সুরেন্দ্রের বাড়ি নরেন্দ্র প্রভৃতি সঙ্গে
জাহাজ কয়লাঘাটে এইবার ফিরিয়া আসিল। সকলে নামিবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। ঘরের বাহিরে আসিয়া দেখেন, কোজাগরের পূর্ণচন্দ্র হাসিতেছে, ভাগীরথী-বক্ষ কৌমুদীর লীলাভূমি হইয়াছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের জন্য গাড়ি আনিতে দেওয়া হইল। কিয়ৎক্ষণ পরে মাস্টার ও দু-একটি ভক্তের সহিত ঠাকুর গাড়িতে উঠিলেন। কেশবের ভ্রাতুষ্পুত্র নন্দলালও গাড়িতে উঠিলেন, ঠাকুরের সঙ্গে খানিকটা যাবেন।
গাড়িতে সকলে বসিলে পর ঠাকুর জিজ্ঞাসা করিলেন, কই তিনি কই – অর্থাৎ কেশব কই? দেখিতে দেখিতে কেশব একাকী আসিয়া উপস্থিত। মুখে হাসি! আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কে কে এঁর সঙ্গে যাবে? সকলে গাড়িতে বসিলে পর, কেশব ভূমিষ্ঠ হইয়া ঠাকুরের পদধূলি গ্রহণ করিলেন। ঠাকুরও সস্নেহে সম্ভাষণ করিয়া বিদায় দিলেন।
গাড়ি চলিতে লাগিল। ইংরেজটোলা। সুন্দর রাজপথ। পথের দুইদিকে সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা। পূর্ণচন্দ্র উঠিয়াছে, অট্টালিকাগুলি যেন বিমল শীতল চন্দ্রকিরণে বিশ্রাম করিতেছে। দ্বারদেশে বাষ্পীয় দীপ, কক্ষমধ্যে দীপমালা, স্থানে স্থানে হার্মোনিয়াম, পিয়ানো সংযোগে ইংরেজ মহিলারা গান করিতেছে। ঠাকুর অনন্দে হাস্য করিতে করিতে যাইতেছেন। হঠাৎ বলিলেন, “আমার জলতৃষ্ণা পাচ্ছে; কি হবে?” কি করা যায়! নন্দলাল “ইন্ডিয়া ক্লাবের” নিকট গাড়ি থামাইয়া উপরে জল আনিতে গেলেন, কাচের গ্লাসে করিয়া জল আনিলেন। ঠাকুর সহাস্যে জিজ্ঞাসা করিলেন, “গ্লাসটি ধোয়া তো?” নন্দলাল বললেন, ‘হাঁ’। ঠাকুর সেই গ্লাসে জলপান করিলেন।
বালকের স্বভাব। গাড়ি চালাইয়া দিলে ঠাকুর মুখ বাড়াইয়া লোকজন গাড়ি-ঘোড়া চাঁদের আলো দেখিতেছেন। সকল তাতেই আনন্দ।
নন্দলাল কলুটোলায় নামিলেন। ঠাকুরের গাড়ি সিমুলিয়া স্ট্রীটে শ্রীযুক্ত সুরেশ মিত্রের বাড়িতে আসিয়া লাগিল। ঠাকুর তাঁহাকে সুরেন্দ্র বলিতেন। সুরেন্দ্র ঠাকুরের পরম ভক্ত।
কিন্তু সুরেন্দ্র বাড়িতে নাই। তাঁহাদের নূতন বাগানে গিয়াছেন। বাড়ির লোকরা বসিতে নিচের ঘর খুলিয়া দিলেন। গাড়িভাড়া দিতে হবে। কে দিবে? সুরেন্দ্র থাকিলে সেই দিত। ঠাকুর একজন ভক্তকে বলিলেন, “ভাড়াটা মেয়েদের কাছ থেকে চেয়ে নে না। ওরা কি জানে না, ওদের ভাতাররা যায় আসে।” (সকলের হাস্য)
নরেন্দ্র পাড়াতেই থাকেন। ঠাকুর নরেন্দ্রকে ডাকিতে পাঠাইলেন। এদিকে বাড়ির লোকেরা দোতলার ঘরে ঠাকুরকে বসাইলেন। ঘরের মেঝেতে চাদর পাতা, দু-চারটে তাকিয়া তার উপর; কক্ষ-প্রাচীরে সুরেন্দ্রের বিশেষ যত্নে প্রস্তুত ছবি (Oil painting) যাহাতে কেশবকে ঠাকুর দেখাইতেছেন হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ সকল ধর্মের সমন্বয়। আর বৈষ্ণব, শাক্ত, শৈব ইত্যাদি সকল সম্প্রদায়ের সমন্বয়।
ঠাকুর বসিয়া সহাস্যে গল্প করিতেছেন, এমন সময় নরেন্দ্র আসিয়া পৌঁছিলেন, তখন ঠাকুরের আনন্দ যেন দ্বিগুণ হইল। তিনি বলিলেন, “আজ কেশব সেনের সঙ্গে কেমন জাহাজে করে বেড়াতে গিছিলাম। বিজয় ছিল, এরা সব ছিল।” মাস্টারকে নির্দেশ করিয়া বলিলেন, “একে জিজ্ঞাসা কর, কেমন বিজয় আর কেশবকে বললুম, মায়ে-ঝিয়ে মঙ্গলবার, আর জটিলে-কুটিলে না থাকলে লীলা পোষ্টাই হয় না – এই সব কথা। (মাস্টারের প্রতি) কেমন গা?”
মাস্টার – আজ্ঞা হাঁ।
রাত্রি হইল, তবু সুরেন্দ্র ফিরিলেন না। ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে যাইবেন, আর দেরি করা যায় না, রাত সাড়ে দশটা। রাস্তায় চাঁদের আলো।
গাড়ি আসিল। ঠাকুর উঠিলেন। নরেন্দ্র ও মাস্টার প্রণাম করিয়া কলিকাতাস্থিত স্ব স্ব বাটীতে প্রত্যাগমন করিলেন।
-১৮৮২, ২৭শে অক্টোবর-
……………………..
রামকৃষ্ণ কথামৃত : পঞ্চম অধ্যায় : দশম পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….