গোস্বামী দেবীচাঁদের মতুয়া-ধর্ম্ম-বিস্তার
শক্তি দিল গুরুচাঁদ শক্তিমন্ত দেবীচাঁদ
প্রেমোন্মাদ হয়ে এল দেশে।
যারে দেখে তারে কয় আয় সবে ছুটে আয়
করিস কি তোরা সবে বসে?
ওড়াকান্দী এল হরি ভক্তচাঞ্ছা-পূর্ণকারী
চল সবে যাই তাঁর কাছে।
এমন রতন ফেলে গৃহে রস কেন ভুলে
ভুলে ভুলে দিন গেল মিছে।।”
জনে জনে ঘরে ঘরে বলে সবে পরস্পরে
“এ মানুষ হয়েছে পাগল।
ছাড়িয়াছে ধন মান নাহি যেন বাহ্য-জ্ঞান
মুখে শুধু বলে হরিবোল।।
আগে মাথা ছিল ঠিক জ্ঞান ছিল দিগিদিক
এবে দেখ বেহালের বেশ।
ছাড়িয়াছে সে চাকুরী তুচ্ছ কহে টাকা কড়ি
মুখে দাড়ি শিরে রাখে কেশ।।”
কেহ বলে “শুন ভাই কিছু নাহি দিশে পাই
কিবা গুণ ওড়াকান্দী আছে।
ওড়াকান্দী গেলে পরে যেন কোন রোগে ধরে
শুধু শুধু হরি বলে নাচে।।
ছোঁয়াচে রোগের মত এই ভাব ক্রমে দ্রুত
চলিতেছে দেশে-দেশান্তরে।
কি যেন কপালে আছে হয়ত বা আমি পাছে
মতো হব সেই মতো ধরে।।”
এই সব কাণাকাণি হ’ল ক্রমে জানাজানি
টানাটানি হ’ল নানাভাবে।
কেহ ভাল কেহ মন্দ তর্কাতর্কি বাক্য-দ্বন্দ্ব
করে সবে জ্ঞানের অভাবে।।
নিন্দা কিংবা বন্দনায় দেবী নাহি কণা দেয়
নিজ-মনে বলে হরিবোল।
কেহ করে গালাগালি কেহ গায়ে দেয় ধুলি
ঘরে ঘরে উঠে কলরোল।।
বিধির নির্ব্বন্ধ যাহা কে খন্ডাবে বল তাহা
মহামারী এল সেই দেশে।
নর-নারী অগণন মরিতেছে ঘন ঘন
ভয়াকুল রহে সবে বসে।।
ঘরে ঘরে কান্নারোল পুত্র-ছাড়া মাতৃকোল
স্বামীহারা কান্দে নারী দুঃখে।
সতীহারা কান্দে পতি ভ্রাতা ভাগ্নী সখা সখী
ঘরে ঘরে কান্দে সবে শোকে।।
আনে বৈদ্য-কবিরাজ তাতে নাহি দেয় কাজ
ঔষধেতে বাড়ায় বিষাদ।
হায় হায় নিরুপায় কেবা কহে সদুপায়
দেশবাসী গণিল প্রমাদ।।
কিন্তু কি আশ্চর্য্য কান্ড এক দিন এক দন্ড
দেবীচাঁদ না হল বিমর্ষ।
নিয়ে ডঙ্কা নিয়ে খোল বলে শুধু হরিবোল
প্রেমানন্দে-মগ্ন মহাহর্ষ।।
তাঁর ঘরে রোগ নাই হরি বলে ছাড়ে হাই
আপদ বালাই দুরে যায়।
কোন কোন দুঃখী জনে তাইভাবে মনে মনে
‘দেবী’ পারে করিতে উপায়।।
উপায় না দেখি চোখে সাহস করিয়া বুকে
পড়ে গিয়া দেবীর চরণে।
দেবী কহে ‘একি দায় পড় কেন মোর পায়
কোন ভাব নিয়ে এল মনে।।
যারা কান্দে তারা কয় “এ বিপদে কি উপায়
দয়া করি করহে গোঁসাই।
ভুল করে এত দিন চিনি নাই তোমা ধনে
কর রক্ষা পদে ভিক্ষা চাই।।”
শুনিয়া সে সব কথা ক্ষণিক নোয়ায়ে মাথা
