সব ব্যাপারের কলকাঠি তাঁর হাতে। সেইজন্যই তাঁকে জানার একটা ব্যাপার আছে। তাই বলছে, ‘নো দাইসেল্ফ’। তাঁকে জানো। ‘অহং ব্রহ্মাস্মি।’ প্রথমে বলা হচ্ছে- তিনি এটাও নন, ওটাও নন, অনন্ত-অখণ্ড। তারপর শেষে তুমি নিজে গিয়ে দেখবে তুমি সেই ব্রহ্ম।
লোকনাথ বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল- ‘আপনি কি ঈশ্বর দেখেছেন?’ তিনি বলেছিলেন- ‘আমি কোনও ঈশ্বরকে দেখিনি, আমি নিজেকে দেখেছি।’ এই নিজেকে দেখাই হচ্ছে ব্রহ্ম উপলব্ধি। দারুণ কথা! নিজেকে দেখেছ? তুমি তো নিজেকে বলতে নিজের শীররকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাও। ওটা সত্য নয়।
ওটা সত্য নয় তার প্রমাণ, যেটা নিত্য সেটা তো চিরন্তন থাকবে। যেটাকে তুমি ‘আমি’ বলো সেটা তো তোমার শরীর। যখন মরে যায়, মৃত শরীর পুড়িয়ে দেওয়া হয়, তখনই বোঝা যায়, তুমি যেটাকে শরীর বলছ, ‘আমি’ বলছ, সেটা আসল ‘আমি’ নয়। কেননা ওটা তো পুড়ে গেল, শেষ হয়ে গেল।
আত্মা-যেটা ‘নিত্য আমি’ সেটা তো শেষ হবে না যে আমি’র খোঁজ এই আমিটা পায়নি। দেহ চাপড়ে বলছ-‘আমি’। সেখানে মহাপুরুষ বলছেন- ‘আরে! যেখানে চাপড়ালি, ঠিকই আছে, আর একটু ভেতরে ঢুকতে হবে।’
‘গুরুদেব, জল চাই-পানীয় জল।’ গুরুদেব বললেন- ‘মাটি খোঁড়’। কিছুক্ষণ খোঁড়ার পর উঠল জল। ‘গুরুদেব জল উঠেছে। কিন্তু গুরুদেব এটা খাওয়া যাবে না। আপনি বললেন, জল পাওয়া যাবে। জল তো পাওয়া গেল। কিন্তু এ তো খাওয়া যাবে না।’
গুরুদেব বললেন- ‘এই জল নয়, আরও খোঁড়।’ শুধু গুরু বলে দিলেন-খোঁড়। কেননা গুরু জানেন কত ফুট নীচে বিশুদ্ধ জল আছে। শুধু গুরু তাকে বলছেন-খোঁড়। ডুব ডুব ডুব রূপসাগরে আমার মন।’ বলছেন, নিজ অন্তঃপুরে খোঁজ। খুঁজলে পাবি বৃন্দাবন। খোঁজ।
ড্রিলিং কর এবং সেখানে তুই খুঁজে পাবি নিজের আমি’কে। সেখানে আমি’কে খুঁজে দেখবি, তোর আমি’টাই ব্রহ্ম। সেখানে একটাই ‘আমি’ আছে। দুটো নেই। ওখানে আমাদের ‘ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থিশ্ছিদ্যন্তে সর্ব সংশয়াঃ।’ ঐখানে গেলেই আমাদের সমস্ত সংশয় ছিন্ন হয়। নাহলে হবে না।
আজ একজন এসেছিলেন- বিরাট লোক। উনি ওনার ডিগ্রীর কথা এক ঘণ্টা ধরে বলে গেলেন। মানে, ওনার গুণের কথা। আমার এক ঘণ্টা লেগেছে শুনতে। এত ওনার গুণ। তাও অনেক বাদ গেছে। সময় কম ছিল। তারপর আমি বললাম- ‘যতক্ষণ না আপনি তৃপ্তি পাচ্ছেন ততক্ষণ কোনও গুণই আপনার কাজে লাগবে না।’
