শ্রীরাখাল, লাটু, জনাইয়ের মুখুজ্জে প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মণির সঙ্গে পশ্চিমের গোল বারান্দায় বসিয়া আছেন। সম্মুখে দক্ষিণবাহিনী ভাগীরথী। কাছেই করবী, বেল, জুঁই, গোলাপ, কৃষ্ণচূড়া প্রভৃতি নানা কুসুমবিভূষিত পুষ্পবৃক্ষ। বেলা ১০টা হইবে।
আজ রবিবার, অগ্রহায়ণ কৃষ্ণা দ্বিতীয়া, ১৬ই ডিসেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ। ঠাকুর মণিকে দেখিতেছেন ও গান গাইতেছেন:
তারিতে হবে মা তারা হয়েছি শরণাগত।
হইয়া রয়েছি যেন পিঞ্জরের পাখির মতো ৷৷
অসংখ্য অপরাধী আমি, জ্ঞানশূন্য মিছে ভ্রমি।
মায়াতে মোহিত হয়ে বৎসহারা গাভীর মতো ৷৷
রামচিন্তা – সীতার ন্যায় ব্যাকুলতা
“কেন? পিঞ্জরের পাখির মতো হতে যাব কেন? হ্যাক্! থু!”
কথা কহিতে কহিতে ভাবাবিষ্ট – শরীর, মন সব স্থির ও চক্ষে ধারা। কিয়ৎক্ষণ পরে বলিতেছেন, মা সীতার মতো করে দাও – একেবারে সব ভুল – দেহ ভুল, যোনি, হাত, পা, স্তন – কোনদিকে হুঁশ নাই। কেবল এক চিন্তা – ‘কোথায় রাম!’
কিরূপ ব্যাকুল হলে ঈশ্বরলাভ হয় – মণিকে এইটি শিখাইবার জন্যই কি ঠাকুরের সীতার উদ্দীপন হইল? সীতা রামময়জীবিতা, – রামচিন্তা করে উন্মাদিনী – দেহ যে এমন প্রিয় তাহাও ভুলে গেছেন!
বেলা ৪টা বাজিয়াছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে সেই ঘরে বসিয়া আছেন। জনাইয়ের মুখুজ্জেবাবু একজন আসিয়াছেন – তিনি শ্রীযুক্ত প্রাণকৃষ্ণের জ্ঞাতি। তাঁহার সঙ্গে একটি শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ বন্ধু। মণি, রাখাল, লাটু, হরিশ, যোগীন প্রভৃতি ভক্তেরাও আছেন।
যোগীন দক্ষিণেশ্বরের সাবর্ণ চৌধুরীদের ছেলে। তিনি আজকাল প্রায় প্রত্যহ বৈকালে ঠাকুরকে দর্শন করিতে আসেন ও রাত্রে চলিয়া যান। যোগীন এখনও বিবাহ করেন নাই।
মুখুজ্জে (প্রণামনন্তর) – আপনাকে দর্শন করে বড় আনন্দ হল।
শ্রীরামকৃষ্ণ – তিনি সকলের ভিতরই আছেন। সকলের ভিতর সেই সোনা, কোনখানে বেশি প্রকাশ। সংসারে অনেক মাটি চাপা।
মুখুজ্জে (সহাস্য) – মহাশয়, ঐহিক পারত্রিক কি তফাত?