ডাক দিয়া দেবীচাঁদ কয়।
‘আমি কিছু নাহি জানি শুধু এই কথা মানি
হরি নামে শঙ্কা দূরে যায়।।
সবে যদি রক্ষা চাও ঠাকুরের মান্য দাও
হরি নাম কর ঘরে ঘরে।
যদি প্রভু দয়া করে সব রোগ যাবে সেরে
অনায়াসে যাবে ভব পারে।।”
দুঃখী যারা এসেছিল দেবী চাঁদে সঙ্গে নিল
গৃহে আসি করে হরি নাম।
সারারাত্রি সবে মিলে এক মনে হরি বলে
প্রাতেঃ রোগ হইল আরাম।।
পাঁচ সিকা মান্য দিয়া পদে দন্ডবৎ হৈয়া
কেন্দে বলে সেই কাঙ্গালেরা।
‘বিপদে কান্ডারী তুমি স্বর্গ হতে এলে নামি
দুঃখী জনে দিলে আজি ধরা।।
দেবীচাঁদ ক্রোধে কয় ওরে ওরে দুরাশয়
কার পূজা কারে তুই দিলি।
গুরুচাঁদ সর্ব্বমূল ডাল ধর ছেড়ে মূল
এই ভুলে নিশ্চয় মরিলি।।
গুরুচাঁদ সব করে ডাকিস ত ডাক তাঁরে
তিনি বিনে বন্ধু কেহ নাই।
বিপদের বন্ধু তিনি আমি মনে তাই জানি
তিনি অগ্নি আমি মাত্র ছাই।।
এই ভাবে আলাপন করিলেন সমাপন
পরে গেল নিজ গৃহ বাসে।
ঘরে ঘরে এই কথা ব্যাপ্ত হল যথাতথা
দলে দলে লোক এল শেষে।।
সবার ভাঙ্গিল ভুল অকূলে মিলিল কূল
তারা সবে মতুয়া হইল।
বানেরী সামর্থগাতী আর কত ইতি উতি
দেবীচাঁদে গুরুত্বে বরিল।।
সন্ধ্যাকালে উতরোল ঘরে ঘরে হরিবোল
ধ্বনি উঠে আকাশ ভেদিয়া।
রোগে মুক্তি শোকে শান্তি দূর হয় মনোভ্রান্তি
হরি বলে দু’বাহু তুলিয়া।।
এই ভাবে করে ঘর নাম হল সুপ্রচার
বহু ভক্ত মত্ত হল নামে।
কেনুভাঙ্গা টুঙ্গীপাড়া সব খানে পড়ে সাড়া
রাজনগরাদি ক্রমে ক্রমে।
বালা শ্রীতপস্বীরাম টুঙ্গীপাড়া যার ধাম
শুণবান অতি মহাশয়।
দেহ মোটা দেল মোটা মোটা তাঁর প্রেমচ্ছটা
সাহসেতে মোটা অতিশয়।।
দেবীচাঁদে করে গুরু কাজ করে দেল-পুরু
দুরু দুরু না কাঁপে হিয়ায়।
যাহা বলে দেবীচান তাই করে দিয়ে প্রাণ
মানামান কোন চিন্তা নাই।
পুত্র তার মল আগে তাতে দুঃখ নাহি লাগে
সদা কহে ‘ভক্তি না হারাই।।”
পরে দিন পরিচয় বিয়া দিতে বিধবায়
আজ্ঞা যবে দিলেন ঠাকুর।
দেবী চাঁদ সহযোগে যাহা কিছু করা লাগে
শ্রীতপস্বী করিল প্রচুর।।
গুরুচাঁদ আজ্ঞাক্রমে গড়িলেন নিজ ধামে
যথাযোগ্য শ্রীহরি মন্দির।
শ্রীতপস্বী মরে নাই শ্রীহরি মন্দির তাই
সাক্ষ্য দেয় দাঁড়াইয়া স্থির।।
জহুরী সে দেবী চান ‘জহরীতে ছিল জ্ঞান
রাশী রাশী আনিল জহর।
ছুয়েছিল দেবী যাঁরে সেই পুনঃ ঘুরে ঘুরে
সাজাইল সাধুর বহর।।
তাহার প্রমাণ যত বলিতেছি সাধ্য মত
মোর সাধ্যে কত বা কুলায়?
