ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

ব্রাহ্মদিগকে উপদেশ – খ্রীষ্টধর্ম, ব্রাহ্মসমাজ ও পাপবাদ

সর্বধর্মান্‌ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ ৷
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ ৷৷
[গীতা – ১৮। ৬৬]

শ্রীরামকৃষ্ণ (ব্রাহ্মভক্তদের প্রতি) – মনেতেই বদ্ধ, মনেতেই মুক্ত। আমি মুক্ত পুরুষ; সংসারেই থাকি বা অরণ্যেই থাকি, আমার বন্ধন কি? আমি ঈশ্বরের সন্তান; রাজাধিরাজের ছেলে; আমায় আবার বাঁধে কে? যদি সাপে কামড়ায়, “বিষ নাই” জোর করে বললে বিষ ছেড়ে যায়! তেমনি “আমি বদ্ধ নই, আমি মুক্ত” এই কথাটি রোখ করে বলতে বলতে তাই হয়ে যায়। মুক্তই হয়ে যায়।

[পূর্বকথা – শ্রীরামকৃষ্ণের বাইবেল শ্রবণ – কৃষ্ণকিশোরের বিশ্বাস ]

“খ্রীষ্টানদের একখানা বই একজন দিলে, আমি পড়ে শুনাতে বললুম। তাতে কেবল ‘পাপ আর পাপ’। (কেশবের প্রতি) তোমাদের ব্রাহ্মসমাজেও কেবল ‘পাপ’। যে ব্যক্তি ‘আমি বদ্ধ’ ‘আমি বদ্ধ’ বার বার বলে, সে শালা বদ্ধই হয়ে যায়! যে রাতদিন ‘আমি পাপী’, ‘আমি পাপী’ এই করে, সে তাই হয়ে যায়।

“ঈশ্বরের নামে এমন বিশ্বাস হওয়া চাই – কি, আমি তাঁর নাম করেছি, আমার এখনও পাপ থাকবে! আমার আবার পাপ কি?’ কৃষ্ণকিশোর পরম হিন্দু, সদাচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ, সে বৃন্দাবনে গিছল। একদিন ভ্রমণ করতে করতে তার জলতৃষ্ণা পেয়েছিল। একটা কুয়ার কাছে গিয়ে দেখলে, একজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাকে বললে, ওরে তুই একঘটি জল আমায় দিতে পারিস? তুই কি জাত? সে বললে, ঠাকুর মহাশয়, আমি হীন জাত – মুচি। কৃষ্ণকিশোর বললে, তুই বল, শিব। নে, এখন জল তুলে দে।

“ভগবানের নাম করলে মানুষের দেহ-মন সব শুদ্ধ হয়ে যায়।

“কেবল ‘পাপ’ আর ‘নরক’ এই সব কথা কেন? একবার বল যে, অন্যায় কর্ম যা করেছি আর করব না। আর তাঁর নামে বিশ্বাস কর।”

ঠাকুর প্রেমোন্মত্ত হইয়া নামমাহাত্ম্য গাইতেছেন-

“আমি দুর্গা দুর্গা বলে মা যদি মরি ৷
আখেরে এ-দীনে, না তারো কেমনে, জানা যাবে গো শঙ্করী ৷৷

“আমি মার কাছে কেবল ভক্তি চেয়েছিলাম। ফুল হাতে করে মার পাদপদ্মে দিয়েছিলাম; বলেছিলাম, ‘মা, এই নাও তোমার পাপ, এই নাও তোমার পুণ্য, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও; এই নাও তোমার জ্ঞান, এই নাও তোমার অজ্ঞান, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও; এই নাও তোমার শুচি, এই নাও তোমার অশুচি, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও; এই নাও তোমার ধর্ম, এই নাও তোমার অধর্ম, এই নাও তোমার অধর্ম, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও’।”

(ব্রাহ্মভক্তদের প্রতি) – একটি রামপ্রসাদের গান শোন:

“আয় মন, বেড়াতে যাবি ৷
কালী-কল্পতরুমূলে রে (মন) চারি ফল কুড়ায়ে পাবি ৷৷
প্রবৃত্তি নিবৃত্তি জায়া, (তার) নিবৃত্তিরে সঙ্গে লবি ৷
ওরে বিবেক নামে তার বেটা, তত্ত্ব-কথা তায় সুধাবি ৷৷
শুচি অশুচিরে লয়ে দিব্য ঘরে কবে শুবি ৷
যখন দুই সতীনে পিরিত হবে, তখন শ্যামা মাকে পাবি ৷৷

অহংকার অবিদ্যা তোর, পিতামাতায় তাড়িয়ে দিবি ৷
যদি মোহগর্তে টেনে লয়, ধৈর্যখোঁটা ধরে রবি ৷৷
ধর্মাধর্ম দুটো অজা, তুচ্ছখোঁটায় বেঁধে থুবি ৷
যদি না মানে নিষেধ, তবে জ্ঞানখড়্গে বলি দিবি ৷৷

