ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

মহেন্দ্রাদির প্রতি উপদেশ – কাপ্তেনের ভক্তি ও পিতামাতার সেবা

দক্ষিণেশ্বরে মহেন্দ্র, রাখাল, রাধিকা গোস্বামী প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে

শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-কালীমন্দিরে সেই পূর্বপরিচিত ঘরে ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। শরৎকাল। শুক্রবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ১৮৮৪; ৪ঠা আশ্বিন, ১২৯১; বেলা দুইটা। আজ ভাদ্র অমাবস্যা। মহালয়া। শ্রীযুক্ত মহেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও তাঁহার ভ্রাতা শ্রীযুক্ত প্রিয় মুখোপাধ্যায়, মাস্টার, বাবুরাম, হরিশ, কিশোরী, লাটু, মেঝেতে কেহ বসিয়া কেহ দাঁড়াইয়া আছেন, – কেহ বা ঘরে যাতায়াত করিতেছেন। শ্রীযুক্ত হাজরা বারান্দায় বসিয়া আছেন। রাখাল বলরামের সহিত বৃন্দাবনে আছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মহেন্দ্রাদি ভক্তদের প্রতি) – কলিকাতায় কাপ্তেনের বাড়িতে গিছলাম। ফিরে আসতে অনেক রাত হয়েছিল।

“কাপ্তেনের কি স্বভাব! কি ভক্তি! ছোট কাপড়খানি পরে আরতি করে। একবার তিন বাতিওয়ালা প্রদীপে আরতি করে, – তারপর আবার এক বাতিওলা প্রদীপে। আবার কর্পূরের আরতি।

“সে সময়ে কথা হয় না। আমায় ইশারা করে আসনে বসতে বললে।

“পূজা করবার সময় চোখের ভাব – ঠিক যেন বোলতা কামড়েছে!

“এদিকে গান গাইতে পারে না। কিন্তু সুন্দর স্তব পাঠ করে।

“তার মার কাছে নিচে বসে। মা – আসনের উপর বসবে।

“বাপ ইংরাজের হাওয়ালদার। যুদ্ধক্ষেত্রে একহাতে বন্দুক আর-এক হাতে শিবপূজা করে। খানসামা শিব গড়ে গড়ে দিচ্ছে। শিবপূজা না করে জল খাবে না। ছয় হাজার টাকা মাহিনা বছরে।

“মাকে কাশীতে মাঝে মাঝে পাঠায়। সেখানে বার-তেরো জন মার সেবায় থাকে। অনেক খরচা। বেদান্ত, গীতা, ভাগবত – কাপ্তেনের কণ্ঠস্থ!

“সে বলে, কলিকাতার বাবুরা ম্লেচ্ছাচার।

“আগে হঠযোগ করেছিল – তাই আমার সমাধি কি ভাবাবস্থা হলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

“কাপ্তেনের পরিবার – তার আবার আলাদা ঠাকুর, গোপাল। এবার তত কৃপণ দেখলাম না। সেও গীতা-টীতা জানে। ওদের কি ভক্তি! – আমি যেখানে খাব সেইখানেই আঁচাব। খড়কে কাঠিটি পর্যন্ত।

“পাঁঠার চচ্চড়ি করে, – কাপ্তেন বলে পনর দিন থাকে, – কিন্তু কাপ্তেনের পরিবার বললে – ‘নাহি নাহি, সাত রোজ’। কিন্তু বেশ লাগল। ব্যঞ্জন সব একটু একটু। আমি বেশ খাই বলে, আজকাল আমায় বেশি দেয়।

“তারপর খাবার পর, হয় কাপ্তেন, নয় তার পরিবার বাতাস করবে।”

Jung Bahadur-এর ছেলেদের কাপ্তেনের সঙ্গে আগমন ১৮৭৫-৭৬ –
নেপালী ব্রহ্মচারিণীর গীতগোবিন্দ গান – “আমি ঈশ্বরের দাসী”

“ওদের কিন্তু ভারী ভক্তি, – সাধুদের বড় সম্মান। পশ্চিমে লোকেদের সাধুভক্তি বেশি। জাঙ্‌-বাহাদুরের ছেলেরা আর ভাইপো কর্ণেল এখানে এসেছিল। যখন এলো পেন্টুলুণ খুলে যেন কত ভয়ে।

“কাপ্তেনের সঙ্গে একটি ওদের দেশের মেয়ে এসেছিল। ভারী ভক্ত, – বিবাহ হয় নাই। গীতগোবিন্দ গান কণ্ঠস্থ। তার গান শুনতে দ্বারিকবাবুরা এসে বসেছিল। আমি বললাম, এরা শুনতে চাচ্ছে, লোক ভাল। যখন গীতগোবিন্দ গান গাইলে তখন দ্বারিকবাবু১ রুমালে চক্ষের জল পুছতে লাগল। বিয়ে কর নাই কেন, জিজ্ঞাসা করাতে বলে, ‘ঈশ্বরের দাসী, আবার কার দাসী হব?’ আর সব্বাই তাকে দেবী বলে খুব মানে – যেমন পুঁথিতে (শাস্ত্রে) আছে।

(মহেন্দ্রাদির প্রতি) – “আপনারা যে আসছো, তাতে কিছু কি উপকার হচ্ছে? শুনলে মনটা বড় ভাল থাকে। (মাস্টারের প্রতি) এখানে লোক আসে কেন? তেমন লেখাপড়া জানি না -”

মাস্টার – আজ্ঞা, কৃষ্ণ যখন নিজে সব রাখাল গরুটরু হলেন (ব্রহ্মা হরণ করবার পর) তখন রাখালদের মা’রা নূতন রাখালদের পেয়ে যশোদার বাড়িতে আর আসেন না। গাভীরাও হাম্বা রবে ওই নূতন বাছুরদের পিছে পিছে গিয়ে পড়তে লাগল।

শ্রীরামকৃষ্ণ – তাতে কি হলো?