দাদু মোর দেবী চান করে যদি শক্তি দান
বলি কিছু সে যাহা বলায়।।
নামেতে বিপিন চন্দ্র ফুল্ল যেন পূর্ণ চন্দ্র
কেনুভাঙ্গা গ্রামে অধিষ্ঠান।
রূপ গুলে দেবোপম বলি ক্রমে সেই ক্রম
মাতুল সম্পর্কে দেবী চান।।
শৈশবে করিল শিক্ষা যৌবনে চরিত্র রক্ষা
মন্ত্র-দীক্ষা না করে গ্রহণ।
যা্ত্রাগানে অনুরক্তি অভিনয়ে মহাশক্তি
সবে বলে নয়ন-রঞ্জন।।
এই ভাবে কাল যায় দেবী চান তাঁরে কয়
“ওরে ভোলা কত কি খেলিবি?
কত কাজ আছে বাকী তোরে তার লাগি ডাকি
গেলে দিন শেষে কি করিবি?”
এই কথা শোনা মাত্র কেঁপে উঠে তাঁর গাত্র
ছিন্ন-পত্রসম ভূমে পড়ে।
কেন্দে কয় ‘দয়াময় এত দিন কেহ হায়
অভাগারে নিলে না’ক ধরে?
খেলা ধূলা ছাই মাটি আজ বুঝিয়াছি খাঁটি
পরিপাটি শুধু হরিনাম।
সাজ ফেলে পরি সাজ সে সাজ পরালে আজ
সেই সাজে আমি সাজিলাম।।
জীবনের ভার লহ কোন পথে চলি কহ
তুমি নহ কভু মোর পর।
নৌকিক সম্বন্ধ ছাড়ি গুরু বলে মান্য করি
দিব পাড়ি অকুল সাগর।।”
কথা শুনি দেবী কয় ‘বিপিন রে! নাহি ভয়
অকুলের আছে যে-কান্ডারী।
কুলহারা কুল পাবে মরিবেনা কেহ ডুবে
হরি এল ওড়াকান্দী বাড়ী।।
মোর সাথে চল চল বসে থেকে কিবা ফল
কল্প বৃক্ষ ফল নিয়ে সাথে।
আহা রে! দুর্ভাগা জীব হরি হ’ল সদাশিব
চিনলি না কোন অপরাধে।।
তোরা যে সন্তান তাঁর সবারে করিতে পার
কর্ণধার সেজেছে সে নিজে।
যদি পারে বাঞ্ছা হয় ওঠে গিয়ে তাঁর নায়
পড় তাঁর চরণ-সরোজে।।”
এই ভাবে করে খেদ বিপিনের বক্ষ-ভেদ
হ’ল শুনি সাধুর কাকুতি।
কেন্দে পড়ে তার পায় বলে ‘গুরু দয়াময়!
