ভবঘুরেকথা

দস্যুর দীক্ষা গ্রহণ
পয়ার

লীলাজীর কাছে গিয়া কেঁদে কেঁদে কয়।
প্রভু মোরে শিষ্য করি দেহ পদাশ্রয়।।
লীলাজী তাহাকে দিল কৃষ্ণ মন্ত্র দীক্ষে।
বলে আমি হরি বলে মেগে খাব ভিক্ষে।।
সদাগর ভবনেতে ছিল যে বৈষ্ণব।
হরি হরি বলে উঠে নৃত্য করে সব।।
সবে বলে চেয়ে দেখ বৈষ্ণবের গণ।
বৈষ্ণব হইয়া গেল এ দস্যু ব্রাহ্মণ।।
সদাগর ভাবে ডাকাইত এ ব্রাহ্মণ।
দায় ঠেকে হরি বলে পাইতে ভোজন।।
অধিকাংশ ধন দিলে বলিবেক হরি।
খেতে পেলে আর নাহি করিবেক চুরি।।
এত ভাবি সদাগর তারে দিল ধন।
রজত সহস্রমুদ্রা করিল অর্পণ।।
আশাতীত ধন পেয়ে আনন্দ বাড়িল।
দৃঢ় করে ব্রাহ্মণ বলিছে হরি বল।।
ধন লয়ে ভক্ত হ’য়ে দ্বিজ গেল বাড়ী।
ব্রাহ্মনীকে কহে পূর্ব্ব বুদ্ধি দিনু ছাড়ি।।
হরি বলে ধন পাই আরো পাই খেতে।
ইচ্ছা নাই আর যাই ডাকাতি করিতে।।
ব্রাহ্মণ বৃত্তান্ত তারে কহিল সকল।
ব্রাহ্মণব্রাহ্মনী মিলে বলে হরিবল।।
রাজ দূত তাহা শুনি রাজাকে জানায়।
শুনিয়া রাজার মন হরষিত হয়।।
রাজা বলে প্রজা যদি হইল বৈরাগী।
রাজভেট উপহার লও তার লাগি।।
দুই রাজদূত দুই রাজভেট ল’য়ে।
স্তব করে ব্রাহ্মণেরে রাজভেট দিয়ে।।
দ্বিজ ভাবে বৈষ্ণবের সাজের কি গুণ।
বেশ দেখে বৈশ্য মোর সেবায় নিপুণ।।
আরো যবে কৃষ্ণমন্ত্র করিনু গ্রহণ।
তাহা দেখি সদাগর মোরে দিল ধন।।
পরম বৈষ্ণব ধর্ম ধন্য ধন্য মানি।
রাজা দিল ভেট দূতে কহে স্তুতি বাণী।।
বিশুদ্ধ বৈরাগী আমি যখনে হইব।
নাহি জানি তখনে কি হ’ব কিনা হ’ব।।
এ হেন বৈরাগ্য আমি কবে বা পাইব।
কবে ব্রজে যাব আমি কবে দীন হ’ব।।
এ হেন বৈষ্ণব ধর্ম আমাকে ছাড়িয়া।
কোথা ছিল হরিনাম আমাকে বঞ্চিয়া।।
যখন হইল মম দস্যুবৃত্তি মন।
কোথায় বৈষ্ণব ধর্ম ছিলরে তখন।।
যে নামে জগৎ ভুলে প্রেমে মত্ত হ’য়ে।
সেই নাম মোরে ত্যাজে ছিল লুকাইয়ে।।
পেয়েছি তোমাকে যদি আর কি ছাড়িব।
যে দেশে তোমাকে পাব সেই দেশে যাব।।
আর না করিব আমি কর্ম দুরাচার।
অভেদ নাম-নামীন বুঝিলাম সার।।
দস্যুবৃত্তি করি নিত্য ভুঞ্জিয়াছি দুঃখ।
এক দিন বৈরাগী হইয়া কত সুখ।।
কল্য যারা আমাকে ক’রেছে দূর দূর।
তাহারা আদরে বলে বৈষ্ণব ঠাকুর।।
