“জ্ঞান অজ্ঞানের পার হও” – শশধরের শুষ্ক জ্ঞান
ঠাকুর দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে নরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মধ্যাহ্ন সেবার পর দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে ঘরে বিশ্রাম করিতেছেন। আজ নরেন্দ্র, ভবনাথ প্রভৃতি ভক্তেরা কলিকাতা হইতে আসিয়াছেন। মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয়, জ্ঞানবাবু, ছোট গোপাল, বড় কালী প্রভৃতি এঁরাও আসিয়াছেন। কোন্নগর হইতে তিন-চারিটি ভক্ত আসিয়াছেন। রাখাল শ্রীবৃন্দাবনে বলরামের সহিত আছেন। তাঁহার জ্বর হইয়াছিল – সংবাদ আসিয়াছে। আজ রবিবার, কৃষ্ণা দশমী তিথি, ৩০শে ভাদ্র, ১২৯১। ১৪ই সেপ্টেম্বর, ১৮৮৪।
নরেন্দ্র পিতৃবিয়োগের পর মা ও ভাইদের লইয়া বড়ই ব্যতিব্যস্ত হইয়াছেন। তিনি আইন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইবেন।
জ্ঞানবাবু চারটে পাস করিয়াছেন ও সরকারের কর্ম করেন। তিনি ১০টা-১১টার সময় আসিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (জ্ঞানবাবু দৃষ্টে) – কিগো, হঠাৎ যে জ্ঞানোদয়!
জ্ঞান (সহাস্যে) – আজ্ঞা, অনেক ভাগ্যে জ্ঞানোদয় হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – তুমি জ্ঞান হয়ে অজ্ঞান কেন? ও বুঝেছি, যেখানে জ্ঞান সেইখানেই অজ্ঞান! বশিষ্ঠদেব অত জ্ঞানী, পুত্রশোকে কেঁদেছিলেন! তাই তুমি জ্ঞান অজ্ঞানের পার হও। অজ্ঞান কাঁটা পায়ে ফুটেছে, তুলবার জন্য জ্ঞান কাঁটার দরকার। তারপর তোলা হলে দুই কাঁটাই ফেলে দেয়।
নির্লিপ্ত গৃহস্থ – ঠাকুরের জন্মভূমিতে ছুতোরদের মেয়েদের কাজদর্শন
“এই সংসার ধোঁকার টাটি – জ্ঞানী বলছে। যিনি জ্ঞান অজ্ঞানের পার, তিনি বলছেন ‘মজার কুঠি!’ সে দেখে ঈশ্বরই জীব, জগৎ, এই চতুর্বিংশতি তত্ত্ব সব হয়েছেন।
“তাঁকে লাভ করার পর সংসার করা যেতে পারে। তখন নির্লিপ্ত হতে পারে। ও-দেশে ছুতোরদের মেয়েদের দেখেছি – ঢেঁকি নিয়ে চিড়ে কোটে। একহাতে ধান নাড়ে, একহাতে ছেলেকে মাই দেয় – আবার খরিদ্দারের সঙ্গে কথাও কচ্চে – ‘তোমার কাছে দুআনা পাওনা আছে – দাম দিয়ে যেও।’ কিন্তু তার বারো আনা মন হাতের উপর – পাছে হাতে ঢেঁকি পড়ে যায়।
“বারো আনা মন ঈশ্বরেতে রেখে চার আনা লয়ে কাজকর্ম করা।”
শ্রীযুক্ত পণ্ডিত শশধরের কথা ভক্তদের বলিতেছেন, “দেখলাম – একঘেয়ে, কেবল শুষ্ক জ্ঞানবিচার নিয়ে আছে।”
“যে নিত্যতে পৌঁছে লীলা নিয়ে থাকে, আবার লীলা থেকে নিত্যে যেতে পারে, তারই পাকা জ্ঞান, পাকা ভক্তি।
“নারদাদি ব্রহ্মজ্ঞানের পর ভক্তি নিয়ে ছিলেন। এরই নাম বিজ্ঞান।
শুধু শুষ্ক জ্ঞান! ও যেন ভস্-করে-ওঠা তুবড়ি। খানিকটা ফুল কেটে ভস্ করে ভেঙে যায়। নারদ, শুকদেবাদির জ্ঞান যেন ভাল তুবড়ি। খানিকটা ফুল কেটে বন্ধ হয়, আবার নূতন ফুল কাটছে – আবার বন্ধ হয় – আবার নূতন ফুল কাটে! নারদ, শুকদেবাদির তাঁর উপর প্রেম হয়েছিল। প্রেম সচ্চিদানন্দকে ধরবার দড়ি।”
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বকুলতলায় – ঝাউতলা হতে ভাবাবিষ্ট
মধ্যাহ্নে সেবার পর ঠাকুর একটু বিশ্রাম করিয়াছেন।
বকুলতলায় বেঞ্চের মতো যে বসিবার স্থান আছে, সেখানে দুই-চারিজন ভক্ত উপবিষ্ট আছেন ও গল্প করিতেছেন – ভবনাথ, মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয়, মাস্টার, ছোট গোপাল, হাজরা প্রভৃতি। ঠাকুর ঝাউতলায় যাইতেছেন। ওখানে আসিয়া একবার বসিলেন।
হাজরা (ছোট গোপালকে) – এঁকে একটু তামাক খাওয়াও।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – তুমি খাবে তাই বল। (সকলের হাস্য)
মুখুজ্জে (হাজরাকে) – আপনি এঁর কাছে থেকে অনেক শিখেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – না, এঁর বাল্যকাল থেকেই এই অবস্থা। (সকলের হাস্য)
ঠাকুর ঝাউতলা হইতে ফিরিয়া আসিতেছেন – ভক্তেরা দেখিলেন। ভাবাবিষ্ট। মাতালের ন্যায় চলিতেছেন। যখন ঘরে পোঁছিলেন, তখন আবার প্রকৃতিস্থ হইলেন।
-১৮৮৪, ১৪ই সেপ্টেম্বর-
………………..
রামকৃষ্ণ কথামৃত : পঞ্চবিংশ অধ্যায় : ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….