শ্রীরামকৃষ্ণ – সাধনের সময় ‘নেতি’ ‘নেতি’ করে ত্যাগ করতে হয়। তাঁকে লাভের পর বুঝা যায় তিনিই সব হয়েছেন।
“যখন রামচন্দ্রের বৈরাগ্য হল দশরথ বড় ভাবিত হয়ে বশিষ্ঠদেবের শরণাগত হলেন – যাতে রাম সংসারত্যাগ না করেন। বশিষ্ঠ রামচন্দ্রের কাছে গিয়ে দেখেন, তিনি বিমনা হয়ে বসে আছেন – অন্তরে তীব্র বৈরাগ্য। বশিষ্ঠ বললেন, রাম, তুমি সংসারত্যাগ করবে কেন? সংসার কি তিনি ছাড়া? আমার সঙ্গে বিচার কর। রাম দেখিলেন, সংসার সেই পরব্রহ্ম থেকেই হয়েছে, – তাই চুপ করে রহিলেন।
“যেমন যে জিনিস থেকে ঘোল, সেই জিনিস থেকে মাখম। তখন ঘোলেরই মাখম, মাখমেরই ঘোল। অনেক কষ্টে মাখম তুললে (অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞান হল); – তখন দেখছ যে মাখম থাকলেই ঘোলও আছে, – যেখানে মাখম সেইখানেই ঘোল। ব্রহ্ম আছেন বোধ থাকলেই – জীব, জগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্বও আছে।”
ব্রহ্মজ্ঞানের একমাত্র উপায়
“ব্রহ্ম যে কি বস্তু মুখে বলা যায় না। সব জিনিস উচ্ছিষ্ট হয়েছে (অর্থাৎ মুখে বলা হয়েছে), কিন্তু ব্রহ্ম কি, – কেউ মুখে বলতে পারে নাই। তাই উচ্ছিষ্ট হয় নাই। এ-কথাটি বিদ্যাসাগরকে বলেছিলাম – বিদ্যাসাগর শুনে ভারী খুশী।
“বিষয়বুদ্ধির লেশ থাকলে এই ব্রহ্মজ্ঞান হয় না। কামিনী-কাঞ্চন মনে আদৌ থাকবে না, তবে হবে। গিরিরাজকে পার্বতী বললেন, ‘বাবা, ব্রহ্মজ্ঞান যদি চাও তাহলে সাধুসঙ্গ কর’।”
ঠাকুর কি বলছেন, সংসারী লোক বা সন্ন্যাসী যদি কামিনী-কাঞ্চন নিয়ে থাকে তাহলে ব্রহ্মজ্ঞান হয় না?
যোগভ্রষ্ট – ব্রহ্মজ্ঞানের পর সংসার
শ্রীরামকৃষ্ণ আবার মুখুজ্জেকে সম্বোধন করে বলছেন, “তোমাদের ধন ঐশ্বর্য আছে অথচ ঈশ্বরকে ডাকছ – এ খুব ভাল। গীতায় আছে যারা যোগভ্রষ্ট তারাই ভক্ত হয়ে ধনীর ঘরে জন্মায়।”
মুখুজ্জে (বন্ধুর প্রতি, সহাস্যে) – শুচীনাং শ্রীমতাং গেহে যোগভ্রষ্টোঽভিজায়তে।
শ্রীরামকৃষ্ণ – তিনি মনে করলে জ্ঞানীকেও সংসারে রাখতে পারেন। তাঁর ইচ্ছাতে জীবজগৎ হয়েছে। তিনি ইচ্ছাময় –
মুখুজ্জে (সহাস্যে) – তাঁর আবার ইচ্ছা কি? তাঁর কি কিছু অভাব আছে?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – তাতেই বা দোষ কি? জল স্থির থাকলেও জল, – তরঙ্গ হলেও জল।
জীবজগৎ কি মিথ্যা?
“সাপ চুপ করে কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকলেও সাপ, – আবার তির্যগ্গতি হয়ে এঁকেবেঁকে চললেও সাপ।
“বাবু যখন চুপ করে আছে তখনও যে ব্যক্তি, – যখন কাজ করছে তখনও সেই ব্যক্তি।
“জীবজগৎকে বাদ দেবে কেমন করে – তাহলে যে ওজনে কম পড়ে। বেলের বিচি, খোলা বাদ দিলে সমস্ত বেলের ওজন পাওয়া যায় না।
“ব্রহ্ম নির্লিপ্ত। বায়ুতে সুগন্ধ দুর্গন্ধ পাওয়া যায়, কিন্তু বায়ু নির্লিপ্ত। ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ। সেই আদ্যাশক্তিতেই জীবজগৎ হয়েছে।”
সমাধিযোগের উপায় – ক্রন্দন। ভক্তিযোগ ও ধ্যানযোগ
মুখুজ্জে – কেন যোগভ্রষ্ট হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ – ‘গর্ভে ছিলাম যোগে ছিলাম, ভূমে পড়ে খেলাম মাটি। ওরে ধাত্রীতে কেটেছে নাড়ী, মায়ার বেড়ি কিসে কাটি।’
“কামিনী-কাঞ্চনই মায়া। মন থেকে ওই দুটি গেলেই যোগ। আত্মা – পরমাত্মা চুম্বক পাথর, জীবাত্মা যেন একটি ছুঁচ – তিনি টেনে নিলেই যোগ। কিন্তু ছুঁচে যদি মাটি মাখা থাকে চুম্বকে টানে না, মাটি সাফ করে দিলে আবার টানে। কামিনী-কাঞ্চন মাটি পরিষ্কার করতে হয়।”
মুখুজ্জে – কিরূপে পরিষ্কার হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ – তাঁর জন্য ব্যকুল হয়ে কাঁদ – সেই জল মাটিতে লাগলে ধুয়ে ধুয়ে যাবে। যখন খুব পরিষ্কার হবে তখন চুম্বকে টেনে লবে। – যোগ তবেই হবে।
মুখুজ্জে – আহা কি কথা!
