: আমার বন্ধনের ও মুক্তির কারণ কি?
:: একই কারণ, যিনি তোমাকে বদ্ধ করেন, তিনিই আবার তোমাকে মুক্ত করেন। তিনি- দেবী ভগবতী মায়া
“তয়া বিসৃজ্যতে বিশ্বং জগদবতচ্চরাচরম্।
সৈষা প্রসন্না বরদা নৃণাং ভবতি মুক্তয়ে।।
সা বিদ্যা পরমা মুক্তের্হেত্তভূতা সনাতনী।
সংসারবন্ধহেতুশ্চ সৈব সর্বেশ্বরেশ্বরী।।”
(শ্রীশ্রীচণ্ডী)
অর্থাৎ সেই ভগবতী মায়াদেবীই স্থাবর জঙ্গম সমস্ত জগৎ সৃষ্টি করিয়াছেন, আরাধনা করিয়া সেই দেবীকে প্রসন্ন করিতে পারিলেই তিনি বরদার্ত্রী হইয়া অর্থাৎ অনুগ্রহ করিয়া জীবকে মুক্ত করেন। তিনিই জীবের মুক্তির হেতু নিত্যা ও পরমাবিদ্যা। সংসারবন্ধনেরও তিনিই কারণ, এবং তিনিই সমস্ত ঈশ্বরেরও ঈশ্বরী। তুমি ইহার সঙ্গে এই মহাবাক্যটীও স্মরণ রাখিবে। যথা-
“পৃথিব্যাং যানি ভূতানি জিহ্বোপস্থ-নিমিত্তকম্।
জিহ্বোপস্থ-পরিত্যাগে পৃথিব্যাং কি প্রয়োজনম্।।”
(ভগবান শঙ্করাচার্য্য)
অর্থাৎ জিহ্বা ও উপস্থ, এই দুইয়ের কর্ম্মই তোমার কর্ম্ম। এই দুই কর্ম্মদেবতা কর্ত্তৃকই তুমি বদ্ধ। জিহ্বা ও উপস্থের কার্য্যত্যাগ হইলে তুমিও মুক্ত হও।
“নৈকাদিত্যে দ্বিভোজনম্” এই বাক্যের অর্থ তিনি এইরূপ করিতেন- একবার ক্ষুধাতে দুইবার ভোজন করা আবশ্যক, ততটা মাত্র আহার করিও, অতিরিক্ত আহার করিওনা। ক্ষুধা না হইলে অথবা ক্ষুধার নিবৃত্তি হইলে, লোভে অথবা কাহারও অনুরোধে আহার করিওনা; ক্ষুধা লাগিলেই আহার করিবে; ক্ষুধা হইলে অভুক্ত থাকিবে না। ক্ষুধার পূজা করিও, জিহ্বার অর্থাৎ লোভের পূজা করিওনা।
“যা দেবী সর্ব্বভূতেষু ক্ষুধারূপেণ সংস্থিতা।” (শ্রীশ্রী চণ্ডী)
অর্থাৎ সেই দেবী ভগবতী সর্ব্ব প্রাণীতেই ক্ষুধারূপে অবস্থান করিতেছেন। অপিচ-
“তুমি আহার কর, মনে কর,
আহুতি দেই শ্যামা-মাকে।”
(রামপ্রসাদ)
: জিহ্বা ও উপস্থের কর্ম্ম নিবৃত্তির উপায় কি? এ সম্বন্ধে একজন শাস্ত্রকার বলিয়াছেন-
“ন জাতু কাম” কামানামুপভোগেন শাম্যতি।
হবিষা কৃষ্ণ বর্ত্মেব ভূয় এবাভিবর্দ্ধতে:।।”
অর্থাৎ ভোগ্যবস্তুর উপভোগদ্বারা কামনার (বাসনার) নিবৃত্তি হয় না। অগ্নি যেমন ঘৃতাহুতি পাইলে আরো প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠে, বাসনাও তেমন উপভোগদ্বারা ক্রমেই বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। পক্ষান্তরে অপর একজন পণ্ডিত বলিয়াছেন-
“মা ভুক্তংক্ষীয়তে কর্ম্ম”
অর্থাৎ বিনা ভোগে কর্ম্মের ক্ষয় হয় না। এই দুই শাস্ত্রোক্ত বাক্যের সামঞ্জস্য কোথায়?
