ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কলিকাতায় নিমন্ত্রণ –
শ্রীযুক্ত ঈশান মুখোপাধ্যায়ের বাটীতে শুভাগমন
দক্ষিণেশ্বরে কালীবাড়িতে মঙ্গলারতির মধুর শব্দ শুনা যাইতেছে। সেই সঙ্গে প্রভাতী রাগে রোশনচৌকি বাজিতেছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গাত্রোত্থান করিয়া মধুর স্বরে নাম করিতেছেন। ঘরে যে সকল দেবদেবীর মূর্তি পটে চিত্রিত ছিল, এক-এক করিয়া প্রণাম করিলেন। পশ্চিম ধারের গোল বারান্দায় গিয়া ভাগীরথী দর্শন করিলেন ও প্রণাম করিলেন। ভক্তেরা কেহ কেহ ওখানে আছেন। তাঁহারা প্রাতঃকৃত সমাপন করিয়া ক্রমে ক্রমে আসিয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রণাম করিলেন।
রাখাল ঠাকুরের সঙ্গে এখানে এখন আছেন। বাবুরাম গতরাত্রে আসিয়াছেন। মণি ঠাকুরের কাছে আজ চৌদ্দদিন আছেন।
আজ বৃহস্পতিবার, অগ্রহায়ণ কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথি; ২৭শে ডিসেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ। আজ সকাল সকাল ঠাকুর স্নানাদি করিয়া কলিকাতায় আসিবার উদ্যোগ করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ মণিকে ডাকিয়া বলিলেন, “ঈশানের ওখানে আজ যেতে বলে গেছে। বাবুরাম যাবে, তুমিও যাবে আমার সঙ্গে।”
মণি যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলেন।
শীতকাল। বেলা ৮টা, নহবতের কাছে গাড়ি আসিয়া দাঁড়াইল; ঠাকুরকে লইয়া যাইবে। চতুর্দিকে ফুলগাছ, সম্মুখে ভাগীরথী; দিক সকল প্রসন্ন; শ্রীরামকৃষ্ণ ঠাকুরদের পটের কাছে দাঁড়াইয়া প্রণাম করিলেন ও মার নাম করিতে করিতে যাত্রা করিয়া গাড়িতে উঠিলেন। সঙ্গে বাবুরাম, মণি। তাঁহারা ঠাকুরের গায়ের বনাত, বনাতের কানঢাকা টুপি ও মসলার থলে সঙ্গে লইয়াছেন, কেন না শীতকাল, সন্ধ্যার সময় ঠাকুর গায়ে গরম কাপড় দিবেন।
ঠাকুর সহাস্যবদন, সমস্ত পথ আনন্দ করিতে করিতে আসিতেছেন। বেলা ৯টা। গাড়ি কলিকাতায় প্রবেশ করিয়া শ্যামবাজার দিয়া ক্রমে মেছুয়াবাজারের চৌমাথায় আসিয়া উপস্থিত হইল। মণি ঈশানের বাড়ি জানিতেন। চৌমাথায় গাড়ির মোড় ফিরাইয়া ঈশানের বাড়ির সম্মুখে দাঁড়াইতে বলিলেন।
ঈশান আত্মীয়দের সহিত সাদরে সহাস্যবদনে ঠাকুরকে অভ্যর্থনা করিয়া নিচের বৈঠকখানাঘরে লইয়া গেলেন। ঠাকুর ভক্তসঙ্গে আসন গ্রহণ করিলেন।
পরস্পর কুশল প্রশ্নের পর ঠাকুর ঈশানের পুত্র শ্রীশের সঙ্গে কথা কহিতেছেন। শ্রীশ এম্এ, বি-এল পাশ করিয়া আলিপুরে ওকালতি করিতেছেন। এন্ট্রান্স ও এফ-এ পরীক্ষায় ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট হইয়াছিলেন, অর্থাৎ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করিয়াছিলেন।
এখন তাঁর বয়স প্রায় ত্রিশ বৎসর হইবে। যেমন পাণ্ডিত্য তেমনি বিনয়, লোকে দেখিলে বোধ করে ইনি কিছুই জানেন না। হাতজোড় করিয়া শ্রীশ ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন। মণি ঠাকুরের কাছে শ্রীশের পরিচয় দিলেন ও বলিলেন, এমন শান্ত প্রকৃতির লোক দেখি নাই।
কর্ম বন্ধনের মহৌষধ ও পাপকর্ম – কর্মযোগ
শ্রীরামকৃষ্ণ (শ্রীশের প্রতি) – তুমি কি কর গা?
