ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীযুক্ত রাধিকা গোস্বামী
মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয় প্রভৃতি ভক্তগণের সহিত কথা কহিতে কহিতে বেলা প্রায় তিনটা বাজিয়াছে। শ্রীযুক্ত রাধিকা গোস্বামী আসিয়া প্রণাম করিলেন। তিনি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে এই প্রথম দর্শন করলেন। বয়স আন্দাজ ত্রিশের মধ্যে। গোস্বামী আসন গ্রহণ করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – আপনারা কি অদ্বৈতবংশ?
গোস্বামী – আজ্ঞা, হাঁ।
ঠাকুর অদ্বৈতবংশ শুনিয়া গোস্বামীকে হাতজোড় করিয়া প্রণাম করিতেছেন।
গোস্বামী বংশ ও ব্রাহ্মণ পূজনীয় – মহাপুরুষের বংশে জন্ম
শ্রীরামকৃষ্ণ – অদ্বৈতগোস্বামী বংশ, – আকরের গুণ আছেই!
“নেকো আমের গাছে নেকো আমই হয়। (ভক্তদের হাস্য) খারাপ আম হয় না। তবে মাটির গুণে একটু ছোট বড় হয়। আপনি কি বলেন?”
গোস্বামী (বিনীতভাবে) – আজ্ঞে, আমি কি জানি।
শ্রীরামকৃষ্ণ – তুমি যাই বল, – অন্য লোকে ছাড়বে কেন?
“ব্রাহ্মণ, হাজার দোষ থাকুক – তবু ভরদ্বাজ গোত্র, শাণ্ডিল্য গোত্র বলে সকলের পূজনীয়। (মাস্টারের প্রতি) শঙ্খচিলের কথাটি বল তো!”
মাস্টার চুপ করিয়া আছেন দেখিয়া ঠাকুর আবার কথা কহিতেছেন –
শ্রীরামকৃষ্ণ – বংশে মহাপুরুষ যদি জন্মে থাকেন তিনিই টেনে নেবেন – হাজার দোষ থাকুক। যখন গন্ধর্ব কৌরবদের বন্দী করলে যুধিষ্ঠির গিয়ে তাদের মুক্ত করলেন। যে দুর্যোধন এত শত্রুতা করেছে, যার জন্য যুধিষ্ঠিরের বনবাস হয়েছে তাকেই গিয়ে মুক্ত করলেন!
“তা ছাড়া ভেকের আদর করতে হয়। ভেক দেখলে সত্য বস্তুর উদ্দীপন হয়। চৈতন্যদেব গাধাকে ভেক পরিয়ে সাষ্টাঙ্গ হয়েছিলেন।
“শঙ্খচিলকে দেখলে প্রণাম করে কেন? কংস মারতে যাওয়াতে ভগবতী শঙ্খচিল হয়ে উড়ে গিয়েছিলেন। তা এখনও শঙ্খচিল দেখলে সকলে প্রণাম করে।”
পূর্বকথা – চানকে কোয়ার সিং কর্তৃক ঠাকুরের পূজা – ঠাকুরের রাজভক্তি Loyality
“চানকের পল্টনের ভিতর ইংরাজকে আসতে দেখে সেপাইরা সেলাম করলে। কোয়ার সিং আমাকে বুঝিয়ে দিলে, ‘ইংরাজের রাজ্য তাই ইংরাজকে সেলাম করতে হয়’।”
গোস্বামীর কছে সাম্প্রদায়িকতার নিন্দা – শাক্ত ও বৈষ্ণব
“শাক্তের তন্ত্র মত বৈষ্ণবের পুরাণ মত। বৈষ্ণব যা সাধন করে তা প্রকাশে দোষ নাই। তান্ত্রিকের সব গোপন। তাই তান্ত্রিককে সব বোঝা যায় না।
(গোস্বামীর প্রতি) – “আপনারা বেশ – কত জপ করেন, কত হরিনাম করেন।”
গোস্বামী (বিনীতভাবে) – আজ্ঞা, আমরা আর কি করছি! আমি কত অধম।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – দীনতা; আচ্ছা ও তো আছে। আর এক আছে, ‘আমি হরিনাম কচ্ছি, আমার আবার পাপ! যে রাতদিন ‘আমি পাপী’ ‘আমি পাপী’ ‘আমি অধম’ ‘আমি অধম’ করে, সে তাই হয়ে যায়। কি অবিশ্বাস! তাঁর নাম এত করেছে আবার বলে, ‘পাপ, পাপ!’
