কেশবকে শিক্ষা – গুরুগিরি ও ব্রাহ্মসমাজে – গুরু এক সচ্চিদানন্দ
পিতাঽসি লোকস্য চরাচরস্য, ত্বমস্য পূজ্যশ্চ গুরুর্গরীয়ান্ ৷
ন ত্বৎসমোঽস্ত্যভ্যধিকঃ কুতোঽন্যো, লোকত্রয়েঽপ্যপ্রতিমপ্রভাব ৷৷
[গীতা – ১১।৪৩]
সকলে আনন্দ করিতেছেন। ঠাকুর কেশবকে বলিতেছেন, “তুমি প্রকৃতি দেখে শিষ্য কর না, তাই এইরূপ ভেঙে ভেঙে যায়।
“মানুষগুলি দেখতে সব একরকম, কিন্তু ভিন্ন প্রকৃতি। কারু ভিতর সত্ত্বগুণ বেশি, কারু রজোগুণ বেশি, কারু তমোগুণ। পুলিগুলি দেখতে সব একরকম। কিন্তু কারু ভিতর ক্ষীরের পোর, কারু ভিতর নারিকেলের ছাঁই, কারু ভিতর কলায়ের পোর। (সকলের হাস্য)
“আমার কি ভাব জানো? আমি খাই-দাই থাকি, আর মা সব জানে। আমার তিন কথাতে গায়ে কাঁটা বেঁধে। গুরু, কর্তা আর বাবা।
“গুরু এক সচ্চিদানন্দ। তিনিই শিক্ষা দিবেন। আমার সন্তানভাব। মানুষ গুরু মেলে লাখ লাখ। সকলেই গুরু হতে চায়। শিষ্য কে হতে চায়?
“লোকশিক্ষা দেওয়া বড় কঠিন। যদি তিনি সাক্ষাৎকার হন আর আদেশ দেন, তাহলে হতে পারে। নারদ শুকদেবাদির আদেশ হয়েছিল। শঙ্করের আদেশ হয়েছিল। আদেশ না হলে কে তোমার কথা শুনবে? কলকাতার হুজুগ তো জানো! যতক্ষণ কাঠে জ্বাল, দুধ ফোঁস করে ফোলে। কাঠ টেনে নিলে কোথাও কিছু নাই। কলকাতার লোক হুজুগে। এই এখানটায় কুয়া খুঁড়ছে।
– বলে জল চাই। সেখানে পাথর হল তো ছেড়ে দিলে! আবার এক জায়গায় খুঁড়তে আরম্ভ করলে। সেখানে বালি মিলে গেল; ছেড়ে দিলে! আর-এক জায়গায় খুঁড়তে আরম্ভ হল! এইরকম!
“আবার মনে-মনে আদেশ হলে হয় না। তিনি সত্য-সত্যই সাক্ষাৎকার হন, আর কথা কন। তখন আদেশ হতে পারে। সে-কথার জোর কত? পর্বত টলে যায়। শুধু লেকচার? দিন কতক লোকে শুনবে, তারপর ভুলে যাবে। কথা অনুসারে সে কাজ করবে না।”
[পূর্বকথা – ভাবচক্ষে হালদার-পুকুর দর্শন ]
“ও-দেশে হালদার-পুকুর বলে একটা পুকুর আছে। পাড়ে রোজ সকালবেলা বাহ্যে করে রাখত। যারা সকালবেলা আসে, খুব গালাগাল দেয়। আবার তার পরদিন সেইরূপ। বাহ্যে আর থামে না (সকলের হাস্য) লোকে কোম্পানিকে জানালে। তারা একটা চাপরাসী পাঠিয়ে দিলে। সে যখন একটা কাগজ মেরে দিলে, ‘বাহ্যে করিও না’ তখন সব বন্ধ! (সকলের হাস্য)
“লোকশিক্ষা দেবে তার চাপরাস চাই। না হলে হাসির কথা হয়ে পড়ে। আপনারই হয় না, আবার অন্যলোক। কানা কানাকে পথ দেখিয়ে যাচ্ছে। (হাস্য) হিতে-বিপরীত। ভগবানলাভ হলে অর্ন্তদৃষ্টি হয়, কার কি রোগ বোঝা যায়। উপদেশ দেওয়া যায়।”
[“অহংকারবিমূঢ়াত্মা কর্তাহম্ ইতি মন্যতে” ]
“আদেশ না থাকলে ‘আমি লোকশিক্ষা দিচ্ছি’ এই অহংকার হয়। অহংকার হয় অজ্ঞানে। অজ্ঞানে বোধ হয়, আমি কর্তা। ঈশ্বর কর্তা, ঈশ্বরই সব করছেন, আমি কিছু করছি না – এ-বোধ হলে তো সে জীবন্মুক্ত। ‘আমি কর্তা’, ‘আমি কর্তা’ – এই বোধ থেকেই যত দুঃখ, অশান্তি।”
-১৮৮২, ২৭শে অক্টোবর-
……………………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : পঞ্চম অধ্যায় : অষ্টম পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….