শ্রীবেনীমাধব পালের উপাখ্যান
শ্রীবেণীমাধব পাল ঘৃকতান্দী গাঁয়।
শুন সবে বলি কিছু তার পরিচয়।।
বংশেতে কায়স্থ বটে সেই মহাশয়।
জীবনের আদিভাগে বহু কষ্ট পায়।।
তাঁহার জননী দেবী কামিনী নামেতে।
দুঃখে কষ্টে কাটে কাল পুত্র নিয়ে সাথে।।
ওড়াকান্দী অবতীর্ণ শ্রীহরি ঠাকুর।
পরম দয়াল তিনি মহিমা প্রচুর।।
যারে যাহা বলে তিনি তাই সিদ্ধ হয়।
দলে দলে কত লোক তাঁর কাছে যায়।।
বুদ্ধিমতি, ভক্তিমতী সেই যে কামিনী।
একদা প্রভুর কাছে চলিল আপনি।।
প্রগাঢ় বিশ্বাস তার অন্তরেতে ছিল।
পিতৃ ভাবে হরিচাঁদ চরণ বন্দিল।।
দীর্ঘ কেশপাশে ছিল নারীর মস্তকে।
কটিদেশ বিলম্বিত স্তবকে স্তবকে।।
সেই কেশপাশ দিয়া দুঃখিনী রমণী।
বান্ধিল হরির পদ জানি চিন্তামনি।।
চিন্তামনি প্রভু সব জানিলা অন্তরে।
দয়া করি বলে তারে হস্ত রাখি শিরে।।
‘‘ঘরে যাও ওগো মাতা নাহি কোন ভয়।
তব পুত্র রাজা হবে বলিনু নিশ্চয়।’’।
কান্দিয়া রমনী তাহে বহুত কহিল।
দয়া করি দয়া ময় সকলি শুনিল।।
তদবধি সে কামিনী সদা মনে প্রাণে।
শ্রীহরিচাঁদেরে নিজ পিতা সম মানে।।
এই ভাবে ক্রমে ক্রমে দিন গত হয়।
নামেতে গিরিশচন্দ্র বসু মহাশয়।।
বহু ব্যবসায় তার কলিকাতা পরে।
বেণীকে আনিল সঙ্গে মোহরার করে।।
সদ্ভাবে সকল কাজ করে বেণী পাল।
শ্রীহরির কৃপাক্রমে ফলিল সুফল।।
ক্রমে ক্রমে গিরীশের অংশীদার হ’ল।
ব্যবসায় ক্রমে তার ধন বেড়ে গেল।।
বহু বহু পুণ্যকর্ম্ম নানাস্থানে করে।
বাসনা হইল জমিদারী কিনিবারে।।
ফরিদপুরের মধ্য্যে আমগাঁও গ্রাম।
রাজস্ব দেনার দায়ে হইল নীলাম।।
সেই গ্রাম বেণীবাবু খরিদ করিল।
শ্রীহরির বাক্য দেখ ক্রমেতে ফলিল।।
জমিদারী কেনে বটে অধিকার নাই।
পূর্ব্ব জমিদার তাঁরে নাহি দেয় ঠাঁই।।
প্রজা সবে বাধ্য করি রাখিল বিপক্ষে।
বেণীর হইলা বাধা অধিকার পক্ষে।।
আমগাঁও গন্ডগ্রাম নহে বটে ক্ষুদ্র।
কায়স্থ ব্রাহ্মণ আছে আর নমঃশূদ্র।।
বেণী ভাবে ‘এ বিপদে কি উপায় করি।
বড়কর্ত্তা গুরুচাঁদে আমি গিয়ে ধরি।।
তিনি মোরে ভালবাসে জানি চিরকাল।
শ্রীহরির পুত্র তিনি পরম দয়াল।।
তিনি বিনে গতি নাহি পাব এ বিপদে।
নিবেদন করি আমি সব তাঁর পদে।।
এত ভাবি মহাশয় ওড়াকান্দী গেল।
দন্ডবৎ করি পরে বলিতে লাগিল।।
‘‘বড়কর্ত্তা পড়িয়াছে বিষম সঙ্কটে।
আপনি করিবে রক্ষা পেতে পারি বটে।।
কিনিয়াছি জমিদারী আমগাঁও গাঁয়।
অবাধ্য সকল প্রজা কি করি উপায়?