:: প্রথম শাস্ত্রবচনে বলা হইয়াছে- “ উপভোগেন” উপভোগ দ্বারা; কিন্তু দ্বিতীয় শাস্ত্রবাক্যে উক্ত হইয়াছে। “অভুক্তম্” অর্থাৎ ভোগবিনা; তবেই বুঝিতে হইবে- উপভোগে কর্ম্ম (বাসনা) বৃদ্ধি পায়, ক্ষয় পায় না। কিন্তু ভোগ দ্বারা ক্রমে কর্ম্মের ক্ষয় হয়। কর্ম্মের ক্ষয় না হইলে জীব মুক্ত হয় না।
: ভোগে ও উপভোগে প্রভেদ কি?
:: পতি ও উপপতি এই দুইয়ে প্রভেদ, পত্নী ও উপপত্নী এই দুইয়ে যে প্রভেদ; ভোগে ও উপভোগেও ঠিক সেইরূপ প্রভেদ। বিচার পূর্ব্বক ভোগকে- “ভোগ”, এবং অবিচারে ভোগকে- “উপভোগ” কহে। জিহ্বা ও উপস্থের ভোগের জিনিষ লইয়া নাড়াচাড়া করা এবং প্রকৃতরূপে সম্যক ভোগ না করাও ‘উপভোগ’।
যথা- সুখাদ্য জিনিষ খাওয়ার ইচ্ছায় নাড়াচাড়া করিলে, কিন্তু খাইলে না, ইহারও নাম “উপভোগ” এই প্রকার উপভোগে, অথবা লোভের দাস হইয়া প্রকৃতির আকাঙ্ক্ষার অতিরিক্ত পরিমাণে ভোগ করিলে, বহুমূত্র, প্রমেহ, অজীর্ণ, জ্বর ইত্যাদি নানাবিধ রোগ হয়। অতএব মুমুক্ষু আহার ও বিহার বিশেষ বিচোর পূর্ব্বক করিবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: প্রকৃতি-দ্বিবিধা- বিদ্যা ও অবিদ্যা। বিদ্যার পূজায় জীব মুক্ত হয়, অবিদ্যার পূজায় বদ্ধ হয়। অনেক সময়ে বিদ্যা ও অবিদ্যার সন্ধিস্থল (Line of demarkation) অর্থাৎ কোথায় যাইয়া উভয়ের অধিকার বা সীমা মিলিয়াছে, নির্দেশ করা দুষ্কর। যেমন উদ্ভিজ্জতত্ত্ব (Botany) ও জীবতত্ত্ব (Zoology) এই উভয়ের অধিকার কোথায় মিলিয়াছে নিশ্চিয়রূপে দেখাইয়া দেওয়া কঠিন।
এইরূপ সন্ধিস্থলে সংশয় জন্মিলে ভক্তিপূর্ব্বক জিজ্ঞাসু হইলে-
“অন্তর্যামিরূপে গুরু দিবেন জানাইয়া।”
অপিচ-
“বিষয়া বিনিবর্ত্তন্তে নিবাহারস্য দেহিন:।
রসবর্জ্জং রসোহপ্যস্য পরংদৃষ্টা নিবর্ত্ততে।।”
(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-২/৫৯)
অর্থাৎ অনাহার ফলাহার ইত্যাদি দ্বারা ক্লিষ্টেন্ত্রিয় দেহীর বাসনার রস, বোধহেতু ভোগেচ্ছা রহিয়া যায়। বাসনার মূলোৎপাটন এবং তাহাকে নি:শেষ করিতে হইলে, এই সকল কার্য্য করিতে করিতে আস্তিক্য বুদ্ধিদ্বারা বহির্মুখ দেহী ক্রমে অন্তর্মুখ হইয়া ব্রহ্ম, আত্মা অথবা ভগবানের দিকে চাহিয়া সর্ব্বদা তাঁহার সাক্ষাৎকার লাভ করিলে, ভোগবাসনার নিবৃত্তি হয়।
“ভেকে বৈরাগ্য নাই বিনা উপদেশে।
সাধিলে সিদ্ধি নাই বিনা কৃপালেশে।।”
: আমি বদ্ধ অথবা মুক্ত, কিসে বুঝিব?