দয়া করে কর মোরে সাথী।”
এইভাবে সে বিপিন মত্ত হ’ল দিনে দিন
দেবীচাঁদ দিল শক্তি তাঁরে।
শক্তিবলে সুমহান কার্য করে মতিমান
সে কাহিনী বলা হবে পরে।।
সেই হতে সর্ব্বদায় বানিয়ারী গ্রামে যায়
আয় যায় ধাম ওড়াকান্দী।
দেবী চাঁদ যাহা বলে সদা সেই মত চলে
ভক্তিগুণে তাঁরে করে বন্দী।।
শক্তিমান মহাসাধু শ্রীহরি নামের মধু
বিলাইল দেশে কি বিদেশ।
কি কব গুণের কথা রোগে শোকে শান্তিদাতা
প্রাণহারা প্রাণ পেয়ে হাসে।।
সে কীর্তি কাহিনী যত ঘটিতেছে অবিরত
পরে তাহা করিব বর্ণনা।
সংক্ষেপেতেঃ বলি এই গোস্বামীর মৃত্যু নেই
অমরত্ব করেছে সাধনা।।
রাজনগরেতে বাস নামে নেপাল বিশ্বাস
গণেশ নামেতে অন্যজন।
দেবী চাঁদে করে মান্য তাঁহার আদেশ ভিন্ন
কোন কর্ম্ম না করে মনন।।
এইভাবে পরচার করে দেবী ঘরে ঘর
সমাচার শোনে প্রভু কাণে।
একদিন যবে দেবী নিষ্কলঙ্ক-পূর্ণ ছবি
প্রণমিল প্রভুর চরণে।।
প্রভু ডেকে তারে কয় ‘শোন দেবী এ সময়
দক্ষিণেতে করহে গমন।
উঠেছে আমার মনে মনে হয় বাদাবনে
ভক্ত সেথা আছে বহুজন।।
তুমি মোর কথা লও শীঘ্র করি চলি যাও
বাদা বনে করগে প্রচার।।”
দেবী কহে “গুণনিধি এত ইচ্ছা হ’ল যদি
পূর্ণ হোক যে-ইচ্ছা তোমার।।”
গৃহে আসি অতঃপরে ডাকি কহে গণেশেরে
‘মোর বাক্য শুনহে গণেশ।
ঠাকুরের আজ্ঞা রয় একবার এ সময়
ঘুরে এস সে-দক্ষিণ দেশ।।”
আজ্ঞামতে সে গণেশ চলিল দক্ষিণ দেশ
খুলনা জেলায় উপস্থিত।
বাগেরহাট মহকুমা বাদা যার শেষ সীমা
সেই দিকে চলিল ত্বরিত।।
ডেউয়াতলা নামে গ্রাম তথা বসি করে নাম
‘হরিচাঁদ’ বলে ছাড়ে হাই।
মতুয়ার গান গায় দুই চক্ষে ধারা বয়
ভাব দেখে অবাক সবাই।।
সেই রাত্রি সেইখানে উপস্থিত দুইজনে
নাম জানি গোপাল, গণেশ
মামা আর ভাগিনেয় ধনে মানে নহে হেয়
মনে নাহি নিরানন্দ লেশ।।
গান শোনে সে গোপাল দুই চক্ষে ঝরে জল
পুরাতন কথা জাগে প্রাণে।
সুধামাখা এ সঙ্গিত গেয়ে ছিল সুললিত
বিবাহের দিন একজনে।।
ভস্মে যথা অগ্নি-ঢাকা এ সঙ্গীত মধুমাখা
ছিল ঢাকা বিষয়-ঝঞ্ছাটে।
বহু দিন পরে দেখা আর কিরে যায় থাকা
কি যে লেখা ছিল রে ললাটে।
ঢাকা যাহা ছিল বুকে বে’র হল ভক্ত মুখে
মনোসুখে কান্দিল গোপাল।
কেন্দে কয় “হে গোঁসাই! আর কোন কথা নাই
ধন্য মানি আমার কপাল।।
মম গৃহে চল তুমি সব কথা শুনি আমি
এই গান পেলে কার ঠাঁই?