বহু নমঃশূদ্র বাস করে সেই গ্রামে।
তারা বাধা হতে পারে আপনার নামে।।
চিরকাল দয়া পাই আপনার কাছে।
এবার করিলে দয়া মান মোর বাঁচে।।
দয়া করে মোর সাথে সেথা যেতে হবে।
আপনার দেখা পেলে সকলে মানিবে।।’’
দয়ার সাগর প্রভু দয়া-ভরা প্রাণ।
বেণীরে করিয়া দয়া বলে ভগবান।।
‘‘ভয় নাই বেণী বাবু আমি সঙ্গে যাব।
তোমার সাহায্য আমি নিশ্চয় করিব।।’’
সেই মতে প্রভু তবে চলে আমগাঁয়।
যজ্ঞেশ্বর বিশ্ববাসি সঙ্গে সঙ্গে যায়।।
বেণী বাবু নিজে যায় প্রভুর সংহতি।
আর বহু লোক হল প্রভুজীর সাথী।।
এদিকে শুনিল সবে আমগাঁও গাঁয়।
বড়কর্ত্তা গুরুচাঁদ আসিছে তথায়।।
নমঃশূদ্র সবে ভাবে ‘‘বড়ই সৌভাগ্য।
তাঁরে পেতে এই গ্রামে মোরাত অযোগ্য।।
বেণীবাবু আনে বলে তাঁরে হেথা পাই।
বেণীবাবু প্রতি রোষ রাখিও না ভাই।।
বিশেষতঃ বড়কর্ত্তা আমাদের যিনি।
এই কার্য্যে নিজে নিজে আসিছেন তিনি।।
তিনি যদি এই কাজে ব্যর্থ হয়ে যান।
কিছুতে থাকে না আর জাতির সম্মান।।
বড়কর্তা গুরুচাঁদে বেণীবাবু আনে।
নমঃর গৌরব ইহা ভেবে দেখ মনে।।
বড়কর্তা মোরা সবে পাই বহু মান।
তাতে বলি বেণীবাবু করিয়াছে ভাল।
আমাদের মনোব্যাথা দুর হয়ে গেল।।
বেণীর বিরুদ্ধে মোরা কেহ নাহি যাব।
গুরুচাঁদ সঙ্গে তারে সম্মান করিব।।
এত বলি তারা সবে করে আয়োজন।
উভয়েরে মান্য দিতে যাহা প্রয়োজন।।
এদিকেতে যত ছিল কায়স্থ ব্রাহ্মণ।
মনে মনে হিংসা তারা করে সর্ব্বক্ষণ।।
বেণী পাল জমিদারী যাতে নাহি পায়।
সেই মত চেষ্টা তারা করে সর্ব্বদায়।।
ইতিপূর্ব্বে গ্রাম সব এক হয়েছিল।
গুরুচাঁদ আগমনে বাঁধন খসিল।।
নমঃশূদ্রগণে আর নাহি শোনে কথা।
ভাব দেখি তাহাদের হেট হল মাথা।।
তবু বহু চেষ্টা করে একতা কারণে।
কিন্তু নমঃশূদ্রে আর কথা নাহি শোনে।।
হতাশ হইয়া আর করে আঙ্গীকার।।
বেণী পালে মোরা কভু নাহি দিব কর।।
এদেশে আসিলে তারে নাহি সম্মান।
থাকে থাক যায় যাক তাতে ধন প্রাণ।।’’
এই ভাবে তারা যবে সত্য করি রয়।
বেণীপাল সঙ্গে প্রভু উদয় তথায়।।
নমঃশূদ্র সবে জানি এই সমাচার।
দলে দলে নৌকা প্রতি সবে অগ্রসর।।
বহু নিয়মেতে তারা সম্মান দেখায়।
প্রভুর নিকটে সব কথা খুলি কয়।।
তাহাদের কথা শুনি প্রভুর আনন্দ।
প্রভু কয় ‘‘কেহ নাহি কর’’ কর বন্ধ।
বড়ই দয়াল এই ধনী জমিদার।
ইহার নিকটে পাবে বহু উপকার।।’’
প্রভুর বচনে তবে নমঃশূদ্রগণে।
বেণীরে সম্মান দেয় অতি প্রীত মনে।।
যাঁর বাঁশী শুনে গলে কঠিন পাষাণ।
