ভবঘুরেকথা
তারক ঠাকুর

শ্রী শ্রী তারক চাঁদের হরি দর্শণ
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ভাবিয়া হৃদয়।
তারক চাঁদের কথা লিখিব ভাষায়।।
শিশু রূপে ব্যাসদেব মাতৃ কোলে বসে।
চরিদিকে নিরিখিয়া খল খল হাসে।।
তাই দেখে অন্নদার ভরে ওঠে বুক।
তারকের ভাব দেখে কত পায় সুখ।।
কাশীনাথ তারকের কোলেতে করিয়া।
আনন্দেতে আত্মহারা বেড়ায় নাচিয়া।।
এই ভাবে কতদিন গত হয়ে গেল।
পঞ্চ বর্ষ গত হলে হাতে খড়ি দিল।।
পাঠশালে সে তারক বিদ্যা শিক্ষা করে।
একবার শোনে যাহা বলে দিতে পারে।।
শিক্ষক্ষেরা তারকেরে অতি ভালবাসে।
অতি যত্নে শিক্ষা দেয় মনের উল্লাসে।।
এত বড় শ্রুতিধর কভু দেখি নাই।
মনেতে আনন্দ পায় শিক্ষক সবাই।।
এই ভাবে বিদ্যাশিক্ষা করিতে লাগিল।
প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ হযে গেল।।
তারপর কাশীনাথ তারকে লইয়া।
কবিগান শিক্ষা দেয় আসরেতে নিয়া।।
পাঁচালী বলিতে যবে কবির খোলায়।
বসিয়া শুনিত তাহা অনন্দ হৃদয়।।
তারপর বাহিরেতে যখন আসিত।
সে তারক সেই ভাবে পঁচালী বলিত।।
তাই শুনি সকলেতে মানিত বিশ্বয়।
এই ছেলে বড় কবি হইবে নিশ্চয়।।
তাই শুনি কাশীনাথ আনন্দ হৃদয়।
তারকেরে কোলে করি মুখে চুমু দেয়।।
বাড়ী এসে তারকেরে শাস্ত্র পড়াইত।
অল্পদিনে সেতারক মুখস্থ করিত।।
গীতা গ্রন্থ অল্প দিনে কন্ঠস্থ হইল।
বেদ পুরাণাদি সব শিক্ষা করে নিল।।
পিতার কাছেতে কবিগান শিক্ষা করে।
তারপর কি হইল বলিব সবারে।।
পঞ্চদশ বর্ষ যবে হইল তাহার।
শুভক্ষণে কাশীনাথ তেজিল সংসার।।
পিতৃ হারা সে তারক কান্দিতে লাগিল।
কোনমতে পিতৃ কার্য্য সমাধা করিল।।
কি করিবে কোথা যাবে ভাবিয়া না পায়।
মায়ের চরণ ধরি কেন্দে কেন্দে কয়।।
বল মাগো কি করিব চরণে জানাই।
কি ভাবে বাঁচিব মাগো বলে দাও তাই।।
অন্নদা বলিল বাবা শুন দিয়া মন।
পিতার আদর্শ তুমি করহে পালন।।
সূর্য্য নারায়ণ আছে ডুমুরিয়া গায়।
কাঙ্গালি নামেতে আছে সেই মদুয়ায়।।
কবির দোয়ার তারা ভাল দুই জন।
দল করি কবি গাও শুন বাছাধন।।
মাতৃ আজ্ঞা শুনি কানে তারক সুজন।
সূর্য্য নারায়ণে গেল আনিতে তখন।।
সূর্য্য আর কাঙ্গালীকে সঙ্গেতে করিয়া।
দেশে দেশে কবিগান বেড়ায় গাহিয়া।।
তারকের কন্ঠস্বর মোটে ভাল নয়।
ধুয়া গান গেলে পরে লোকে মন্দ কয়।।
এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল।
মাঝে মধ্যে কবিগান গাহিতে লাগিল।।
একদিন চলিলেন চালনা গ্রামেতে।
সূর্য্য নারায়ণ আর কাঙ্গালী সঙ্গেতে।।
কবিগান গাহিবারে হইল উদয়।
সেই দিন সেই গ্রামে আসে মৃত্যুঞ্জয়।।
কাঙ্গালীর গুরু সেই সাধু মৃত্যুঞ্জয়।
কালীনগরেতে বাস করে মহাশয়।।
কাঙ্গালী চরণে গিয়া প্রণাম করিল।
সূর্য্য নারায়ণ গিয়ে পদে প্রণামিল।।
উভয়ের গুরু সেই সাধু মৃত্যুঞ্জয়।
তাই দেখে সে তারক ভাবিল হৃদয়।।
কেমন গোঁসাই এই ভাবিতে লাগিল।
কি যেন কি আকর্ষণে প্রেম সঞ্চারিল।।