গোস্বামী এই কথা অবাক্ হইয়া শুনিতেছেন।
পূর্বকথা – বৃন্দাবনে বৈষ্ণবের ভেক গ্রহণ ১৮৬৮ খ্রী:
শ্রীরামকৃষ্ণ – আমিও বৃন্দাবনে ভেক নিয়েছিলাম; – পনর দিন রেখেছিলাম। (ভক্তদের প্রতি) সব ভাবই কিছুদিন করতাম, তবে শান্তি হতো।
(সহাস্যে) “আমি সবরকম করেছি – সব পথই মানি। শাক্তদেরও মানি, বৈষ্ণবদেরও মানি, আবার বেদান্তবাদীদেরও মানি। এখানে তাই সব মতের লোক আসে। আর সকলেই মনে করে, ইনি আমাদেরই মতের লোক। আজকালকার ব্রহ্মজ্ঞানীদেরও মানি।
“একজনের একটি রঙের গামলা ছিল। গামলার আশ্চর্য গুণ যে, যে রঙে কাপড় ছোপাতে চাইবে তার কাপড় সেই রঙেই ছুপে যেত।
“কিন্তু একজন চালাক লোক বলেছিল, ‘তুমি যে-রঙে রঙেছো, আমায় সেই রঙটি দিতে হবে।’ (ঠাকুর ও সকলের হাস্য)
“কেন একঘেয়ে হব? ‘অমুক মতের লোক তাহলে আসবে না।’ এ ভয় আমার নাই। কেউ আসুক আর না আসুক তাতে আমার বয়ে গেছে; – লোক কিসে হাতে থাকবে, এমন কিছু আমার মনে নাই। অধর সেন বড় কর্মের জন্য মাকে বলতে বলেছিল – তা ওর সে কর্ম হল না। ও তাতে যদি কিছু মনে করে, আমার বয়ে গেছে!”
পূর্বকথা – কেশব সেনের বাটীতে নিরাকারের ভাব –
বিজয় গোস্বামীর সঙ্গে এঁড়েদর গদাধরের
পাঠবাড়িদর্শন – বিজয়ের চরিত্র
“আবার কেশব সেনের বাড়ি গিয়ে আর এক ভাব হল। ওরা নিরাকার নিরাকার করে; – তাই ভাবে বললুম, ‘মা এখানে আনিসনি, এরা তোর রূপ-টুপ মানে না’।”
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এই সকল কথা শুনিয়া গোস্বামী চুপ করিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – বিজয় এখন বেশ হয়েছে।
“হরি হরি বলতে বলতে মাটিতে পড়ে যায়!
“চারটে রাত পর্যন্ত কীর্তন, ধ্যান এই সব নিয়ে থাকে। এখন গেরুয়া পরে আছে। ঠাকুর-বিগ্রহ দেখলে একেবারে সাষ্টাঙ্গ!
“চৈতন্যদেবের পটের সম্মুখে আবার সাষ্টাঙ্গ!”
গোস্বামী – রাধাকৃষ্ণ মূর্তির সম্মুখে?
শ্রীরামকৃষ্ণ – সাষ্টাঙ্গ! আর আচারী খুব।
গোস্বামী – এখন সমাজে নিতে পারা যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ – সে লোকে কি বলবে, তা অত চায় না।
গোস্বামী – না, সমাজ তাহলে কৃতার্থ হয় – অমন লোককে পেলে।
শ্রীরামকৃষ্ণ – আমায় খুব মানে।
“তাকে পাওয়াই ভার। আজ ঢাকায় ডাক, কাল আর এক জায়গায় ডাক। সর্বদাই ব্যস্ত।
“তাদের সমাজে (সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে) বড় গোল উঠেছে।”
গোস্বামী – আজ্ঞা, কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ – তাকে বলছে, ‘তুমি সাকারবাদীদের সঙ্গে মেশো! – তুমি পৌত্তলিক।’
“আর অতি উদার সরল। সরল না কলে ঈশ্বরের কৃপা হয় না।”
মুখুজ্জেদিগকে শিক্ষা – গৃহস্থ, “এগিয়ে পড়” – অভ্যাসযোগ
এইবার ঠাকুর মুখুজ্জেদের সঙ্গে কথা কহিতেছেন। জ্যেষ্ঠ মহেন্দ্র ব্যবসা করেন কাহারও চাকরি করেন না। কনিষ্ঠ প্রিয়নাথ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। এখন কিছু সংস্থান করিয়াছেন। আর চাকরি করেন না। জ্যেষ্ঠের বয়স ৩৫/৩৬ হইবে। তাঁহাদের বাড়ি কেদেটি গ্রামে। কলিকাতা বাগবাজারের তাঁহাদের বসতবাটী আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – একটু উদ্দীপন হচ্চে বলে চুপ করে থেকো না। এগিয়ে পড়। চন্দন কাঠের পর আরও আছে – রূপার খনি, সোনার খনি!
