ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

রাখাল, রাম, সুরেন্দ্র, লাটু প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে

আহারান্তে ঠাকুর একটু বিশ্রাম করিতেছেন। আজ ২৪শে ডিসেম্বর। বড়দিনের ছুটি আরম্ভ হইয়াছে। কলিকাতা হইতে সুরেন্দ্র, রাম প্রভৃতি ভক্তেরা ক্রমে ক্রমে আসিতেছেন।

বেলা একটা হইবে। মণি একাকী ঝাউতলায় বেড়াইতেছেন, এমন সময় রেলের নিকট দাঁড়াইয়া হরিশ উচ্চৈঃস্বরে মণিকে বলিতেছেন – প্রভু ডাকছেন, – শিবসংহিতা পড়া হবে।

শিবসংহিতায় যোগের কথা আছে, – ষট্‌চক্রের কথা আছে।

মণি ঠাকুরের ঘরে আসিয়া প্রণাম করিয়া উপবেশন করিলেন। ঠাকুর খাটের উপর, ভক্তেরা মেঝের উপর বসিয়া আছেন। শিবসংহিতা এখন আর পড়া হইল না। ঠাকুর নিজেই কথা কহিতেছেন।

প্রেমাভক্তি ও শ্রীবৃন্দাবনলীলা – অবতার ও নরলীলা

শ্রীরামকৃষ্ণ – গোপীদের প্রেমাভক্তি। প্রেমাভক্তিতে দুটি জিনিস থাকে, – অহংতা আর মমতা। আমি কৃষ্ণকে সেবা না করলে কৃষ্ণের অসুখ হবে, – এর নাম অহংতা। এতে ঈশ্বরবোধ থাকে না।

“মমতা, – ‘আমার আমার’ করা। পাছে পায়ে কিছু আঘাত লাগে, গোপীদের এত মমতা, তাদের সূক্ষ্ম শরীর শ্রীকৃষ্ণের চরণতলে থাকত।

“যশোদা বললেন, তোদের চিন্তামণি-কৃষ্ণ জানি না, আমার গোপাল! গোপীরাও বলছে, ‘কোথায় আমার প্রাণবল্লভ! আমার হৃদয়বল্লভ!’ ঈশ্বরবোধ নাই।

“যেমন ছোট ছেলেরা, দেখেছি, বলে, ‘আমার বাবা’। যদি কেউ বলে, ‘না, তোর বাবা নয়’; – তাহলে বলবে ‘না, আমার বাবা।’

“নরলীলায় অবতারকে ঠিক মানুষের মতো আচরণ করতে হয়, – তাই চিনতে পারা কঠিন। মানুষ হয়েছেন তো ঠিক মানুষ। সেই ক্ষুধা-তৃষ্ণা, রোগশোক, কখন বা ভয় – ঠিক মানুষের মতো। রামচন্দ্র সীতার শোকে কাতর হয়ছিলেন। গোপাল নন্দের জুতো মাথায় করে নিয়ে গিছলেন – পিঁড়ে বয়ে নিয়ে গিছলেন।

“থিয়েটারে সাধু সাজে, সাধুর মতই ব্যবহার করবে, – যে রাজা সেজেছে তার মতো ব্যবহার করবে না। যা সেজেছে তাই অভিনয় করবে।

“একজন বহুরূপী সেজেছে, ‘ত্যাগী সাধু’। সাজটি ঠিক হয়েছে দেখে বাবুরা একটি টাকা দিতে গেল। সে নিলে না, উঁহু করে চলে গেল। গা-হাত-পা ধুয়ে যখন সহজ বেশে এলো, বললে, ‘টাকা দাও’। বাবুরা বললে, ‘এই তুমি টাকা নেবো না বলে চলে গেলে, আবার টাকা চাইছ?’ সে বললে, ‘তখন সাধু সেজেছি, টাকা নিতে নাই।’

“তেমনি ঈশ্বর, যখন মানুষ হন, ঠিক মানুষের মতো ব্যবহার করেন।

“বৃন্দাবনে গেলে অনেক লীলার স্থান দেখা যায়।”

সুরেন্দ্রের প্রতি উপদেশ – ভক্তসেবার্থ দান ও সত্যকথা

সুরেন্দ্র – আমরা ছুটিতে গিছলাম; বড় “পয়সা দাও”, “পয়সা দাও” করে। ‘দাও’ ‘দাও’ করতে লাগল – পাণ্ডারা আর সব। তাদের বললুম, ‘আমরা কাল কলকাতা যাব’। বলে, সেই দিনই পলায়ন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – ও কি! ছি! কাল যাব বলে আজ পালানো! ছি!

সুরেন্দ্র (লজ্জিত হইয়া) – বনের মধ্যে মাঝে মাঝে বাবাজীদের দেখেছিলাম, নির্জনে বসে সাধন-ভজন করছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – বাবাজীদের কিছু দিলে?