রাজ দূত দন্ড দিত আমাকে ধরিয়া।
রাজা মোরে দন্ড দিছে কারাগারে নিয়া।।
সেই রাজা সেই দূতে ব’য়ে দেয় ভেট।
বোধ হয় যমরাজা মাথা করে হেট।।
কিবা মন্ত্র লীলাজী দিলেন শিখাইয়া।
জগৎ বৈষ্ণব হো’ক আমাকে দেখিয়া।।
কিবা বৈষ্ণবের গুণ কহা নাহি যায়।
বেশ ধরিলেই মাত্র চোর সাধু হয়।।
একদিন মাত্র আমি সাধু সাজ পরি।
আর ফিরে মোর মনে না আইসে চুরি।।
একবার নাম নিলে যত পাপ হরে।
পাপীর কি শক্তি আছে তত পাপ করে।।
এই জন্যে নামে হ’ল ব্রহ্মাদেব দীক্ষে।
অভেদ নাম নামীন পাইনু পরীক্ষে।।
এই জন্যে নামে হৈল বৈষ্ণবী পার্বতী।
এই জন্য রত্নাকর ছাড়ে দস্যুবৃত্তি।।
নারায়ণ অংশে রত্নাকর জন্ম ধরে।
নামের নাহাত্ম্য জানাইতে পাপ করে।।
যার নাম সেই এই মাহাত্ম্য জানা’ল।
আর এক কথা মোর মনেতে হইল।।
জেনে তত্ত্ব নামে মত্ত শঙ্কর গোঁসাই।
যার নাম তার অঙ্গ তারাই তারাই।।
পাপী করে পাপ তাপ সাধুসঙ্গ লয়।
একবার নাম নিলে সর্ব্ব পাপ ক্ষয়।।
অন্ন কষ্ট ছলা করে বেশ ধরিলাম।
অনিচ্ছাতে নাম ল’য়ে বৈষ্ণব হৈলাম।।
আমি যে বৈষ্ণব হই আমি কেন কই।
ইহাতে কি আমি বড় অপরাধী হই।।
আমি যে বৈষ্ণব আমি যদি নাহি কই।
তাহা না বলিলে নামে গুণ থাকে কই।।
লীলাজী গুরু যে মম তার গুণ কই।
পরশ পরশে আমি বৈষ্ণব যে হই।।
পরশ পরশে যেন লৌহ হয় সোনা।
বৈষ্ণব পরশে কেন বৈষ্ণব হ’ব না।।
হাতে তালি দিয়া বলিল যে সাধু সব।
চোর ছিল দিজসুত হইল বৈষ্ণব।।
বৈষ্ণবের মুখপদ্ম বাক্য অখন্ডিত।
অই বলে আমি সাধু হইনু নিশ্চিত।।
খেতে সুতে বসিতে আমার চিন্তা নাই।
ভুক্তি দাসী লক্ষ্মীমাতা কুবের সেবাই।।
জীব সৃষ্টি করে সে কি আহার দিবে না।
নিরবধি কৃষ্ণপ্রেম করহ ভাবনা।।
যে কিছু দেখহ ভাই কৃষ্ণের সকল।
আর সব ধাঁ ধাঁ বাজী বল হরিবল।।
একদিন লীলাজীউ মহোৎসবে যেতে।
সদাগর বাটী যায় বহু শিষ্য সাথে।।
লীলাজীর মন হ’ল দস্যু ব্রাহ্মণেরে।
দিয়াছিনু মন্ত্র দেখে যাই সে কি করে।।
এতেক ভাবিয়া সাধু বাহুড়ী চলিল।
দস্যু শিষ্য বাটী এসে উপনীত হ’ল।।
দূরে থেকে লীলাজীকে করি দরশন।
উর্দ্ধবাহু করি নৃত্য করে’ছে ব্রাহ্মণ।।
ক্ষণে কক্ষবাদ্য ক্ষণে করে দন্ডবৎ।
লীলাজী চরণে নত হ’ল দন্ডবৎ।।