প্রিয় (সহাস্যে) – আজ্ঞা, পায়ে বন্ধন – এগুতে দেয় না।
শ্রীরামকৃষ্ণ – পায়ে বন্ধন থাকলে কি হবে? – মন নিয়ে কথা।
“মনেই বদ্ধ মুক্ত। দুই বন্ধু – একজন বেশ্যালয়ে গেল, একজন ভাগবত শুনছে। প্রথমটি ভাবছে – ধিক্ আমাকে – বন্ধু হরিকথা শুনছে আর আমি কোথা পড়ে রয়েছি। আর-একজন ভাবছে, ধিক্ আমাকে, বন্ধু কেমন আমোদ-আহ্লাদ করছে, আর আমি শালা কি বোকা! দেখো প্রথমটিকে বিষ্ণুদূতে নিয়ে গেল – বৈকুণ্ঠে। আর দ্বিতীয়টিকে যমদূতে নিয়ে গেল”।
প্রিয় – মন যে আমার বশ নয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ – সে কি! অভ্যাস যোগ। অভ্যাস কর, দেখবে মনকে যেদিকে নিয়ে যাবে, সেইদিকেই যাবে।
“মন ধোপাঘরের কাপড়। তারপর লালে ছোপাও লাল – নীলে ছোপাও নীল। যে রঙে ছোপাবে সেই রঙ হয়ে যাবে।
(গোস্বামীর প্রতি) – “আপনাদের কিছু কথা আছে?”
গোস্বামী (অতি বিনীতভাবে) – আজ্ঞে না, – দর্শন হল। আর কথা তো সব শুনছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ – ঠাকুরদের দর্শন করুন।
গোস্বামী (অতি বিনীতভাবে) – একটু মহাপ্রভুর গুণানুকীর্তন –
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গোস্বামীকে গান শুনাইতেছেন:
গান – আমার অঙ্গ কেন গৌর হলো!
গান – গোরা চাহে বৃন্দাবনপানে, আর ধারা বহে দুনয়নে ৷৷
ভাব হবে বইকি রে!) (ভাবনিধি শ্রীগৌরাঙ্গের)
(যার অন্তঃ কৃষ্ণ বহিঃ গৌর) (ভাবে হাসে কাঁদে নাচে গায়)
(বন দেখে বৃন্দাবন ভাবে) (সমুদ্র দেখে শ্রীযমুনা ভাবে)
(গোরা আপনার পা আপনি ধরে)
শ্রীযুক্ত রাধিকা গোস্বামীকে সর্বধর্ম-সমন্বয় উপদেশ
গান সমাপ্ত হইল – ঠাকুর কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গোস্বামীর প্রতি) – এ তো আপনাদের (বৈষ্ণবদের) হল। আর যদি কেউ শাক্ত, কি ঘোষপাড়ার মত আসে, তখন কি বলব!
“তাই এখানে সব ভাবই আছে – এখানে সবরকম লোক আসবে বলে; বৈষ্ণব, শাক্ত, কর্তাভজা, বেদান্তবাদী; আবার ইদানীং ব্রহ্মজ্ঞানী।
“তাঁরই ইচ্ছায় নানা ধর্ম নানা মত হয়েছে।
“তবে তিনি যার যা পেটে সয় তাকে সেইটি দিয়েছেন। মা সকলকে মাছের পোলোয়া দেয় না। সকলের পেটে সয় না। তাই কাউকে মাছের ঝোল করে দেন।
“যার যা প্রকৃতি, যার যা ভাব, সে সেই ভাবটি নিয়ে থাকে।
“বারোয়ারিতে নানা মূর্তি করে, – আর নানা মতের লোক যায়। রাধা-কৃষ্ণ, হর-পার্বতী, সীতা-রাম; ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন মূর্তি রয়েছে, আর প্রত্যেক মূর্তির কাছে লোকের ভিড় হয়েছে। যারা বৈষ্ণব তারা বেশি রাধা-কৃষ্ণের কাছে দাঁড়িয়ে দেখছে। যারা শাক্ত তারা হর-পার্বতীর কাছে। যারা রামভক্ত তারা সীতা-রাম মূর্তির কাছে।
“তবে যাদের কোন ঠাকুরের দিকে মন নাই তাদের আলাদা কথা। বেশ্যা উপপতিকে ঝাঁটা মারছে, – বারোয়ারিতে এমন মূর্তিও করে। ও-সব লোক সেইখানে দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখে, আর চিৎকার করে বন্ধুদের বলে, ‘আরে ও-সব কি দেখছিস, এদিকে আয়! এদিকে আয়!”
সকলে হাসিতেছেন। গোস্বামী প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।
-১৮৮৪, ১৯শে সেপ্টেম্বর-
…………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : পঞ্চবিংশ অধ্যায় : ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….