যার গান সে কোথায়? আমার যে মন চায়
সেই মানুষের দেশে যাই।।
যেতে নাহি কর বাধা ভেঙ্গে ফেল সব দ্বিধা
এক কথা পড়ে মোর মনে।
আমার ভাগ্নের নাম শোন বলি গুণধাম
নামে নামে সম তব সনে।।
দুই জনে হও মিত্র এই পরিচয় সূত্র
বাঞ্ছা মাত্র কহি তব ঠাঁই।
তুমি যদি চল সাথে বড়ই আনন্দ তাতে
মনে আমি বড় শান্তি পাই।।”
গোপালের সে কথায় গণেশের শান্তি হয়
আনন্দে চলিল তাঁর সাথে।
গিয়ে গোপালের বাড়ী ফিরে এল তাড়াতাড়ি
কথা বলে বহুবিধ মতে।।
ওড়াকান্দী গুণ গান শুনিলেন মতিমান
আর শোনে দেবীচাঁদ কথা।
সকল শুনিয়া কানে গাঁথি নিল মনে প্রাণে
শ্রদ্ধাভরে নোয়াইল মাথা।।
দেবী চাঁদ দেখিবারে বাসনা হ’ল অন্তরে
বানীয়ারী যেতে হ’ল মন।
মাধব মামা’ত ভাই তাহারে জানা’ল তাই
একা ছিল হ’ল দুই জন।।
মাধবের পরিচয় বল কিছু এ সময়
বেতকাটা বাড়ী হ’ল তাঁর।
চারি ভাই শুদ্ধ শান্ত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা লহ্মীকান্ত
রাধাকান্ত অনুজ তাঁহার।।
তৃতীয় মাধবচন্দ্র ছোট ভাই রতিকান্ত
পিতা হ’ল নামে নীলমণি।।
নীলমণি সোনা রাম দুই ভ্রাতা অনুপম
গোপালের মামা এরা জানি।।
এই দীন গ্রন্থকার এই বংশে জন্মতার
পিতা তার সাধু রাধাকান্ত।
মাধবের ভ্রতুষ্পুত্র কাজে নহে নামে মাত্র
কর্ম্মদোষে আছে পথভ্রান্ত।।
মাধব আর গোপাল বাঁধিলেন একদল
শ্রীনাথ মিশিল তার সাথে।
তিনজনে চলি যায় বানেরী হয় উদয়
দেবীচাঁদ পাইল দেখিতে।।
মন সঁপে তাঁর পায় দেবী লহ্মীখালী যায়
আর গেল বেতকাটা গ্রামে।
দেবী গেল যেইখানে মহাভাব সেইখানে
সবে মত্ত হল’ হরিনামে।।
এইভাবে বাদা বনে দেখা গেল এতদিনে
ঠাকুরের ভক্ত কত আছে।
গোপালের কীর্তি যাহা অনন্ত অসীম তাহা
সেই কীর্তি গাহিব যে পাছে।।
এখানে সংক্ষেপে বলি গোপালের পদধূলি
পেতে ইচ্ছা করে দেবতায়।।
মহা-দেহে প্রেল প্রাণ পাপী তাপী হল ত্রাণ
গোপালের অসীম দয়ায়।।
দেবীচাঁদ কি যে দিল পরশে পরশ হ’ল
সে-পরশ মেলে ভাগ্য গুণে।
গোপাল সাধুর নাম দিতে পারে মোক্ষধাম
রক্ষা পায় রণে কিংবা বনে।।
দেবীচাঁদ কোনভাবে গোপালে আনিল ভাবে
কোনভাবে দেখা’ল ঠাকুর।
সেই সব পুণ্যবাণী অমৃত রসের খনি
পরে আমি গাহিব প্রচুর।।
এবে শুন কোন কার্য্য দেবীচাঁদ করে ধার্য্য