লীলাজীকে স্কন্ধে করি নাচিতে নাচিতে।
হরি হরি বলি ল’য়ে চলিল বাটিতে।।
রাজ ভেট সামগ্রী যতেক ছিল ঘরে।
ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী তাতে গুরু সেবা করে।।
গ্রাম্য লোকে করে সুখে জয় জয় ধ্বনি।
খাও খাও লও লও এই মাত্র শুনি।।
ব্রাহ্মণের প্রেম দেখি বৈষ্ণব সকল।
গ্রাম্য লোক সঙ্গে মিশে বলে হরিবল।।
নগরবাসিনী রামাগণে বলে হরি।
সাধুসেবা জন্য আনে চা’ল তরকারী।।
সাধুসেবা মহোৎসব তাহাতে হইল।
দ্রব্যাদি উদ্বৃর্ত্ত আরো কতোই রহিল।।
সদাগরদত্ত সহস্রেক মুদ্রা ছিল।
লীলাজী চরণে দস্যু সব এনে দিল।।
লীলাজী বলিল সব দিলে যে আমায়।
খাইতে পরিতে বাপু তোর কি উপায়।।
বিপ্র বলে এতদিন দেখেছি খাইয়া।
খাইয়া ফুরাতে নারি আপনার দয়া।।
যে ধন আমারে প্রভু করেছেন দান।
ত্রিভুবনে ধন নাই তাহার সমান।।
সত্যভামা ব্রতকালে দান নিল মুনি।
উদ্ধব লিখিয়া দিল নাম চিন্তামণি।।
সে ধনমিশ্রিত রস যে বা করে পান।
সুস্বাদ নাহিক আর সে সুধা সমান।।
দয়া করি সেই সুধা খেতে দিলে মোরে।
পেট ভরে খেলে সুধা আরো ক্ষুধা বাড়ে।।
হেন যদি জ্ঞান করি আমি বড় দীন।
উচ্চ শৃঙ্গে টেনে তুলে তোমার কপিন।।
ভবগৃহে তব ভাবশয্যায় শয়ন।
নিদ্রা দেবী চৌকি দেন থাকিয়া চেতন।।
তব আশীর্ব্বাদে মোর বাস বহির্ব্বাস।
বাসে বাসে দেশে দেশে গৌরদেশে বাস।
রাজদূতে দণ্ড দিত ঘোর চোর জেনে।
দূত রাজাভেট দেয় রাজলক্ষ্মী সনে।।
তোমার মহিমা প্রভু জানিল সকলে।
কল্য চোর অদ্য সাধু তব কৃপা বলে।।
তব মন্ত্র বল এবে হইল প্রকাশ।
ব্রহ্মপদ হ’তে উচ্চপদ কৃষ্ণদাস।।
এ সব বৈভব দেখে মনে হয় হাসি।
ভক্তি সহ মুক্তি দেবী হইয়াছে দাসী।।
এত শুনি লীলাজীউ ধরি দিল কোল।
প্রেমানন্দে সাধুগণে বলে হরিবোল।।
গুরু কহে এবে কর তীর্থ পর্য্যটন।
দ্বিজ কহে তীর্থ-রাজ তব শ্রীচরণ।।
গুরু কহে সব লোকে করে গিয়া তীর্থ।
গয়া ধামে পিণ্ড দিলে ত্রিকুল পবিত্র।।
শিষ্য বলে কর্ণে মন্ত্র দিয়াছে যে মাত্র।
তদবধি কোটি কুল স্বর্গে করে নৃত্য।।
পতিতপাবন যত বৈষ্ণবসমাজ।
গেল দিন কহে দীন কবি-রসরাজ।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!