হীরামনের জ্বর ও জ্ঞাতি কর্তৃক ত্যাগ ও পুনর্জীবন।
পয়ার
রাম রূপ হেরি হ’ল জীবন চঞ্চল।
সে হইতে সংসারের কার্য ছাড়ি দিল।।
কৃষাণী কার্যেতে ছিল পারক অত্যন্ত।
কার্যেতে প্রবর্ত হ’লে নাহি দিত ক্ষান্ত।।
স্বাভাবিক যাহারা করেন কৃষিকার্য।
তাহা হ’তে দশগুণ, না ছিল অধৈর্য।।
এই মত কার্য করিতেন মহাভাগ।
এবে সংসারের কার্য করিলেন ত্যাগ।।
জ্ঞাতি বন্ধু সব লোকে ভাবে মনে মনে।
এ বেটা সংসার কার্য তেয়াগিল কেনে।।
কেহ বলে যে দিন ঠাকুর দেখতে যায়।
সেই দিন পাগল করেছে মৃত্যুঞ্জয়।।
মৃত্যুঞ্জয় বাড়ীতে ঠাকুর এসেছিল।
মৃত্যুঞ্জয় গৃহিণী ঠাকুরে সাজাইল।।
মৃত্যুঞ্জয় এনেছিল শতদল পদ্ম।
সেই ফুলে পূজে ঠাকুরের পাদপদ্ম।।
পরমা বৈষ্ণবী সেই মৃত্যুঞ্জয় মাতা।
ঠাকুরে পূজিয়াছিল শুনিয়াছি কথা।।
সে ঠাকুরে দেখিবারে গিয়েছিল হীরে।
মূর্ছা হ’য়ে পড়েছিল দেখে সে ঠাকুরে।।
মৃত্যুঞ্জয় ওর কর্ণে দিয়েছিল হরিবোল।
সেই হ’তে হীরামন হ’য়েছে পাগল।।
রাউৎখামার গ্রামে মেতেছে সকল।
তারা সবে প্রেমে মেতে বলে হরিবোল।।
কেহ বলে দুর্লভ মধুর হরিবোল।
তবে কেন হীরামন হ’য়েছে পাগল।।
সবে মিলি দেখিয়াছি ঠাকুরের রূপ।
আমরা জানি যে তিনি স্বয়ং স্বরূপ।।
সব হরিবোলা করে সংসারের কার্য।
হীরামন কি জন্য করিল কার্য ত্যাজ্য।।
কেহ ভাল কেহ মন্দ করে কানাকানি।
যাহার যেমন মন সে কহে তেমনি।।
কেহ বলে ও দেখেছে প্রভু হরিচাঁদ।
স্বয়ং দর্শনে হ’ল কৃষ্ণ প্রেমোন্মাদ।।
হীরামন কার্য ত্যাগী দেখিয়া বিশেষ।
ঠাকুরের প্রতি কারু জন্মিল বিদ্বেষ।।
শ্রীচৈতন্য বালা হীরামনের সে খুড়া।
ঠাকুরের প্রতি দ্বেষ করে সেই বুড়া।।
শ্রীঅক্রুরচন্দ্র বালা শ্রীগুরুচরণ।
কনিষ্ঠ শ্রীকোটিশ্বর অতি সুলক্ষণ।।
ঠাকুরের প্রিয় ভক্ত তিন সহোদর।
তাহারা বলেন প্রভু স্বয়ং অবতার।।
প্রভুর সঙ্গেতে তারা ভ্রমে সর্বক্ষণ।
প্রভুর সঙ্গেতে করেন নাম সংকীর্তন।।
ভক্তি বাধ্য মহাপ্রভু সেই বাড়ী যান।
তাহারা বলেন ইনি স্বয়ং ভগবান।।
মনে নাহি কোন দ্বেষ হীরামন ব’লে।
তারা বলে বংশের ভাজন এই ছেলে।।
রত্নগর্ভে জন্মিয়াছে মহারাজ পুত্র।
এ হইতে বালাবংশ হইবে পবিত্র।।
কার্যত্যাগী হীরামন করে হরিনাম।
কতদিনে দৈবযোগে হইল ব্যারাম।।
জ্বর হ’য়ে ছ’মাস পর্যন্ত হ’ল ভোগ।
উদরে হইল প্লীহা যকৃতাদি রোগ।।
অদ্য মরে কল্য মরে প্রাণ ওষ্ঠাগত।
এই রোগে ক্রমে ক্রমে হ’ল মৃতবত।।
একদিন ডেকে বলে শ্রীচৈতন্য বালা।
পাগলারে ল’য়ে তোরা ওঢ়াকাঁদি ফেলা।।