কিমাশ্চর্য্য দয়া ধৈর্য্য রয়।
গোপালের ভক্তিগুণে দেবী চড় সুখী মনে
মাঝে মাঝে লহ্মীখালী যায়।।
গ্রামেতে বিরোধী যারা বোঝেনা কর্ম্মের ধারা
ক্রোধ করি শাস্তি দিতে চায়।
ছল করি গোস্বামীরে ইচ্ছা করে মারিবারে
গোপাল জানিতে তাহা পায়।।
গুরুকে রাখিয়া ঘরে একা চলে রাজদ্বারে
নিজ শিরে বহে অপমান।
মনে ক্ষুদ্ধ হয়ে অতি গৃহে ফিরে মন্দগতি
দেবীচাঁদ পথে আগুয়ান।।
গোপালের মুখ দেখি বুঝিতে থাকে না বাকী
বলে ‘দুঃখ না ভাবিও মনে।
যাহা করে হরি করে দোষ নাহি দিও কারে
করে সব মঙ্গল কারণে।।
আমাদের নিষ্ঠা কত হরি তাহা দেখিবে ত
কত শত কষ্ট আছে পাছে।
শোন বলি হে গোপাল এক মাঘে শীতকাল
গত নহে আরো মাঘ আছে।।
মনে ক্রোধ নাহি কর আমার বচন ধর
নিষ্ঠা রাখ গুরুচাঁদ পদে।
বসুমতী কত সয় জগন্মাতা তাতে কয়
সৃষ্টি রক্ষা করিছে বসুধে।।”
এ ভাবে প্রবোধ দেয় গোপালের শান্তি হয়
বলে “কর্তা তোমার দয়ায়।
দুষ্টগণে রক্ষা পায় তা’ না হ’লে এ নিশ্চয়
জনে জনে করিতাম ক্ষয়।।
গোপালের কাছে আসি দেবীচাঁদ কহে হাসি
‘হে গোপাল! এ বড় অন্যায়।
ক্ষমাই সাধুর ধর্ম্ম সাধনার মূলমর্ম্ম
ক্ষমা ছাড়া উচিত না হয়।।”
এ ভাবে সান্ত্বনা করে দেবীচাঁদ গেল ঘরে
ক্রমে ঘটে অপূর্ব্ব ঘটনা।
সেই সব পরিচয় মনে মোর এ আশায়
শেষ ভাবে করিব বর্ণনা।।
দেবীচাঁদ বোঝে প্রাণে গোপালেল ভাব জেনে
মহাশক্তি ধারী সেই জন।
তাঁর গুণে একদিন ত্রাণ পাবে বিশ্বজনে
নাম হবে মহা-উদ্ধারণ।।
তাই ইচ্ছা করে মনে শিষ্যগণে জনে জনে
গুরুচাঁদে করিতে অপূর্ণ।
কি ভাবে সে সব হল কোন ভাবে কারে দিল
পশ্চাদ্শাগে করিব বর্ণণ।।
এবে শুন আরো কথা সে দেবীর তেজস্বিতা
গুরু শিক্ষা জোর কতখানি।
জাতির মঙ্গল তরে মীড যে প্রস্তাব করে
প্রভু তাহা লইলেন মানি।।
বিধবার বিয়া দিতে প্রভু রাজী হ’ল তাতে
ভক্তগণে জানা’ল সে কথা।
সেই আজ্ঞা শুনি কানে চিন্তা হ’ল ভক্তগণে
কার কার ঘুরে গেল মাথা।।
কোন হয় এ প্রকার করেছি মীমাংসা তার
বিধবা বিবাহ প্রস্তাবনে।
এখনে বলিব মাত্র ধরি দেবীচাঁদ সূত্র
কিবা করে সেই মহাজনে।।
সবে চুপ করি রয় কেহ নাহি কথা কয়
চিন্তা হ’ল ভকত সমাজে।
বীর-মূর্ত্তি দেবী চান হয়ে এল আগুয়ান
কর জোড়ে কহে গুরু-রাজে।।