শ্রীরামকৃষ্ণ – তাঁর জন্য কাঁদতে পারলে দর্শন হয়। যোগ সিদ্ধ হলেই সমাধি। কাঁদলে কুম্ভক আপনি হয়, তারপর সমাধি।
“আর-এক আছে ধ্যান। সহস্রারে শিব বিশেষরূপে আছেন। তাঁর ধ্যান। শরীর সরা, মন-বুদ্ধি জল। এই জলে সেই সচ্চিদানন্দ সূর্যের প্রতিবিম্ব পড়ে। সেই প্রতিবিম্ব সূর্যের ধ্যান করতে করতে সত্য সূর্য তাঁর কৃপায় দর্শন হয়।
সাধুসঙ্গ কর ও আমমোক্তারি (বকলমা) দাও
কিন্তু সংসারী লোকের সর্বদাই সাধুসঙ্গ দরকার। সকলেরই দরকার। সন্ন্যাসীরও দরকার। তবে সংসারীদের বিশেষতঃ, রোগ লেগেই আছে – কামিনী-কাঞ্চনের মধ্যে সর্বদা থাকতে হয়।”
মুখুজ্জে – আজ্ঞা, রোগ লেগেই আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ – তাঁকে আমমোক্তারি (বকলমা) দাও – যা হয় তিনি করুন। তুমি বিড়ালছানার মতো কেবল তাঁকে ডাকো – ব্যাকুল হয়ে। তার মা যেখানে তাকে রাখে – সে কিছু জানে না; কখনও বিছানার উপর রাখছে, কখনও হেঁশালে।
প্রবর্তক শাস্ত্র পড়ে – সাধনার পর তবে দর্শন
মুখুজ্জে – গীতা প্রভৃতি শাস্ত্র পড়া ভাল।
শ্রীরামকৃষ্ণ – শুধু পড়লে শুনলে কি হবে? কেউ দুধ শুনেছে, কেউ দুধ দেখেছে, কেউ খেয়েছে। ঈশ্বরকে দর্শন করা যায় – আবার তাঁর সঙ্গে আলাপ করা যায়।
“প্রথমে প্রবর্তক। সে পড়ে, শুনে। তারপর সাধক, – তাঁকে ডাকছে, ধ্যান চিন্তা করছে, নামগুণকীর্তন করছে। তারপর সিদ্ধ – তাঁকে বোধ বোধ করেছে, দর্শন করেছে। তারপর সিদ্ধের সিদ্ধ; যেমন চৈতন্যদেবের অবস্থা – কখনও বাৎসল্য, কখনও মধুরভাব।”
মণি, রাখাল, যোগীন লাটু প্রভৃতি ভক্তেরা এই সকল দেবদুর্লভ তত্ত্বকথা অবাক্ হইয়া শুনিতেছেন।
এইবার মুখুজ্জেরা বিদায় লইবেন। তাঁহারা প্রণাম করিয়া দাঁড়াইলেন। ঠাকুরও যেন তাঁদের সম্মানর্থ উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
মুখুজ্জে (সহাস্যে) – আপনার আবার উঠা বসা। –
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – আবার উঠা বসাতেই বা ক্ষতি কি? জল স্থির হলেও জল, – আর হেললে দুললেও জল। ঝড়ের এঁটো পাতা – হাওয়াতে যেদিকে লয়ে যায়। আমি যন্ত্র তিনি যন্ত্রী।
-১৮৮৩, ১৬ই ডিসেম্বর-
……………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : ষোড়শ অধ্যায় : নবম পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….