ভবঘুরেকথা

তারকের কাতলী গমন ও আশ্চয্য লীলা
সর্পকে করিয়া মুক্তি চলে তিন জন।
ধীরে ধীরে করিলেন কাতলী গমন।।
ভাবে গদ গদ চিত্ত চলেছেন পথে।
উপনীত হল গিয়া কাতলী গ্রামেতে।।
দেখিয়া সে নিবারণ চরণে পড়িল।
চরণ ধরিয়া শেষে কান্দিতে লাগিল।।
পরিবার সহ এসে প্রণমিল পায়।
চরণ ধোয়ায়ে শেষে আসনে বসায়।।
নিবারণ বলে গুরু তব আগমনে।
এ জীবন ধন্য হল তোমা দরশনে।।
নিবারণের চোখেতে বারি ধারা বয়।
তাই দেখে কয় ভাই চরণে লুটায়।।
জেষ্ঠ্য শ্রী মহেশ চন্দ্র মেঝ নিবারণ।
তৃতীয় সে ধনঞ্জয় বিশ্বাস সুজন।।
সবার কনিষ্ঠ হয় নামেতে পেয়ারী।
তারকেরে ভালবেসে বলে হরি হরি।।
তারকেরে ভক্তি করি সেবা করাইল।
হরিকথা রসরঙ্গে তথায় বঞ্চিল।।
পরদিন ভোর বেলা করিয়া ভোজন।
এসে শেষে চারিজন করিল গমন।।
নিবারণ সঙ্গে চলে যাদব দু’জন।
খাড়িয়া গ্রামেতে গিয়ে দিল দরশন।।
খাড়িয়ায় নিবারণ তাফালী নামেতে।
হরিবাসর করিল তাহার বাটিতে।।
তারকের আগমন শুনিয়া সকলে।
আসিলেন কত ভক্ত হরি হরি বলে।।
কাছে কাছে হরিভক্ত যত জন ছিল।
তারকের কথা শুনি সকলে আসিল।।
মাটিয়ার গাতী গ্রামে সাধু মৃতুঞ্জয়।
তারকের প্রিয় শিষ্য সরল হৃদয়।।
তিনি আসিলেন শুনে তারকের কথা।
তারকের পদে এসে নোয়াইল মাথা।।
কেন্দে বলে ওগো বাবা চরণে জানাই।
মোর মত অভাজন এ জগতে নাই।।
তব চরণে বাবা করি নিবেদন।
মহোৎসব করিবারে হইয়াছে মন।।
তুমি বাবা দিন ধার্য্য করিয়া যে দিবে।
ভক্তগণ সঙ্গে করি উৎসব করিবে।।
তাই শুনে শ্রী তারক কহিল তখন।
ভাল কাজ করিবার হয় যদি মন।।
সাত দিন পরে যেই বুধবার হবে।
সেই দিন সাধু সেবা করিতে হইবে।।
তাই শুনি মৃত্যুঞ্জয় আনন্দ পাইল।
তারকের পদে পরি প্রণাম করিল।।
তাই শুনে ভক্ত গনে হরিধ্বনি দেয়।
কীর্তনে মাতিল সবে আনন্দ হৃদয়।।
হরিনামে মাতোয়ারা হল ভক্তগণ।
সারা নিশি হল তথা নাম সংকীর্তন।।
নিবারণ পড়িলেন তারকের পায়।
পরিবার সহ এসে গড়াগড়ি যায়।।
কেহ কেহ কান্দিতেছে হরি হরি বলি।
কেহ কেহ নচিতেছে দুই বাহু তুলি।।
বহু পরে প্রেম নিধি হল শেষে ক্ষান্ত।
হরি হরি বলে সবে হইলেন শান্ত।।
তারপর সবে মিলে পান্থা সেবা করি।
এক ঠাই বসিলেন বলে হরি হরি।।
কত জনে দরবার করিল আসিয়া।
তারকরে পদে পড়ে কহিছে কান্দিয়া।।
আমাদের ঘরে গিয়ে পদধুলী দাও।
অধমের মনবাঞ্ছা তুমি যে পুরাও।।
এই ভাবে কত জনে কত কি কহিল।
সবাকার ঘরে ঘর ঘুরিতে লাগিল।।
এই ভাবে পাঁচদিন গত হয়ে গেল।
কাতলী হইতে এক সংবাদ আসিল।।
নিবারণে বাড়ী যেতে সংবাদ পাঠায়।
নিবারণ জানাইল তারকের পায়।।