শ্রীশ – আজ্ঞা, আমি আলিপুরে বেরুচ্ছি। ওকালতি করছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) – এমন লোকেরও ওকালতি? (শ্রীশের প্রতি) – আচ্ছা, তোমার কিছু জিজ্ঞাসা আছে?
“সংসারে অনাসক্ত হয়ে থাকা, কেমন?”
শ্রীশ – কিন্তু কাজের গতিকে সংসারে অন্যায় কত করতে হয়। কেউ পাপ কর্ম করছে, কেউ পুণ্যকর্ম। এ-সব কি আগেকার কর্মের ফল, তাই করতে হবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ – কর্ম কতদিন। যতদিন না তাঁকে লাভ করা যায়। তাঁকে লাভ হলে সব যায়। তখন পাপ-পুণ্যের পার হয়ে যায়।
“ফল দেখা দিলে ফুল যায়। ফুল দেখা দেয় ফল হবার জন্য।
সন্ধ্যাদি কর্ম কতদিন? যতদিন ঈশ্বরের নাম করতে রোমাঞ্চ আর চক্ষে জল না আসে। এ-সকল অবস্থা ঈশ্বরলাভের লক্ষণ, ইশ্বরে শুদ্ধাভক্তিলাভের লক্ষণ।
“তাঁকে জানলে পাপ-পুণ্যের পার হয়।
“প্রসাদ বলে ভুক্তি মুক্তি উভয় মাথায় রেখেছি,
আমি কালী ব্রহ্ম জেনে মর্ম ধর্মাধর্ম সব ছেড়েছি।
“তাঁর দিকে যত এগুবে ততই তিনি কর্ম কমিয়ে দিবেন। গৃহস্থের বউ অন্তঃসত্ত্বা হলে শাশুড়ী ক্রমে ক্রমে কাজ কমিয়ে দেন। যখন দশমাস হয়, তখন একেবারে কাজ কমিয়ে দেন। সন্তানলাভ হলে সেইটিকে নিয়েই নাড়াচাড়া, সেইটিকে নিয়েই আনন্দ।”
শ্রীশ – সংসারে থাকতে থাকতে তাঁর দিকে যাওয়া বড় কঠিন।
গৃহস্থ সংসারীকে শিক্ষা – অভ্যাসযোগ ও নির্জনে সাধন
শ্রীরামকৃষ্ণ – কেন? অভ্যাসযোগ? ও-দেশে ছুতোরদের মেয়েরা চিঁড়ে বেচে। তারা কত দিক সামলে কাজ করে, শোন। ঢেঁকির পাট পড়ছে, হাতে ধানগুলি ঠেলে দিচ্ছে আর-একহাতে ছেলেকে কোলে করে মাই দিচ্ছে। আবার খদ্দের এসেছে; ঢেঁকি এদিকে পড়ছে, আবার খদ্দেরের সঙ্গে কথাও চলছে। খদ্দেরকে বলছে, তাহলে তুমি যে ক’পয়সা ধার আছে, সে ক’পয়সা দিয়ে যেও, আর জিনিস লয়ে যেও।