প্রথম ভার্যার সন্তানের দূর হতে বুঝাইবি ৷
যদি না মানে প্রবোধ, জ্ঞান-সিন্ধু মাঝে ডুবাইবি ৷৷
প্রসাদ বলে, এমন হলে কালের কাছে জবাব দিবি ৷
তবে বাপু বাছা বাপের ঠাকুর, মনের মতো মন হবি ৷৷

“সংসারে ঈশবরলাভ হবে না কেন? জনকের হয়েছিল। এ-সংসার ‘ধোঁকার টাটি’ প্রসাদ বলেছিল। তাঁর পাদপদ্মে ভক্তিলাভ করলে –

এই সংসারই মজার কুটি, আমি খাই-দাই আর মজা লুটি।
জনক রাজা মহাতেজা, তার কিসের ছিল ক্রটি।
সে যে এদিক ওদিক দুদিক রেখে, খেয়েছিল দুধের বাটি।”
(সকলের হাস্য)

[ব্রাহ্মসমাজ ও জনক রাজা – গৃহস্থের উপায় – নির্জনে বাস ও বিবেক ]

“কিন্তু ফস করে জনক রাজা হওয়া যায় না। জনক রাজা নির্জনে অনেক তপস্যা করেছিলেন। সংসারে থেকেও এক-একবার নির্জনে বাস করতে হয়। সংসারের বাহিরে একলা গিয়ে যদি ভগবানের জন্য তিনদিনও কাঁদা যায় সেও ভাল। এমনকি অবসর পেয়ে একদিনও নির্জনে তাঁর চিন্তা যদি করা যায়, সেও ভাল। লোক মাগছেলের জন্য একঘটি কাঁদে, ঈশ্বরের জন্যে কে কাঁদছে বল?

নির্জনে থেকে মাঝে মাঝে ভগবানের জন্যে সাধন করতে হয়! সংসারের ভিতর কর্মের মধ্যে থেকে, প্রথমাবস্থায় মন স্থির করতে অনেক ব্যাঘাত হয়। ফুটপাতের গাছ; যখন চারা থাকে, বেড়া না দিলে ছাগল-গরুতে খেয়ে ফেলে। প্রথমাবস্থায় বেড়া, গুঁড়ি হলে আর বেড়ার দরকার থাকে না। গুঁড়িতে হাতি বেঁধে দিলেও কিছু হয় না।

“রোগটি হচ্ছে বিকার। আবার যে-ঘরে বিকারের রোগী, সেই ঘরে জলের জালা আর আচার তেঁতুল। যদি বিকারের রোগী আরাম করতে চাও, ঘর থেকে ঠাঁই নাড়া করতে হবে। সংসারী জীব বিকারের রোগী; বিষয় – জলের জালা; বিষয়ভোগতৃষ্ণা – জলতৃষ্ণা। আচার তেঁতুল মনে করলেই মুখে জল সরে, কাছে আনতে হয় না; এরূপ জিনিসও ঘরে রয়েছে; যোষিৎসঙ্গ। তাই নির্জনে চিকিৎসা দরকার।

“বিবেক-বৈরাগ্য লাভ করে সংসার করতে হয়। সংসার-সমুদ্রে কামক্রোধাদি কুমির আছে। হলুদ গায়ে মেখে জলে নামলে কুমিরের ভয় থাকে না। বিবেক-বৈরাগ্য – হলুদ। সদসৎ বিচারের নাম বিবেক। ঈশ্বরই সৎ, নিত্যবস্তু। আর সব অসৎ, অনিত্য; দুদিনের জন্য। এইটি বোধ আর ঈশ্বরে অনুরাগ। তাঁর উপর টান – ভালবাসা। গোপীদের কৃষ্ণের উপর যেরূপ টান ছিল। একটা গান শোন:

[আর উপায় – ঈশ্বরে অনুরাগ – গোপীদের মতো টান বা স্নেহ ]

বংশী বাজিল ওই বিপিনে ৷
(আমার তো না গেলে নয়) (শ্যাম পথে দাঁড়ায়ে আছে)
তোরা যাবি কি না যাবি বল গো ৷৷
তোদের শ্যাম কথার কথা ৷
আমার শ্যাম অন্তরের ব্যথা (সই) ৷৷

তোদের বাজে বাঁশী কানের কাছে ৷
বাঁশী আমার বাজে হৃদয়মাঝে ৷৷
শ্যামের বাঁশী বাজে, বেরাও রাই ৷
তোমা বিনা কুঞ্জের শোভা নাই ৷৷”

ঠাকুর অশ্রুপূর্ণ নয়নে এই গান গাইতে গাইতে কেশবাদি ভক্তদের বললেন, “রাধাকৃষ্ণ মানো আর নাই মানো, এই টানটুকু নাও, ভগবানের জন্য কিসে এইরূপ ব্যাকুলতা হয়, চেষ্টা কর। ব্যাকুলতা থাকলেই তাঁকে লাভ করা যায়।”

-১৮৮২, ২৭শে অক্টোবর-

……………………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : পঞ্চম অধ্যায় : ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!