শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন ও বেদান্ত সম্বন্ধে গুহ্য ব্যাখ্যা –
অদ্বৈতবাদ ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ – জগৎ কি মিথ্যা?
Identity of the Undifferentiated and Differentiated
জনাইয়ের মুখুজ্জেরা চলিয়া গেলেন। মণি ভাবিতেছেন, বেদান্তদর্শন মতে “সব স্বপ্নবৎ”। তবে জীবজগৎ, আমি – এ-সব কি মিথ্যা?
মণি একটু একটু বেদান্ত দেখিয়াছেন। আবার বেদান্তের অস্ফুট প্রতিধ্বনি কান্ট্, হেগেল প্রভৃতি জার্মান পণ্ডিতদের বিচার একটু পড়েছেন। কিন্তু ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দুর্বল মানুষের ন্যায় বিচার করেন নাই, জগন্মাতা তাঁহাকে সমস্ত দর্শন১ করাইয়াছেন। মণি তাই ভাবছেন।
কিয়ৎক্ষণ পরেই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মণির সহিত একাকী পশ্চিমের গোল বারান্দায় কথা কহিতেছেন। সম্মুখে গঙ্গা – কুলকুল রবে দক্ষিণে প্রবাহিত হইতেছেন। শীতকাল – সূর্যদেব এখনও দেখা যাইতেছেন দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। যাঁহার জীবন বেদময় – যাঁহার শ্রীমুখনিঃসৃত বাক্য বেদান্তবাক্য – যাঁহার শ্রীমুখ দিয়া শ্রীভগবান কথা কন – যাঁহার কথামৃত লইয়া বেদ, বেদান্ত, শ্রীভাগবত গ্রন্থাকার ধারণ করে, সেই অহেতুককৃপাসিন্ধু পুরুষ গুরুরূপ করিয়া কথা কহিতেছেন।
মণি – জগৎ কি মিথ্যা?
শ্রীরামকৃষ্ণ – মিথ্যা কেন? ও-সব বিচারের কথা।
“প্রথমটা, ‘নেতি’ ‘নেতি’ বিচার করবার সময়, তিনি জীব নন, জগৎ নন, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব নন, হয়ে যায়; – ‘এ-সব স্বপ্নবৎ’ হয়ে যায়। তারপর অনুলোম বিলোম। তখন তিনিই জীবজগৎ হয়েছেন বোধ হয়।
“তুমি সিঁড়ি ধরে ধরে ছাদে উঠলে। কিন্তু যতক্ষণ ছাদবোধ ততক্ষণ সিঁড়িও আছে। যার উঁচুবোধ আছে, তার নিচুবোধও আছে।
“আবার ছাদে উঠে দেখলে – যে জিনিসে ছাদ তৈয়ের হয়েছে – ইট, চুন, সুড়কি – সেই জিনিসেই সিঁড়ি তৈয়ের হয়েছে।
“আর যেমন বেলের কথা বলেছি।
“যার অটল আছে তার টলও আছে।
“আমি যাবার নয়। ‘আমি ঘট’ যতক্ষণ রয়েছে ততক্ষণ জীবজগৎও রয়েছে। তাঁকে লাভ করলে দেখা যায় তিনিই জীবজগৎ হয়েছেন। – শুধু বিচারে হয় না।
“শিবের দুই অবস্থা। যখন সমাধিস্থ – মহাযোগে বসে আছেন – তখন আত্মারাম। আবার যখন সে অবস্থা থেকে নেবে আসেন – একটু ‘আমি’ থাকে তখন ‘রাম’ ‘রাম’ করে নৃত্য করেন!”
ঠাকুর শিবের অবস্থা বর্ণনা করিয়া কি নিজের অবস্থা ইঙ্গিত করিয়া বলিতেছেন?
সন্ধ্যা হইল। ঠাকুর জগন্মাতার নাম ও তাঁহার চিন্তা করিতেছেন। ভক্তেরাও নির্জনে গিয়া যে যার ধ্যানাদি করিতে লাগিলেন। এদিকে ঠাকুরবাড়িতে মা-কালীর মন্দিরে, শ্রীশ্রীরাধাকান্তের মন্দিরে ও দ্বাদশ শিবমন্দিরে আরতি হইতে লাগিল।
আজ কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতিয়া তিথি। সন্ধ্যার কিয়ৎক্ষণ পরে চন্দ্রোদয় হইল। সে আলো মন্দির শীর্ষ, চতুর্দিকের তরুলতা ও মন্দিরের পশ্চিমে ভাগীরথীবক্ষে পড়িয়া অপূর্ব শোভা ধারণ করিয়াছে। এই সময় সেই পূর্বপরিচিত ঘরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বসিয়া আছেন। মণি মেঝেতে বসিয়া আছেন। মণি বৈকালে বেদান্ত সম্বন্ধে যে-কথার অবতারণা করিয়াছিলেন ঠাকুর আবার সেই কথাই কহিতেছেন।
সব চিন্ময়দর্শন – মথুরকে খাজাঞ্চীর পত্র লেখা
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) – জগৎ মিথ্যা কেন হবে? ও-সব বিচারের কথা। তাঁকে দর্শন হলে তখন বোঝা যায় যে তিনিই জীবজগৎ হয়েছেন।
“আমায় মা কালীঘরে দেখিয়া দিলেন যে মা-ই সব হয়েছেন। দেখিয়া দিলেন সব চিন্ময়! – প্রতিমা চিন্ময়! – বেদী চিন্ময়! – কোশাকুশি চিন্ময়! – চৌকাট চিন্ময়! – মার্বেলের পাথর – সব চিন্ময়!
“ঘরের ভিতর দেখি – সব যেন রসে রয়েছে! সচ্চিদানন্দ রসে।
“কালীঘরের সম্মুখে একজন দুষ্ট লোককে দেখলাম, – কিন্তু তারও ভিতরে তাঁর শক্তি জ্বলজ্বল করছে দেখলাম!
“তাইতো বিড়ালকে ভোগের লুচি খাইয়েছিলাম। দেখলাম মা-ই সব হয়েছেন – বিড়াল পর্যন্ত। তখন খাজাঞ্চী সেজোবাবুকে চিঠি লিখলে যে ভটচার্জি মহাশয় ভোগের লুচি বিড়ালদের খাওয়াচ্ছেন। সেজোবাবু আমার অবস্থা বুঝতো। পত্রের উত্তরে লিখলে, ‘উনি যা করেন তাতে কোন কথা বলো না।’
“তাঁকে লাভ করলে এইগুলি ঠিক দেখা যায়। তিনিই জীব, জগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়েছেন।
“তবে যদি তিনি ‘আমি’ একেবারে পুঁছে দেন তখন যে কি হয় মুখে বলা যায় না। রামপ্রসাদ যেমন বলেছেন –
‘তখন তুমি ভাল কি আমি ভাল সে তুমিই বুঝবে।’
“সে অবস্থাও আমার এক-একবার হয়।
“বিচার করে একরকম দেখা যায়, – আর তিনি যখন দেখিয়ে দেন তখন আর একরকম দেখা যায়।”
……………………………………………
১Revelation: Transcendental Perception: God-vision.
-১৮৮৩, ১৬ই ডিসেম্বর-
………………..
রামকৃষ্ণ কথামৃত : ষোড়শ অধ্যায় : দশম পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….