যাঁর আগমনে বহে প্রেমবন্যা বান।।
তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ পরম রতন।
তাঁরে দেখে ভুলে গেল নরনারীগণ।।
জয়ধ্বনি করি তাঁরে গৃহে পরে লয়।
পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া তারে সম্মান দেখায়।।
দলে দলে নরনারী আসে বহুতর।
প্রভুকে দেখিয়া সবে বলে ‘‘কি সুন্দর।।
এমন মোহন মুর্ত্তি আর দেখি নাই।
কোটি জন্ম পুণ্যফলে আজ দেখা পাই।।
দৃষ্টিমাত্রে মনপ্রাণ করে আকর্ষণ।
সুধামাখা বাক্যে মন করে গো হরণ।।
কি যে হয় কেন হয় নাহি পাই দিশে।
মনে হয় দিবারাত্রি থাকি পদে বসে।।’’
এই মত জনে জনে বলাবলি করে।
একবার দেখে সবে পুনঃ আসে ফিরে।।
এই ভাবে বলে কথা সারা গ্রাম ভরি।
শুনিয়া ভাবিল যত ব্রাহ্মণের নারী।।
‘‘মহৎ পুরুষ ছিল শ্রীহরি ঠাকুর।
যাঁর নামে আধি ব্যাধি সব হয় দুর।।
তাঁহার নন্দন এই গুরুচাঁদ নাম।
চল সখি দেখে আসি সেই গুণধাম।।’’
এত বলি ব্রাহ্মনীরা চলিল হাঁটিয়া।
ব্রাহ্মণেরা পারিল না রাখিতে ধরিয়া।।
এদিকেতে প্রভু তবে বসিল আহারে।
বহু আয়োজন তাতে নমঃশূদ্রে করে।।
আহারে বসিল প্রভু কমল লোচন।
গৃহ মধ্যে একা খায় নাহি অন্য জন।।
হেনকালে ব্রাহ্মনীরা মিলিয়া সকলে।
সেই গৃহে উপস্থিত হল কুতুহলে।।
প্রভুজী দেখিয়া বলে ‘‘কাহারা আসিল?’’
তাহা শুনি ব্রাহ্মনীরা মধুর হাসিল।।
তারা বলে ‘‘মহাশয় মোরা যে ব্রাহ্মণী।
আপনাকে দেখিবারে এসেছি এখনি।।’’
প্রভু ব্যস্ত হয়ে বলে দেহ গো আসন।
বড় দয়া করে এল এই মাতাগণ।।
প্রভুর আজ্ঞায় দিল আসন পাতিয়া।
ব্রাহ্মনীরা বসিলেন সেখানে আসিয়া।।
প্রভু কয় ‘‘বল শুনি ওগো মাতাগন।
কি কারণে কর সবে হেথা আগমন।।
আমি এক নমঃশূদ্র বিদ্যা বুদ্ধি নাই।
আমাকে দেখিতে কেন চাহ ভাবি তাই।।’’
ব্রাহ্মনীরা বলে ‘‘শুন শ্রীহরি নন্দন।
নমঃশূদ্র দেখিবারে আসিনা কখন।।
শ্রীহরির পুত্র তুমি পরম রতন।
তোমাকে দেখিতে তাই করি আগমন।।
দেখিয়া পরম প্রীত হইলাম মনে।
হইল জনম ধন্য তব দরশনে।।
আহারান্তে প্রভু তবে বসিয়া তথায়।
ব্রাহ্মণীগণের সঙ্গে বহু কথা কয়।।
কথাবার্ত্তা শুনি তবে ব্রাহ্মণী সকল।
প্রণাম করিয়া চলে চক্ষে বহে জল।।
সমাচার শুনি তবে ব্রাহ্মণের গন।
প্রভুর নিকটে সবে করে আগমন।।
আলাপনে সুখী তারা হইলেন সবে।
বলে সবে ‘‘মোরা নাহি যাব অন্যভাবে।।
বেণী বাবু কর পাবে দিনু অধিকার।
আমাদের বাবু কর বাধা রহিল না আর।।’’
প্রভুর কৃপায় বেনী দখল পাইল।
প্রভুর কৃপাই ধন্য হরি হরি বল।।