উনি গুণান্বিত। উনি ব্রহ্ম নন। ব্রহ্মের কোনও গুণ নেই। উনি গুণের পেছনে ছুটছেন। বিশেষণের পেছনে ছুটছেন সেইখানে জানতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি ঠিক ঠিক আমাকে খুঁজে পাই, ততদিনে তৃপ্তি হবে না।
এই যে যারা এখানে এসেছেন, ছোটবেলা থেকে এখন অবধি চিন্তা করলে দেখবে নানা সমস্যায় তারা জর্জরিত। তারা বলবে, ‘আমরা নানা সমস্যায় জর্জরিত’। কিন্তু আমি বলব- ‘আপনি আপনার নিজেকে নিয়ে জর্জরিত’। সবচেয়ে বড় সমস্যা আপনি নিজে। আপনার অন্য কোনও সমস্যা নেই।
আপনার ছেলে, আপনার স্ত্রী, আপনার নাতি, আপনার নাতনি, কোনও সমস্যা নেই। সমস্যা- আপনি। ছোটবেলা থেকে আপনিই একটা বিরাট সমস্যা। সমাধান করতে পারেননি বলে সারাজীবন আপনি চিৎকার করে গেলেন। সমস্যা-সমস্যা-সমস্যা আর সমস্যা।
আর একে, ওকে, তাকে দিখিয়ে গেলেন। কিন্তু সমস্যার মূল কারণ আপনি এবং এই অঙ্কটা মেলাতে পারেননি বলেই, আপনার চারদিকে শুধু সমস্যা-সমস্যা-সমস্যা। সে জন্যই শ্রাস্ত্রকার বলেছেন- ‘আমি মরলে ঘুচিবে জঞ্জাল।’
এই ওরা, মেয়েরা রোজ সকালবেলাই ঘর পরিষ্কার করে। ঝাড়ু দেয়, ঘর মোছে, ঘর ঝাড়ু দেওয়ার ব্যাপারটা সবাই জানে। জঞ্জাল পরিষ্কার করার ব্যাপারটা সবাই জানে। কিন্তু মহাপুরুষ যে বলে গেলেন- আমি মরলে ঘুচিবে জঞ্জাল। সেই জঞ্জালটা তো পরিষ্কার হয়নি।
এই আমি’টা তো মরেই নি। বরঞ্চ ডাল-পালা-কাঁটা গজিয়ে গেছে। আমার কাঁটা কিন্তু আমাকেই খোঁচা দেয়। বাড়িতে যদি একটা কুল গাছ থাকে, আমরা কুলও যেমন খাই, কুল পাড়তে গেলে খোঁচাটাও তেমনি লাগে।
আমি বাচ্চা ছিলাম। যেমন এই যে বাচ্চা। এর ‘আমি’ একটু হয়েছে; যখন বড় হবে, মা হবে, তার আমি’র ডালপালা গজাবে-ওই ডালপালাই কিন্তু তাকে খোঁচাবে। মেয়ে খোঁচাবে, ছেলে খোঁচাবে, স্বামী খোঁচাবে।
সেইজন্যই বলেছে, আমি মরলে ঘুচিবে জঞ্জাল। কোন ‘আমি’টা? যে ‘আমি’টা জঞ্জাল। আর এই জঞ্জালটা ঘুচলেই কিন্তু আমরা ‘পাকা আমি’টার খোঁজ পাব।
…………………………………………………
ইন্টারন্যাশন্যাল বেদান্ত সোসাইটির ‘শ্রীভগবান্ উবাচ গ্রন্থ’ থেকে।
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ভারতের সাধক-সাধিকা
পুণঃপ্রচারে বিনীত -প্রণয় সেন