সুরেন্দ্র – আজ্ঞে, না।

শ্রীরামকৃষ্ণ – ও ভাল কর নাই। সাধুভক্তদের কিছু দিতে হয়। যাদের টাকা আছে, তাদের ওরূপ লোক সামনে পড়লে কিছু দিতে হয়।

শ্রীমুখ-কথিত চরিতামৃত – মথুর সঙ্গে শ্রীবৃন্দাবন-দর্শন, ১৮৬৮

“আমি বৃন্দাবনে গিছলাম – সেজোবাবুদের সঙ্গে।

“মথুরার ধ্রুবঘাট যাই দেখলাম অমনি দপ্‌ করে দর্শন হল, বসুদেব কৃষ্ণ কোলে যমুনা পার হচ্ছেন।

“আবার সন্ধ্যার সময় যমুনাপুলিনে বেড়াচ্ছি, বালির উপর ছোট ছোট খোড়োঘর। বড় কুলগাছ। গোধূলির সময় গাভীরা গোষ্ঠ থেকে ফিরে আসছে। দেখলাম হেঁটে যমুনা পার হচ্ছে। তারপরেই কতকগুলি রাখাল গাভীদের নিয়ে পার হচ্ছে।

“যেই দেখা, অমনি ‘কোথায় কৃষ্ণ!’ বলে – বেহুঁশ হয়ে গেলাম।

শ্যামকুণ্ড, রাধাকুণ্ড দর্শন করতে ইচ্ছা হয়েছিল। পালকি করে আমায় পাঠিয়ে দিলে। অনেকটা পথ; লুচি, জিলিপি পালকির ভিতরে দিলে। মাঠ পার হবার সময় এই ভেবে কাঁদতে লাগলাম, ‘কৃষ্ণ রে! তুই নাই, কিন্তু সেই সব স্থান রয়েছে! সেই মাঠ, তুমি গোরু চরাতে!’

“হৃদে রাস্তায় সঙ্গে সঙ্গে পেছনে আসছিল। আমি চক্ষের জলে ভাসতে লাগলাম। বিয়ারাদের দাঁড়াতে বলতে পারলাম না!

শ্যামকুণ্ড, রাধাকুণ্ডতে গিয়ে দেখলাম, সাধুরা একটি একটি ঝুপড়ির মতো করেছে; – তার ভিতরে পিছনে ফিরে সাধন-ভজন করছে – পাছে লোকের উপর দৃষ্টিপাত হয়। দ্বাদশ বন দেখবার উপযুক্ত। বঙ্কুবিহারীকে দেখে ভাব হয়েছিল, আমি তাঁকে ধরতে গিছিলাম। গোবিনজীকে দুইবার দেখতে চাইলাম না। মথুরায় গিয়ে রাখাল-কৃষ্ণকে স্বপন দেখেছিলাম। হৃদে ও সেজোবাবুও দেখেছিল।”

দেবীভক্ত শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রের যোগ ও ভোগ

“তোমাদের যোগও আছে, ভোগও আছে।

“ব্রহ্মর্ষি, দেবর্ষি, রাজর্ষি। ব্রহ্মর্ষি, যেমন শুকদেব – একখানি বইও কাছে নাই। দেবর্ষি, যেমন নারদ। রাজর্ষি জনক, – নিষ্কামকর্ম করে।

“দেবীভক্ত ধর্ম, মোক্ষ দু-ই পায়। আবার অর্থ, কামও ভোগ করে।

“তোমাকে একদিন দেবীপুত্র দেখেছিলাম। তোমার দুই-ই আছে – যোগ আর ভোগ। না হলে তোমার চেহারা শুষ্ক হত।”

ঘাটে ঠাকুরের দেবীভক্তদর্শন – নবীন নিয়োগীর যোগ ও ভোগ

“সর্বত্যাগীর চেহারা শুষ্ক। একজন দেবীভক্তকে ঘাটে দেখেছিলাম। নিজে খাচ্ছে আর সেই সঙ্গে দেবীপূজা কচ্ছে। সন্তানভাব!

“তবে বেশি টাকা হওয়া ভাল নয়। যদু মল্লিককে এখন দেখলাম ডুবে গেছে! বেশি টাকা হয়েছে কি না।

“নবীন নিয়োগী, – তারও যোগ ও ভোগ দুই-ই আছে। দুর্গাপূজার সময় দেখি, বাপ-ব্যাটা দুজনেই চামর কচ্ছে।”

সুরেন্দ্র – আজ্ঞা, ধ্যান হয় না কেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ – স্মরণ-মনন তো আছে?

সুরেন্দ্র – আজ্ঞা, মা মা বলে ঘুমিয়ে পড়ি।

শ্রীরামকৃষ্ণ – খুব ভাল। স্মরণ-মনন থাকলেই হল।

ঠাকুর সুরেন্দ্রের ভার লইয়াছেন। আর তাঁহার ভাবনা কি?

-১৮৮৩, ২৪শে ডিসেম্বর-

……………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : সপ্তদশ অধ্যায় : তৃতীয় পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!