প্রহ্লাদচরিত্র শ্রবণ ও ভাবাবেশ – যোষিৎসঙ্গ নিন্দা
দক্ষিণেশ্বরে গুরুরূপী শ্রীরামকৃষ্ণ অন্তরঙ্গসঙ্গে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে সেই পূর্বপরিচিত ঘরে মেঝেতে বসিয়া প্রহ্লাদ চরিত্র শুনিতেছেন। বেলা ৮ টা হইবে। শ্রীযুক্ত রামলাল ভক্তমাল গ্রন্থ হইতে প্রহ্লাদিচরিত্র পড়িতেছেন।
আজ শনিবার, (১লা পৌষ) অগ্রাহায়ণ কৃষ্ণা প্রতিপদ; ১৫ই ডিসেম্বর, ১৮৮ত খ্রীষ্টাব্দ। মণি দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সঙ্গে তাঁহার পদছায়ায় বাস করিতেছেন; – তিনি ঠাকুরের কাছে বসিয়া প্রহ্লাদচরিত্র শুনিতেছেন। ঘরে শ্রীযুক্ত রাখাল, লাটু, হরিশ; কেহ বসিয়া শুনিতেছেন, – কেহ যাতায়াত করিতেছেন। হাজরা বারান্দায় আছেন।
ঠাকুর প্রহ্লাদচরিত্র কথা শুনিতে শুনিতে ভাবাবিষ্ট হইতেছেন। যখন হিরণ্যকশিপু বধ হইল, নৃসিংহের রুদ্রমূর্তি দেখিয়া ও সিংহনাদ শুনিয়া ব্রহ্মাদি দেবতারা প্রলয়াশঙ্কায় প্রহ্লাদকেই নৃসিংহের কাছে পাঠাইয়া দিলেন। প্রহ্লাদ বালকের ন্যায় স্তব করিতেছেন। ভক্তবৎসল স্নেহে প্রহ্লাদের গা চাটিতেছেন। ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়া বলিতেছেন, “আহা! আহা! ভক্তের উপর কি ভালবাসা!” বলিতে বলিতে ঠাকুরের ভাবসমাধি হইল! স্পন্দহীন, – চক্ষের কোণে প্রেমাশ্রু!
ভাব উপশমের পর ঠাকুর ছোট খাটখানিতে গিয়া বসিয়াছেন। মণি মেঝের উপর তাঁহার পাদমূলে বসিলেন। ঠাকুর তাঁহার সঙ্গে কথা কহিতেছেন। ঈশ্বরের পথে থাকিয়া যাহারা স্ত্রীসঙ্গ করে তাহাদের প্রতি ঠাকুর ক্রোধ ও ঘৃণা প্রকাশ করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – লজ্জা হয় না। ছেলে হয়ে গেছে আবার স্ত্রীসঙ্গ! ঘৃণা করে না! – পশুদের মতো ব্যবহার! নাল, রক্ত, মল, মূত্র – এ-সব ঘৃণা করে না! যে ভগবানের পাদপদ্ম চিন্তা করে, তার পরমাসুন্দরী রমণি চিতার ভস্ম বলে বোধ হয়। যে শরীর থাকবে না – যার ভিতর কৃমি, ক্লেদ, শ্লেষ্মা, যতপ্রকার অপবিত্র জিনিস – সেই শরীর নিয়ে আনন্দ। লজ্জা হয় না!