“দেখ, – ছেলেকে মাই দেওয়া, ঢেঁকি পড়ছে, ধান ঠেলে দেওয়া ও কাঁড়া ধান তোলা, আবার খদ্দেরের সঙ্গে কথা বলা, একসঙ্গে করছে। এরই নাম অভ্যাসযোগ। কিন্তু তার পনর আনা মন ঢেঁকির পাটের দিকে রয়েছে, পাছে হাতে পড়ে যায়। আর এক আনায় ছেলেকে মাই দেওয়া আর খদ্দেরের সঙ্গে কথা কওয়া। তেমনি যারা সংসারে আছে, তাদের পনর আনা মন ভগবানে দেওয়া উচিত। না দিলে সর্বনাশ – কালের হাতে পড়তে হবে। আর এক আনায় অন্যান্য কর্ম কর।
“জ্ঞানের পর সংসারে থাকা যায়। কিন্তু আগে তো জ্ঞানলাভ করতে হবে। সংসার-রূপ জলে মন-রূপ দুধ রাখলে মিশে যাবে, তাই মন-রূপ দুধকে দই পেতে নির্জনে মন্থন করে – মাখন তুলে – সংসার-রূপ জলে রাখতে হয়।
“তা হলেই হল, সাধনের দরকার। প্রথমাবস্থায় নির্জনে থাকা বড় দরকার। অশ্বত্থগাছ যখন চারা থাকে তখন বেড়া দিতে হয়, তা না হলে ছাগল গরুতে খেয়ে ফেলে, কিন্তু গুঁড়ি মোটা হলে বেড়া খুলে দেওয়া যায়। এমন কি হাতি বেঁধে দিলেও গাছের কিছু হয় না।
“তাই প্রথমাবস্থায় মাঝে মাঝে নির্জনে যেতে হয়। সাধনের দরকার। ভাত খাবে; বসে বসে বলছ, কাঠে অগ্নি আছে, ওই আগুনে ভাত রাঁধা হয়; তা বললে কি ভাত তৈয়ার হয়? আর-একখানা কাঠ এনে কাঠে কাঠে ঘষতে হয়, তবে আগুন বেরোয়।
“সিদ্ধি খেলে নেশা হয়, আনন্দ হয়। খেলে না, কিছুই করলে না, বসে বসে বলছ, ‘সিদ্ধি সিদ্ধিঞ্চ! তাহলে কি নেশা হয়, আনন্দ হয়?”
ঈশ্বরলাভ – জীবনের উদ্দেশ্য – পরা ও অপরা বিদ্যা – ‘দুধ খাওয়া’
“হাজার লেখাপড়া শেখ, ঈশ্বরে ভক্তি না থাকলে, তাঁকে লাভ করবার ইচ্ছা না থাকলে – সব মিছে। শুধু পণ্ডিত, বিবেক-বৈরাগ্য নাই – তার কামিনী-কাঞ্চনে নজর থাকে। শকুনি খুব উঁচুতে উঠে, কিন্তু ভাগাড়ের দিকে নজর। যে বিদ্যা লাভ করলে তাঁকে জানা যায়, সে-ই বিদ্যা; আর সব মিছে।
“আচ্ছা, তোমার ঈশ্বর বিষয়ে কি ধারণা?”
শ্রীশ – আজ্ঞা, এইটুকু বোধ হয়েছে – একজন জ্ঞানময় পুরুষ আছেন, তাঁর সৃষ্টি দেখলে তাঁর জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। এই একটা কথা বলছি – শীতপ্রধান দেশে মাছ ও অন্যান্য জলজন্তু বাঁচিয়ে রাখবার জন্য তাঁর কৌশল। যত ঠাণ্ডা পড়ে তত জলের আয়তনের সঙ্কোচ হয়। কিন্তু আশ্চর্য, বরফ হবার একটু আগে থেকে জল হালকা হয় ও জলের আয়তন বৃদ্ধি হয়!