ধান কাটা বাঁধিয়াছে আমি বাড়ী যাই।
পদে যেন থাকে ভক্তি এই ভিক্ষা চাই।।
তারক বলেছে গৃহে চলে যাও তুমি।
মাটিয়ায় গাতী গ্রামে চলে যাব আমি।।
সেই খানে মৃত্যুঞ্জয় সাধু সেবা দিবে।
পার যদি তুমি বাছা সেখানে আসিবে।।
নিবারণ চলে গেল দুঃখ করি মনে।
সংসারের কর্ম করে গুরু চিন্তা প্রাণে।।
তারপর শ্রী তারক করিল গমন।
মাটিয়ার গাতী গ্রামে পৌছাল তখন।।
দুই দিন পরে সেথা সাধু সেবা হবে।
দুই তিন দিন সেথা তারক থাকিবে।।
মৃত্যুঞ্জয় করিতেছে তার আয়োজন।
আশে পাশে যত গ্রাম হল নিমন্ত্রণ।।
এই ভাবে দুই দিন গত হয়ে গেল।।
বুধবার উৎসব আরম্ভ হইল।।
ওদিকেতে নিবারণ গৃহেতে বসিয়া।
বড় ভাই মহেশেরে কহিছে কান্দিয়া।।
বুধবার যেতে হবে মাটিয়ার গাতী।
সেখানে যাইতে মোরে দিবে অনুমতি।।
মহেশ বলেছে ভাই তাহা না হইবে।
ধান কাটা না হইলে কেমনেতে যাবে।।
বারে বারে আমি ভাই করিতেছে মানা।
কোন মতে সেইখানে যেতে পারিবে না।।
তাই শুনে নিবারণ ভাবে মনে মেন।
গুরুর আদেশ আমি পালিব কেমনে।।
এদিকেতে বড় ভাই করিতেছে মানা।
কেমনে যাইব সেথা করে আনাগোনা।।
এক বিঘা জমি মাত্র ধান্য রহিয়াছে।
কেমনে কাটিব ধান মনেতে ভেবেছে।।
সন্ধ্যা বেলা মনে মেন ভাবিতে লাগিল।
তারকের ছবিখানি হৃদয় জাগিল।।
পূর্ণিমার রাত্রি পেয়ে ভাবিল তখন।
কাস্তে হাতে নৌকা বেয়ে করিল গমন।।
কারে কিছু না বলিয়া ধান্য ভূমে গেল।
তারক তারক বলে কান্দিতে লাগিল।।
জলে ভার আখি দু’টি কাস্তে নিয়ে হাতে।
নৌকা পরে বসে ধান লাগিল কাটিতে।।
রাত্রি বেলা ভোজনেতে সকলে বসিল।
নিবারণে না দেখিয়া মহেশ কহিল।।
নিবারণ কোথা গেল বল শুনি তাই।
সকলে কহিল মোরা কেহ দেখি নাই।।
ক্রোধভরে সে মহেশ কহিল তখন।
মোর কথা নাহি শুনে সেই নিবারণ।।
কয় দিন সাধু গিরি করিয়া আসিল।
আজ বুঝি পালাইয়া উৎসবে গেল।।
এই বার বাড়ি এলে শুন সবে ভাই।
পৃথক করিয়া দিব মোর ইচ্ছা তাই।।
এই ভাবে কত কথা মহেশ কহিল।
তারপর সবে মিলে শয়ন করিল।।
ভোর বেলা সে মহেশ জাগিয়া তখন।
বাড়ীর প্রাঙ্গনে এসে করে নিরীক্ষণ।।
তথা হতে সে জমিতে দেখিবারে পায়।
নিবারণ কাটে ধান বসিয়া নৌকায়।।
আর এক জন ধান কাটে সে নৌকায়।
আধ আধ অন্ধকারে চেনা নাহি যায়।।
তাই দেখে সে মহেশ আর নৌকা নিয়ে।
ধীরে ধীরে চলিলেন তরী খানি বেয়ে।।
কিছু দুর গিয়ে দেখে আশ্চর্য্য ঘটনা।
নৌকা পরে ধান কাটে তারক রসনা।।
শ্রী তারক নিবারণ কাটিতেছে ধান।
তাই দেখে সে মহেশ ভাবে মনে মন।।
কত কিছু মনে মনে ভাবিতে লাগিল।
ধীরে ধীরে তরী খানি বাহিয়া চলিল।।