রোগে মরে তবু বেটা ঔষধ না খায়।
আমাদের কথা নাহি শুনে দুরাশয়।।
আমাদের সংসারে কার্য নাহি করে।
আমরা কেহত’ নয় ও কার বাড়ী মরে।।
অসার সংসার বলে কেহ কারু নয়।
যত বেটা মতুয়ারা এই কথা কয়।।
মতুয়া হইল এরা কি ধন পাইয়া।
বেদবিধি না মানে ফিরিছে লাফাইয়া।।
কেবা কার, কেবা কার, কার জন্য কাঁদে।
আত্ম স্বার্থ সমর্পণ বাবা হরিচাঁদে।।
হরি বলে দিন রাতি করে সোরা সোরি।
বাবা যদি হরিচাঁদ যাক সেই বাড়ী।।
খুড়া জেঠা ভাই বন্ধু কেহ কারু নয়।
দেখি ওর কোন বাবা এখানে কুলায়।।
হয় নেও ওঢ়াকাঁদি নয় মল্লকাঁদি।
ও মরুক ম’তোরা করুক কাঁদাকাঁদি।।
হরিচাঁদ মৃত্যুঞ্জয় দোহে নাকি ব্রহ্ম।
এ মরা বাঁচাতে পারে তবে জানি মর্ম।।
মরা গরু বাঁচাইয়া জহুরি প্রকাশ।
এই মরা বাঁ’চায়ে লউক হরিদাস।।
শুনিয়া এতেক বাণী কেহ কেহ কয়।
ভাল কথা বলেছ হে বালা মহাশয়।।
উহার কারণে মায়া করা নিরর্থক।
গতপ্রাণী জন্যে আর করিও না শোক।।
ডুবু তরী যদি হরিচাঁদ করে রক্ষা।
কেমন ঠাকুর তবে বুঝিব পরীক্ষা।।
তিলক মণ্ডল ভৃত্য সেই ডেকে বলে।
পাগলারে ওঢ়াকাঁদি আমি আসি ফেলে।।
এতবলি তিলক সে সাজাইল তরী।
হীরামনে ল’য়ে গেল ওঢ়াকাঁদি বাড়ী।।
প্রভুর নিকটে গিয়া উপনীত হ’ল।
তাহা দেখি প্রভু গিয়া গৃহে লুকাইল।।
সেইখানে তিলক সে কাহারে না দেখে।
হীরামনে তুলে এক গাছতলা রাখে।।
ভজন পোদ্দার বলে বাড়ী তোর কোথা।
মরা শব ফেলাইয়া যা’স কেন হেথা।।
তিলক মণ্ডল শুনি উঠিল নৌকায়।
ত্বরা করি খুলে তরী পালাইল ভয়।।
ভজন বলেছে কোথা যাস কুলাঙ্গার।
সবে কয় কোথা যায় শীঘ্র ওরে ধর।।
বড় কর্তা কৃষ্ণদাস অগ্রজ প্রভুর।
বলে ওরে ধরে আন যায় কতদূর।।
এত বলি বড়কর্তা ধাবমান হয়।
মহাপ্রভু এসে তথা অগ্রজে শান্তায়।।
প্রভু বলে দেখ দাদা হ’য়ে আগুয়ান।
একেবারে মরেছে কি? আছে ওর প্রাণ।।
বড়কর্তা দেখে গিয়া নাকে শ্বাস নাই।
কণ্ঠদেশে বামপার্শ্বে ল’ড়ে দেখে তাই।।
মহাপ্রভু এসে চটকার গাছতলা।
দেখে বলে এ দেখি সে হীরামন বালা।।
বসিলেন হীরামনে রাখিয়া সম্মুখে।
রহিলেন মহাপ্রভু উত্তরাভিমুখে।।
প্রভু কহে দেখে হে পোদ্দার মহাশয়।
প্রাণ আছে একেবারে মরা শ’ব নয়।।
বড়কর্তা বলে হরি ব্রজা মরে গেছে।
মরা যে বাঁ’চাতে সে ত’ নাই বেঁচে।।
মরা গরু বাঁচাইল তোর সঙ্গী ব্রজা।
পার যদি হও মরা বাঁচাবার ওঝা।।
রাউৎখামারের লোক মরা ফেলে যায়।
বালা গুষ্ঠি এত বৃদ্ধি পেয়েছে কোথায়।।