পুকুরের জলে অনায়াসে খুব শীতে মাছ থাকতে পারে। জলের উপরিভাগে সমস্ত বরফ হয়ে গেছে, কিন্তু নিচে যেমন জল তেমনি জল। যদি খুব ঠাণ্ডা হাওয়া বয়, সে হাওয়া বরফের উপর লাগে। নিচের জল গরম থাকে।
শ্রীরামকৃষ্ণ – তিনি আছেন, জগৎ দেখলে বোঝা যায়। কিন্তু তাঁর বিষয় শোনা এক, তাঁকে দেখা এক, তাঁর সঙ্গে আলাপ করা আর এক। কেউ দুধের কথা শুনেছে, কেউ দুধ দেখেছে, কেউ বা দুধ খেয়েছে। দেখলে তবে তো আনন্দ হবে, খেলে তবে তো বল হবে, – লোক হৃষ্টপুষ্ট হবে। ভগবানকে দর্শন করলে তবে তো শান্তি হবে, তাঁর সঙ্গে আলাপ করলে তবেই তো আনন্দলাভ হবে, শক্তি বাড়বে।
মুমুক্ষত্ব বা ঈশ্বরের জন্য ব্যকুলতা সময়সাপেক্ষ
শ্রীশ – তাঁকে ডাকবার অবসর পাওয়া যায় না।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – তা বটে; সময় না হলে কিছু হয় না। একটি ছেলে শুতে যাবার সময় মাকে বলেছিল, মা আমার যখন হাগা পাবে আমাকে তুলিও। মা বললেন, বাবা, হাগাতেই তোমাকে তোলাবে, আমায় তুলতে হবে না।
“যাকে যা দেবার তাঁর সব ঠিক করা আছে। সরার মাপে শাশুড়ী বউদের ভাত দিত। তাতে কিছু ভাত কম হত। একদিন সরাখানি ভেঙে যাইয়াতে বউরা আহ্লাদ করছিল। তখন শাশুড়ী বললেন, ‘নাচ কোঁদ বউমা, আমার হাতের আটকেল (আন্দাজ) আছে’।”
আমমোক্তারি বা বকলমা দাও
(শ্রীশের প্রতি) – কি করবে? তাঁর পদে সব সমর্পণ কর; তাঁকে আমমোক্তারি দাও। তিনি যা ভাল হয় করুন। বড়লোকের উপর যদি ভার দেওয়া যায়, সে লোক কখনও মন্দ করবে না।
“সাধনার প্রয়োজন বটে; কিন্তু দুরকম সাধক আছে; – একরকম সাধকের বানরের ছার স্বভাব, আর-একরকম সাধকের বিড়ালের ছার স্বভাব। বানরের ছা নিজে জো-সো করে মাকে আঁকড়িয়ে ধরে। সেইরূপ কোন কোন সাধক মনে করে, এত জপ করতে হবে, এত ধ্যান করতে হবে, এত তপস্যা করতে হবে, তবে ভগবানকে পাওয়া যাবে। এ-সাধক নিজে চেষ্টা করে ভগবানকে ধরতে যায়।
“বিড়ালের ছা কিন্তু নিজে মাকে ধরতে পারে না। সে পড়ে কেবল মিউ মিউ করে ডাকে! মা যা করে। মা কখনও বিছানার উপর, কখনও ছাদের উপর কাঠের আড়ালে রেখে দিচ্ছে; মা তাকে মুখে করে এখানে ওখানে লয়ে রাখে, সে নিজে মাকে ধরতে জানে না। সেইরূপ কোন কোন সাধক নিজে হিসাব করে কোন সাধন করতে পারে না, – এত জপ করব, এত ধ্যান করব ইত্যাদি। সে কেবল ব্যাকুল হয়ে কেঁদে কেঁদে তাঁকে ডাকে। তিনি তার কান্না শুনে আর থাকতে পারেন না, এসে দেখা দেন।”
-১৮৮৩, ২৭শে ডিসেম্বর-
………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : সপ্তদশ অধ্যায় : ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….