ঠাকুরের প্রেমানন্দ ও মা-কালীর পূজা
মণি চুপ করিয়া হেঁটমুখ হইয়া আছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আবার বলিতেছেন – তাঁর প্রেমের এ কবিন্দু যদি কেউ পায় কামিনী-কাঞ্চন অতি তুচ্ছ বলে বোধ হয়। মিছরির পানা পেলে চিটেগুড়ের পানা তুচ্ছ হয়ে যায়। তাঁকে ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা করলে, তাঁর নামগুণ সর্বদা কীর্তন করলে – তাঁর উপর ভালবাসা ক্রমে হয়।
এই বলিয়া ঠাকুর প্রেমোন্মত্ত হইয়া ঘরের মধ্যে নাচিয়া বেড়াইতে লাগিলেন ও গান গাইতে লাগিলেন-
সুরধনীর তীরে হরি বলে কে, বুঝি প্রেমদাতা নিতাই এসেছে।
(নিতাই নইলে প্রাণ জুড়াবে কিসে)।
প্রায় ১০টা বাজে। শ্রীযুক্ত রামলাল কালীঘরে মা-কালীর নিত্যপূজা সাঙ্গ করিয়াছেন। ঠাকুর মাকে দর্শন করিবার জন্য কালীঘরে যাইতেছেন। মণি সঙ্গে আছেন। মন্দিরে প্রবিষ্ট হইয়া ঠাকুর আসনে উপবিষ্ট হইলেন। দুই-একটি ফুল মার চরণে দিলেন। নিজের মাথায় ফুল দিয়া ধ্যান করিতেছেন। এইবার গীতচ্ছলে মার স্তব করিতেছেন:
ভবহারা ভয়হারা নাম শুনেছি তোমার।
তাইতে এবার দিয়েছি ভার, তারো তারো না তারো মা।
ঠাকুর কালীঘর হইতে ফিরিয়া আসিয়া তাঁর ঘরের দক্ষিণ-পূর্ব বারান্দায় বসিয়াছেন। বেলা ১০টা হইবে। এখনও ঠাকুরদের ভোগ ও ভোগারতি হয় নাই। মা-কালী ও রাধাকান্তের প্রসাদি মাখন ও ফলমূল হইতে কিছু লইয়া ঠাকুর জলযোগ করিয়াছেন। রাখাল প্রভৃতি ভক্তেরাও কিছু কিছু পাইয়াছেন।
ঠাকুরের কাছে বসিয়া রাখাল Smiles’ Self-Help পড়িতেছেন, – Lord Erskine-এর বিষয়।
নিষ্কামকর্ম – পূর্ণজ্ঞানী গ্রন্থ পড়ে না
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – ওতে কি বলছে?
মাস্টার – সাহেব ফলাকাঙ্ক্ষা না করে কর্তব্য কর্ম করতেন, – এই কথা বলছে। নিষ্কামকর্ম।
শ্রীরামকৃষ্ণ – তবে তো বেশ! কিন্তু পূর্ণজ্ঞানের লক্ষণ – একখানাও পুস্তক সঙ্গে থাকবে না। যেমন শুকদেব – তাঁর সব মুখে।
“বইয়ে – শাস্ত্রে – বালিতে চিনিতে মিশেল আছে। সাধু চিনিটুকু লয়ে বালি ত্যাগ করে। সাধু সার গ্রহণ করে।”
শুকদেবাদির নাম করিয়া ঠাকুর কি নিজের অবস্থা ইঙ্গিত করিয়া বুঝাইতেছেন?
বৈষ্ণবচরণ কীর্তনিয়া আসিয়াছেন। তিনি সুবোলমিলন কীর্তন শুনাইলেন।
কিয়ৎক্ষণ পরে শ্রীযুত রামলাল থালায় করিয়া ঠাকুরের জন্য প্রসাদ আনিয়া দিলেন। সেবার পর – ঠাকুর কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করিলেন।
রাত্রে মণি নবতে শয়ন করিলেন। শ্রীশ্রীমা যখন দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ঠাকুরের সেবার জন্য আসিতেন তখন এই নবতেই বাস করিতেন। কয়েকমাস হইল তিনি কামারপুকুর শুভাগমন করিয়াছেন।
-১৮৮৩, ১৫ই ডিসেম্বর-
……………………
রামকৃষ্ণ কথামৃত : ষোড়শ অধ্যায় : অষ্টম পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….