নিকটেতে গিয়ে দেখে আর কেউ নাই।
একা সেই নিবারণ ধান কাটে তাই।।
সকল জমির ধান কাটা হয়ে গেছে।
তাই দেখে সে মহেশ কান্দিয়া বলেছে।।
শুন ভাই নিবারণ তোমাকে জানাই।
মোর মত অভাজন এ জগতে নাই।।
এত বলি নিবারণে বুকেতে ধরিয়া।
জলে ভরা আখি দু’টি কহিছে কান্দিয়া।।
তব নায় ধান কাটে তারক রসনা।
তোমা আমি কোন দিন কাজে কহিব না।।
চল ভাই গৃহে যাই বলিব কি আর।
তারকের পদে গিয়ে মাগি পরিহার।।
তাই শুনে নিবারণ চরণে পড়িল।
মহেশের পদধরি কান্দিতে লাগিল।।
তার পর দুই ভাই কান্দিয়া কান্দিয়া।
নৌকা বেয়ে আসিলেন গৃহেতে চলিয়া।।
গৃত হতে দুই ভাই করিল গমন।
ভাবে গত গত চিত্ত ঝরে দু’নয়ন।।
মাটিয়ায় গাতী চলে ভাই দুই জন।
চক্ষু জলে বক্ষ ভাসে আনন্দিত মন।।
মৃত্যুঞ্চয় ভবনেতে সংকীর্তন হয়।
চারিদিকে হরিভক্ত হরিগুণ গায়।।
তার মধ্যে বসে আছে তারক গোঁসাই।
হেনকালে উপনীত হল দু’টি ভাই।।
তারকের পদে পড়ে কান্দিতে লাগিল।
তাই দেখে শ্রীতারক বলিয়া উঠিল।।
শুন বলি নিবারণ বলি তব ঠাই।
হাতে মোর ঠোষা প’ল চেয়ে দেখ তাই।।
সারা নিশি ধান কেটে হাতে পল ঠোষা।
কিবা দিয়ে বুঝাইব নাহি মোর ভাষা।।
তাই দেখে সে মহেশ গড়াগড়ি যায়।
তারকের পদ ধরি কেন্দে কেন্দে কয়।।
ক্ষম বাবা অপরাধ অধম বলিয়া।
আজ হতে নিবারণে দিলাম সপিয়া।।
আজ হতে কয় ভাই সংসারে খাটিব।
নিবারণে কোন দিন কাজে না বলিব।।
তাই শুনে নিবারণ কেন্দে কেন্দে কয়।
মহেশের পদে পড়ে গড়াগড়ি যায়।।
তুমি মোর জেষ্ঠ্য ভাই পিতৃতুল্য হও।
করিয়াছি অপরাধ ক্ষমা করে দাও।।
তারপর তারকের পদধরি কয়।
তোমার চরণ বিনে দাঁড়াব কোথায়।।
তোমার চরণে বাবা এই ভিক্ষা চাই।।
জনমে জনমে যেন ভুলিয়া না যাই।।
সেই খানে হরিভক্ত যত জন ছিল।
তারকের পদে পড়ে কান্দিতে লাগিল।।
সবাকার নয়নেতে বারি ধারা বয়।
প্রেমের তরঙ্গে সবে ভাসিয়া বেড়ায়।।
তাই দেখে মনে মনে ভাবে মৃত্যুঞ্জয়।
পরিবারসহ এসে পড়িল ধারায়।।
প্রেমের তরঙ্গ ওঠে আকাশ ভেদিয়া।।
তার মধ্যে ভক্তগণে বেড়ায় ভাসিয়া।।
নারী কি পুরুষ তার নাহি ভেদ জ্ঞান।
প্রেমের পাথারে সবে ভাসিয়া বেড়ান।।
হরি হরি হরি বলে যত ভক্তগণ।
লেখা দিয়া কি বুঝাব আমি অভাজন।।
বহু পরে প্রেমনিধি হইলেন ক্ষান্ত।
হরি হরি হরি বলে সবে হল শান্ত।।
অধম বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে।
তারকের ছাবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।।
তাই বলি ওরে মন বেলা বেশি নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!