড়, অর্ধেক মালা তুলসীর। ‘হিন্দুর নীর – মুসলমানের পীর’।”
আলেখ, হাওয়ার খপর, পইঠে, রসের কাজ, খোলা নামা
“সাঁইয়েরা বলে – আলেখ! আলেখ! বেদমতে বলে ব্রহ্ম; ওরা বলে আলেখ। জীবদের বলে – ‘আলেখে আসে আলেখে যায়’; অর্থাৎ জীবাত্মা অব্যক্ত থেকে এসে তাইতে লয় হয়!
“তারা বলে, হাওয়ার খবর জান?
“অর্থাৎ কুলকুণ্ডলিনী জাগরণ হলে ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না – এদের ভিতর দিয়ে যে মহাবায়ু উঠে, তাহার খবর!
“জিজ্ঞাসা করে, কোন্ পইঠেতে আছ? – ছটা পইঠে – ষট্চক্র।
“যদি বলে পঞ্চমে আছে, তার মানে যে, বিশুদ্ধ চক্রে মন উঠেছে।
(মাস্টারের প্রতি) – “তখন নিরাকার দর্শন। যেমন গানে আছে।”
এই বলিয়া ঠাকুর একটু সুর করিয়া বলিতেছেন – ‘তদূর্ধ্বেতে আছে মাগো অম্বুজে আকাশ। সে আকাশ রুদ্ধ হলে সকলি আকাশ।’
পূর্বকথা – বাউল ও ঘোষপাড়ার কর্তাভজাদের আগমন
“একজন বাউল এসেছিল। তা আমি বললাম, ‘তোমার রসের কাজ সব হয়ে গেছে? – খোলা নেমেছে?’ যত রস জ্বাল দেবে, তত রেফাইন (refine) হবে। প্রথম, আকের রস – তারপর গুড় – তারপর দোলো – তারপর চিনি – তারপর মিছরি, ওলা এই সব। ক্রমে ক্রমে আরও রেফাইন হচ্ছে।
“খোলা নামবে কখন? অর্থাৎ সাধন শেষ হবে কবে? – যখন ইন্দ্রিয় জয় হবে – যেমন জোঁকের উপর চুন দিলে জোঁক আপনি খুলে পড়ে যাবে – ইন্দ্রিয় তেমনি শিথিল হয়ে যাবে। রমনীর সঙ্গে থাকে না করে রমণ।
“ওরা অনেকে রাধাতন্ত্রের মতে চলে। পঞ্চতত্ত্ব নিয়ে সাধন করে পৃথিবীতত্ত্ব, জলতত্ত্ব, অগ্নিতত্ত্ব, বায়ুতত্ত্ব, আকাশতত্ত্ব, – মল, মূত্র, রজ, বীজ – এই সব তত্ত্ব! এ-সব সাধন বড় নোংরা সাধন; যেমন পায়খানার ভিতর দিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢোকা!
“একদিন আমি দালানে খাচ্ছি। একজন ঘোষপাড়ার মতের লোক এলো। এসে বলছে, ‘তুমি খাচ্ছ, না কারুকে খাওয়াচ্ছ?’ অর্থাৎ যে সিদ্ধ হয় সে দেখে যে, অন্তরে ভগবান আছেন!
“যারা এ মতে সিদ্ধ হয়, তারা অন্য মতের লোকদের বলে ‘জীব’। বিজাতীয় লোক থাকলে কথা কবে না। বলে, এখানে ‘জীব’ আছে।
পূর্বকথা – জন্মভূমি দর্শন; সরী পাথরের বাড়ি হৃদুসঙ্গে
“ও-দেশে এই মতের লোক একজন দেখেছি। সরী (সরস্বতী) পাথর – মেয়েমানুষ। এ মতের লোকে পরস্পরের বাড়িতে খায়, কিন্তু অন্য মতের লোকের বাড়ি খাবে না। মল্লিকরা সরী পাথরের বাড়িতে গিয়ে খেলে তবু হৃদের বাড়িতে খেলে না। বলে ওরা ‘জীব’। (হাস্য)
“আমি একদিন তার বাড়িতে হৃদের সঙ্গে বেড়াতে গিছলাম। বেশ তুলসী বন করেছে। কড়াই মুড়ি দিলে, দুটি খেলুম। হৃদে অনেক খেয়ে ফেললে, – তারপর অসুখ!
“ওরা সিদ্ধাবস্থাকে বলে সহজ অবস্থা। একথাকের লোক আছে, তারা ‘সহজ’ ‘সহজ’ করে চ্যাঁচায়। সহজাবস্থার দুটি লক্ষণ বলে। প্রথম – কৃষ্ণগন্ধ গায়ে থাকবে না। দ্বিতীয় – পদ্মের উপর অলি বসবে, কিন্তু মধু পান করবে না।
‘কৃষ্ণগন্ধ’ নাই, – এর মানে ঈশ্বরের ভাব সমস্ত অন্তরে, – বাহিরে কোন চিহ্ন নাই, – হরিনাম পর্যন্ত মুখে নাই। আর একটির মানে, কামিনীতে আসক্তি নাই – জিতেন্দ্রিয়।
“ওরা ঠাকুরপূজা, প্রতিমাপূজা – এ-সব লাইক করে না, জীবন্ত মানুষ চায়। তাই তো ওদের একথাকের লোককে বলে কর্তাভজা, অর্থাৎ যারা কর্তাকে – গুরুকে – ঈশ্বরবোধে ভজনা করে – পূজা করে।”
-১৮৮৪, ৭ই সেপ্টেম্বর-
………………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : পঞ্চবিংশ অধ্যায় : প্রথম পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….