প্রভু হরিচাঁদ তবে কহেন অগ্রজে।
এরা যেন মরা ফেলে গেছে কি গরজে।।
একরাত্রে নির্জনেতে বলি হরি হরি।
এ রোগী চিকিৎসা আমি করিবারে পারি।।
কৃষ্ণদাস বলে কর পার যদি ভাই।
রাউৎখামার লোকের কোন দোষ নাই।।
যাও তথা, খাও তথা, তথা কর লভ্য।
তাহারা তোমার বাটী আনে কত দ্রব্য।।
সেই গ্রামে হরিবোলা মতুয়ার দল।
ভকত বাঁচাও ভাই ভক্তবৎসল।।
কিন্তু যদি এ মরা বাঁচাতে নার ভাই।
বালার বালাহী যাবে আর রক্ষা নাই।।
মাতুব্বর চ’তে বালার এত কি আস্পর্ধা।
কৃষ্ণদাস নাম বুঝি শোনে নাই গাধা।।
কার মরা এনে ফেলাইল কার বাড়ী।
বাঁচাতে পার’ত যশ হবে দেশ ভরি।।
যদি বাঁচাতে না পার ব’লে হরি হরি।
বালাদের নামে আমি করব ফৌজদারি।।
প্রভু কহে বড়কর্তা দেখ বিদ্যমান।
একেবারে মরে নাই দেহে আছে প্রাণ।।
নাসাগ্রে ঈষৎমাত্র বহিতেছে শ্বাস।
বাঁচিলে বাঁচিতে পারে হ’তেছে বিশ্বাস।।
কথোপকথনে হ’ল দিবা অবসান।
হেনকালে লক্ষ্মীমাতা এল সেই স্থান।।
মাতা বলে তবে কেন ক’রেছ বিলম্ব।
নিশ্চয় চৈতন্য বালা করেছে এ কর্ম।।
আপনার ঠাকুরালী তথায় বেড়েছে।
পরীক্ষা করার জন্য ইহা করে গেছে।।
প্রভু বলে যাহা হউক সবে যাহ ঘরে।
আমি দেখি চেষ্টা করি ঈশ্বর কি করে।।
সবে গেল প্রভু মাত্র রহিল একেলা।
মরা হীরামন ল’য়ে সেই গাছতলা।।
যামিনীর শেষ যামে সঞ্চারিল প্রাণ।
নীরোগ শরীর হ’ল পূর্ণ শক্তিমান।।
উঠিয়া চরণ ধরি বলে ওহে নাথ।
এ অধমে কৃপা করি কর আত্মসাৎ।।
যেদিন তোমার দেখা পাই মল্লকাঁদি।
পিঞ্জিরা রাউৎখামার পাখি ওঢ়াকাঁদি।।
ঠাকুর বলেন, আমি জানি তা সকল।
সে কথায় কাজ নাই হরি হরি বল।।
এমত আমার কর্ম রোগ ভোগ দিয়ে।
সংসার হইতে তোরে নিলাম উঠা’য়ে।।
তোর প্রতি আর কারু থাকিল না দাবি।
মায়াতীত হ’লি, এবে হরিগুণ গা’বি।।
হেথা হ’তে লুকাইয়া যারে বেদভিটে।
তথা হ’তে যাস কল্য অন্য নায় উঠে।।
এখানে থাকিলে তুই জনরব হ’বে।
প্রতিষ্ঠা বাড়িলে মোরে কেহ না ছাড়িবে।।
যুগে যুগে বাঁধা আছি আমি তোর ঠাই।
তোমা আমা একদেহ ভিন্ন ভেদ নাই।।
সংসারের মাঝে তুই কারু দায়ী নাই।
একমাত্র দায়ী রৈলি রমণীর ঠাই।।
যাও বাছা দিন কত করগে সংসার।
শোধ দিয়া এস গিয়া রমণীর ধার।।
জন্মিলে একটি পুত্র তাহার গর্ভেতে।
রমণীর ধার তবে পা’র শোধ হ’তে।।
গোলোক নাথের বাক্য শুনে শান্ত হ’ল।
হীরামন প্রীতে সবে হরি হরি বল।।
সভক্তি অন্তরে যেবা করেন শ্রবণ।
ধনে বংশে বৃদ্ধি অন্তে গোলোকে গমন।।
হীরামন দেহে পুনর্জীবন সঞ্চার।
হরি বল কহিছে তারক সরকার।।