“পদে এই নিবেদন শুন পতিত পাবন
মঙ্গলামঙ্গল নাহি জানি।
তুমি যা’তে সুখী হও তুমি তাহা বলে দেও
শুধু মাত্র সেই কথা মানি।।
বিধবা বিবাহ তুচ্ছ ইহা হ’তে আর উচ্চ
যদ্যপি কঠিন কিছু কহ।
দেহে যদি প্রাণ রয় বলি আমি সুনিশ্চয়
দিব তাহা তুমি যাহা চাহ।।”
শুনিয়া তেজের বাণী গুরুচাঁদ গুণমনি
বলে “ধ্য দেবী চাঁদ সাধু।
তোমার কর্ম্মেতে তুষ্ট হইবেন জগদিষ্ট
তুষ্ট আমি একা নহি শুধু।।”
এই কথা যবে কয় গুরুচাঁদ দয়াময়
আর দেবীচাঁদ যাহা বলে।
দ্বিধা ভাব ফেলে দূরে অন্য সবে বলে পরে
“বিয়া মোরা দিব কুতুহলে।।”
দেবীচাঁদ মহাশয় অতঃপর গৃহে যায়
বিবাহের জন্য ভারী ব্যস্ত।
ডাকি বলে ভক্তগণে “তোমাদের জনে জনে
এই কার্য্য করিলাম ন্যস্ত।।”
দেবীর সে আজ্ঞা পেলে ভক্তগণে চলে ধেয়ে
অবিলম্বে হ’ল আয়োজন।
বিধবার বিয়া হল সেই সব পরিচয়
পূর্ব্বভাগে করেছি বর্ণণা।।
এই কার্য্য শেষ করি মুখে বলি হরি হরি
দেবীচাঁদ ওড়াকান্দী যায়।
গোপাল চলিল সাথে দেবীচাঁদ সুখী তাতে
মনোগত ভাব নাহি কয়।।
গুরুচাঁদ দরশনে অতি আনন্দিত মনে
দেবীচাঁদ কহিছে ভারতী।
“তব দয়া গুণে নাথ তব যাহা মনোগত
সেই কার্য্য করেছি সম্প্রতি।।
গুরুচাঁদ শুনি কথা মীডেরে ডাকিয়া তথা
বলে “মীড শুভ সমাচার।
বিধবার বিয়া দিল দেবী চরণ মন্ডল
এই জন শিষ্য যে আমার।।”
মীড কহে ‘বড় কর্তা বড় শুভ এই বার্তা
ধন্যবাদ করি এই জনে।
এ লোকের ছবি চাই পাঠাব রাজার ঠাই
যাতে রাজা এই জনে চেনে।।”
গুরুচাঁদ দিল সায় মীড ছবি তুলি লয়
সেই ছবি গেল রাজদ্বারে।
সবে বলে ‘ধন্য ধন্য দেবী চাঁদ হ’ল মান্য
নাম তাঁর গেল ঘরে ঘরে।।
কার্য্য তাঁর হ’ল শেষ ইচ্ছিলেন হৃষিকেশ
নিতে তাঁর আপনার লোক।
দেবী চাঁদ বোঝে তাই মনে তাতে দুঃখ নাই
গোপালেরে নিজ কাছে ডাকে।।
নিজ হাতে ধরি তাঁরে গুরু চাঁদ দান করে
গুরু পদে সে তার দক্ষিণা।
অন্তয্যামী দয়াময় নিজ হাতে ধরি লয়
গোপালেরে করিল করুণা।।
ঢালিয়া অসীম স্নেহ গড়িয়া একটি দেহ
গুরু চাঁদে দেবী করে দান।
নেহারী অমৃত দৃষ্টি গুরুচাঁদ করে সৃষ্টি
শ্রীগোপাল সাধুর প্রধান।।
দান দিয়ে ধন্য হয় দেবী ভাবে আর নয়
এ যাত্রায় খেলা করি শেষ।
অস্তে যাবে দেবীচন্দ্র কহে দীন মহানন্দ
হরি বল ছেড়ে হিংসা দ্বেষ।।