:: তাপই তাঁহার পরীক্ষা স্থল। যখন তোমার কিছুতেই তাপ লাগিবে না, সুখে বা দু:খে, মানে বা অপমানে, শীতে বা গ্রীষ্মে, একই অবস্থায় থাকিবে, তখনই বুঝিবে তুমি “মুক্ত” হইয়াছে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: ব্রহ্মচারীবাবার কখনও ঘর্ম্ম, হাঁচি, হাইম অথবা দীর্ঘনি:শ্বাস দেখি নাই।
: তাপ লাগিবার কারণ কি?
:: বাসনাই তাপের কারণ। যাহার বাসনা নাই তাহার তাপও নাই।
: যখন তাপ ভিন্ন কোন কার্য্যই নাই, এবং বাসনাই যখন তাপের মূল, তখন তাপের মূল কারণ “সমস্ত কার্য্য ও স্ত্রী পুত্র কন্যা ইত্যাদি” পরিত্যাগ করিয়া সন্ন্যাস গ্রহণ করত: গাছতলায় কি পাহাড়ে যাইয়া থাকাই ভাল।
:: তাহা ভাল হইলেও তুমি তাহা পার কই? সাময়িক ভ্রমবশত: মনে করিতে পার তোমার বৈরাগ্য জন্মিয়াছে; কিন্তু ভিতরে যে তোমার বাসনা আছে; অন্ধতা প্রযুক্ত তুমি তাহা দেখিতে পাওনা। বাসনা থাকিতে গাছতলায় গেলেও তোমার সন্ন্যাস হইবে না। এইমাত্র লাভ হইবে যে শাস্ত্রানুমোদিতা পরিণীতা স্ত্রী পরিত্যাগ করিয়া একটি সেবাদাসী গ্রহণ করিবে।
(চলবে…)
<<লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : এক ।। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : তিন>>
………………………
সূত্র:
শ্রীযামিনী কুমার দেবশর্ম্মা মুখোপাধ্যায়ের ধর্ম্মসার সংগ্রহ গ্রন্থ থেকে।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………..
আরও পড়ুন-
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : এক
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : দুই
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : তিন
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : চার
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : পাঁচ
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : উপসংহার
…………………
আরও পড়ুন-
লোকনাথ বাবার লীলা : এক
লোকনাথ বাবার লীলা : দুই
লোকনাথ বাবার লীলা : তিন
লোকনাথ বাবার লীলা : চার
লোকনাথ বাবার লীলা : পাঁচ
লোকনাথ বাবার লীলা : ছয়
লোকনাথ বাবার লীলা : সাত
লোকনাথ বাবার লীলা : আট
লোকনাথ বাবার লীলা : নয়
লোকনাথ বাবার লীলা : দশ
লোকনাথ বাবার লীলা : এগারো
লোকনাথ বাবার লীলা : বারো
লোকনাথ বাবার লীলা : তের
লোকনাথ বাবার লীলা : চৌদ্দ
লোকনাথ বাবার লীলা : পনের
লোকনাথ বাবার লীলা : ষোল
লোকনাথ বাবার লীলা : সতের
লোকনাথ বাবার লীলা : আঠার
লোকনাথ বাবার লীলা : উনিশ
লোকনাথ বাবার লীলা