মাস্টার – ঈশ্বর নিজেই সব হয়েছেন কি না, তাই এত আকর্ষণ। ঈশ্বর বস্তু থাকলেই মন টানে।

কৃষ্ণলীলার ব্যাখ্যা – গোপীপ্রেম – বস্ত্রহরণের মানে

শ্রীরামকৃষ্ণ – এ যোগমায়ার আকর্ষণ – ভেলকি লাগিয়ে দেয়। রাধিকা সুবোল বেশে বাছুর কোলে – জটিলার ভয়ে যাচ্ছে; যখন যোগমায়ার শরণাগত হলো তখন জটিলা আবার আশীর্বাদ করে।

“হরিলীলা সব যোগমায়ার সাহায্যে!

“গোপীদের ভালবাসা – পরকীয়া রতি। কৃষ্ণের জন্য গোপীদের প্রেমোন্মাদ হয়েছিল। নিজের সোয়ামীর জন্য অত হয় না। যদি কেউ বলে, ওরে তোর সোয়ামী এসেছে! তা বলে, ‘এসেছে, তা আসুকগে, – ওই খাবে এখন! কিন্তু যদি পর পুরুষের কথা শুনে, – রসিক, সুন্দর, রসপণ্ডিত, – ছুটে দেখতে যাবে, – আর আড়াল থেকে উঁকি মেরে – দেখবে।

“যদি খোঁচ ধর যে, তাঁকে দেখি নাই, তাঁর উপর কেমন করে গোপীদের মতো টান হবে? তা শুনলেও সে টান হয় –

“না জেনে নাম শুনে কানে মন গিয়ে তায় লিপ্ত হলো।”

একজন ভক্ত – আজ্ঞা, বস্ত্রহরণের মানে কি?

শ্রীরামকৃষ্ণ – অষ্টপাশ, – গোপীদের সব পাশই গিয়েছিল, কেবল লজ্জা বাকী ছিল। তাই তিনি ও পাশটাও ঘুচিয়ে দিলেন। ঈশ্বরলাভ হলে সব পাশ চলে যায়।

যোগভ্রষ্টের ভোগান্তে ঈশ্বরলাভ

(মহেন্দ্র মুখুজ্জে প্রভৃতি ভক্তদের প্রতি) – “ঈশ্বরের উপর টান সকলের হয় না, আধার বিশেষ হয়। সংস্কার থাকলে হয়। তা না হলে বাগবাজারে এত লোক ছিল কেবল তোমরাই এখানে এলে কেন? আদাড়েগুলোর হয় না।

“মলয় পর্বতের হাওয়া লাগলে সব গাছ চন্দন হয়; কেবল শিমূল, অশ্বত্থ, বট আর কয়েকটা গাছ চন্দন হয় না।

“তোমাদের টাকা-কড়ির অভাব নাই। যোগভ্রষ্ট হলে ভাগ্যবানের ঘরে জন্ম হয়, – তারপর আবার ঈশ্বরের জন্য সাধনা করে।”

মহেন্দ্র মুখুজ্জে – কেন যোগভ্রষ্ট হয়?

শ্রীরামকৃষ্ণ – পূর্বজন্মে ঈশ্বরচিন্তা করতে করতে হয়তো হঠাৎ ভোগ করবার লালসা হয়েছে। এরূপ হলে যোগভ্রষ্ট হয়। আর পরজন্মে ওইরূপ জন্ম হয়।

মহেন্দ্র – তারপর, উপায়?

শ্রীরামকৃষ্ণ – কামনা থাকতে – ভোগ লালসা থাকতে – মুক্তি নাই। তাই খাওয়া-পরা, রমণ-ফমন সব করে নেবে। (সহাস্যে) তুমি কি বল? স্বদারায় না পরদারায়? (মাস্টার, মুখুজ্জে, এঁরা হাসিতেছেন)

…………………………………………….
১ দ্বারিকবাবু মথুরের জেষ্ঠপুত্র। ১৮৭৭ খ্রী: প্রায় ৪০ বৎসর বয়সে মৃত্যু হয় – পৌষ ১২৮৪। কাপ্তেন প্রথম আসেন ১৮৭৫-৭৬ খ্রী:। অতএব এই গীতগোবিন্দ গান ১৮৭৫ ও ১৮৭৭ খ্রী: মধ্যে হইবে।

-১৮৮৪, ১৯শে সেপ্টেম্বর-

…………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : পঞ্চবিংশ অধ্যায় : একাদশ পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!