ভবঘুরেকথা
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও যোগশিক্ষা – শিবসংহিতা

সন্ধ্যার পর ঠাকুর ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। মণিও ভক্তদের সহিত মেঝেতে বসিয়া আছেন। যোগের বিষয় – ষট্‌চক্রের বিষয় – কথা কহিতেছেন। শিব সংহিতায় সেই সকল কথা আছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – ঈড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্নার ভিতর সব পদ্ম আছে – চিন্ময়। যেমন মোমের গাছ, – ডাল, পালা, ফল, – সব মোমের। মূলাধার পদ্মে কুলকুণ্ডলিনী শক্তি আছেন। চর্তুদল পদ্ম। যিনি আদ্যাশক্তি তিনিই সকলের দেহে কুলকুণ্ডলিনীরূপে আছেন। যেন ঘুমন্ত সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়েছে! “প্রসুপ্ত-ভুজগাকারা আধারপদ্মবাসিনী!”

(মণির প্রতি) – ভক্তিযোগে কুলকুণ্ডলিনী শীঘ্র জাগ্রত হয়। কিন্তু ইনি জাগ্রত না হলে ভগবানদর্শন হয় না। গান করে করে একাগ্রতার সহিত গাইবে – নির্জনে গোপনে –

‘জাগো মা কুলকুণ্ডলিনী! তুমি নিত্যানন্দ স্বরূপিণী,
প্রসুপ্ত-ভুজগাকারা আধারপদ্মবাসিনী।’

“গানে রামপ্রসাদ সিদ্ধ। ব্যাকুল হয়ে গান গাইলে ঈশ্বরদর্শন হয়!”

মণি – আজ্ঞা, এ-সব একবার করলে মনের খেদ মিটে যায়!

শ্রীরামকৃষ্ণ – আহা! খেদ মেটেই বটে।

“যোগের বিষয় গোটাকতক মোটামুটি তোমায় বলে দিতে হবে।”

গুরুই সব করেন – সাধনা ও সিদ্ধি – নরেন্দ্র স্বতঃসিদ্ধ

“কি জান, ডিমের ভিতর ছানা বড় না হলে পাখি ঠোকরায় না। সময় হলেই পাখি ডিম ফুটোয়।

“তবে একটু সাধনা করা দরকার। গুরুই সব করেন, – তবে শেষটা একটু সাধনা করিয়ে লন। বড় গাছ কাটবার সময় প্রায় সবটা কাটা হলে পর একটু সরে দাঁড়াতে হয়। তারপর গাছটা মড়মড় করে আপনিই ভেঙে পড়ে।

“যখন খাল কেটে জল আনে, আর-একটু কাটলেই নদীর সঙ্গে যোগ হয়ে যাবে, তখন যে কাটে সে সরে দাঁড়ায়, তখন মাটিটা ভিজে আপনিই পড়ে যায়, আর নদীর জল হুড়হুড় করে খালে আসে।

“অহংকার, উপাধি – এ-সব ত্যাগ হলেই ঈশ্বরকে দর্শন করা যায়। ‘আমি পণ্ডিত’, ‘আমি অমুকের ছেলে’, ‘আমি ধনী’, ‘আমি মানী’ – এ-সব উপাধি ত্যাগ হলেই দর্শন।

“ঈশ্বর সত্য আর সব অনিত্য, সংসার অনিত্য – এর নাম বিবেক। বিবেক না হলে উপদেশ গ্রাহ্য হয় না।

“সাধনা করতে করতে তাঁর কৃপায় সিদ্ধ হয়। একটু খাটা চাই। তারপরই দর্শন ও আনন্দলাভ।

“অমুক জায়গায় সোনার কলসী পোতা আছে শুনে লোক ছুটে যায়। আর খুঁড়তে আরম্ভ করে। খুঁড়তে খুঁড়তে মাথায় ঘাম পড়ে। অনেক খোঁড়ার পর এক জায়গায় কোদালে ঠন্‌ করে শব্দ হল; কোদাল ফেলে দেখে, কলসী বেরিয়েছে কি না। কলসী দেখে নাচতে থাকে।

“কলসী বার করে মোহর ঢেলে, হাতে করে গণে – আর খুব আনন্দ! দর্শন, – স্পর্শন, – সম্ভোগ! – কেমন?”

মণি – আজ্ঞা, হাঁ।

ঠাকুর একটু চুপ করিয়া আছেন। আবার কথা কহিতেছেন –

আমার আপনার লোক কে? একাদশী করার উপদেশ 

“আমার যারা আপনার লোক, তাদের বকলেও আবার আসবে।

“আহা, নরেন্দ্রের কি স্বভাব। মা-কালীকে আগে যা ইচ্ছা তাই বলত; আমি বিরক্ত হয়ে একদিন বলেছিলাম, ‘শ্যালা, তুই আর এখানে আসিস না।’ তখন সে আস্তে আস্তে গিয়ে তামাক সাজে। যে আপনার লোক, তাকে তিরস্কার করলেও রাগ করবে না। কি বল?”

মণি – আজ্ঞা, হাঁ।

শ্রীরামকৃষ্ণ – নরেন্দ্র স্বতঃসিদ্ধ, নিরাকারে নিষ্ঠা।

মণি (সহাস্যে) – যখন আসে একটা কাণ্ড সঙ্গে করে আনে।

ঠাকুর আনন্দে হাসিতেছেন, বলিতেছেন, “একটা কাণ্ডই বটে”।

পরদিন মঙ্গলবার, ২৫শে ডিসেম্বর, কৃষ্ণপক্ষের একাদশী। বেলা প্রায় এগারটা হইবে। ঠাকুরের এখনও সেবা হয় নাই। মণি রাখালাদি ভক্তেরা ঠাকুরের ঘরে বসিয়া আছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) – একাদশী করা ভাল। ওতে মন বড় পবিত্র হয়, আর ঈশ্বরেতে ভক্তি হয়। কেমন?

মণি – আজ্ঞা, হাঁ।

শ্রীরামকৃষ্ণ – খই-দুধ খাবে, – কেমন?

-১৮৮৩, ২৪শে ডিসেম্বর-

………………
রামকৃষ্ণ কথামৃত : সপ্তদশ অধ্যায় : চতুর্থ পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!