তারপর গেল সবে কবির খোলায়।
কবি গাহিতেছে সবে আনন্দ হৃদয়।।
হেন কালে মৃত্যুঞ্জয় হইল উদয়।
সযতনে সবে মিলে আসনে বসায়।।
মৃত্যুঞ্জয় গান শোনে আসরে বসিয়ে।
তারকের মন গেল দিশে হারা হয়ে।।
কি যেন কি আকর্ষণে ভুল হয়ে যায়।
তাই মৃত্যুঞ্জয় দেখে হইল বিদায়।।
আশ্রমেতে গেল তিনি কাঙ্গালীকে কয়ে।
সকালে যাইও সবে তারকেরে লয়ে।।
সেই গ্রামে গান শেষে রাত্রি কাটাইল।
প্রভাতে উঠিয়া সবে আশ্রমেতে গেল।।
আশ্রমে বসিয়া আছে সাধু মৃত্যুঞ্জয়।
হেন কালে কয় জন হইল উদয়।।
তারক কাঙ্গালী আর সূর্য্য নারায়ণ।
প্রণাম করিল সবে আনন্দিত মন।।
হরি বলে আশীর্বাদ করিল গোঁসাই।
সকলেতে সুখে রবে কোন চিন্তা নাই।।
শুন শুন ও তারক আমার বচন।
গতকাল কবিগান করিলে যখন।।
শ্রী কৃষ্ণের রূপ তুমি করিলে বর্ণণ।
নিজে কি দেখেছ তুমি শুন বাছাধন।।
তারক বলেছে আমি নিজে দেখি নাই।
শাস্ত্রে যাহা লেখা আছে বলিলাম তাই।।
তাই শুনি মৃত্যুঞ্জয় বলিল তখন।
নিজে তুমি দেখ নাই করিলে বর্ণণ।।
লেখা কথা দিয়ে তুমি বর্ণণা করিলে।
আরো কত ভাল হত স্বচক্ষে দেখিলে।।
তারক বলেছে কেউ দেখাইতে পারে।
চরণের দাস হব এই ধরা পরে।।
তারকের কথা শুনে বলে মৃত্যুঞ্জয়।
মোর সঙ্গে ভগবান হাসি কথা কয়।।
ক্ষীরোদ সাই শ্রীহরি জন্মিল ধরায়।
লীলা করে ধরা ধামে ওড়াকান্দি গাঁয়।।
পতিত পাবন বলে অবতীর্ণ হল।
হরিনামে পাপতাপ সকল নাশিল।।
তারক বলেছে আমি আশ্চর্য্য হয়েছি।
চাব্বক পুরানে আমি দেখিতে পেয়েছি।।
ক্ষীরোদ সাই হরির অঙ্গে চিহ্ন আছে।
বত্রিশটি চিহ্ন তার অঙ্গেতে রয়েছে।।
তাই যদি নিজ চোখে দেখিবারে পাই।
চির দাস হয়ে রব চরণে জানাই।।
তাই শুনে মৃত্যুঞ্জয় বলিল বচন।
নিজ চোখে দেখে নিও ওহে বাছাধন।।
হিসাব করিয়া তুমি দেখিবে কখন।
দেখিলে স্বার্থক হবে তোমার জীবন।।
তাই শুনি শ্রী তারক প্রণমিল পায়।
ছল ছল আখি দু’টি কেন্দে কেন্দে কয়।।
আজ হতে তুমি মোর গুরু রূপ হও।
মোরে নিয়ে ওহে গুরু হরিকে দেখাও।।
গুরু পদে ধরি কান্দে তারক সুজন।
ভক্তি গদ গদ চিত্তে ঝরে দু’নয়ন।।
তারকের কান্না দেখে কহে মুত্যুঞ্জয়।
শুন শুন ওরে বাছা বলি যে তোমায়।।
ঠাকুর দেখিবে বলে মন যদি চায়।
নিশ্চই ঠাকুর আমি দেখাব তোমায়।।
এই রূপে ভক্তি পদে থাকে যদি মন।
করুণা করিয়া হরি দিবে দরশন।।
এই কথা বলে তিনি তারকে ধরিল।
হস্ত ধরে উঠাইয়া শান্তনা করিল।।
প্রশস্থ গার্হস্থ ধর্ম শিখাবার তরে।
হরিচাঁদ অবর্তীর্ণ এ ভব সংসারে।।
হাতে কাম মুখে সদা হরি নাম সার।
অনায়াসে হয়ে যাবি ভব সিন্ধু পার।।
এই ভাবে তারকেরে কত বুঝাইল।
বলে কয়ে তারকেরে বিদায় করিল।।
গৃহে গিয়ে তারকের মন সুস্থ নাই।
হরিচাঁদ দেখিবারে কেন্দে ছাড়ে হাই।।
পুনরায় আসিলেন মৃত্যু্ঞ্জয় ঠাই।
কেন্দে বলে ওহে গুরু তোমাকে জানাই।।
হরিচাঁদ দেখিবারে মন উচাটন।
এখনি আমাকে নিয়ে কর হে গমন।।
তাই ‍শুনি মৃত্যুঞ্জয় কহিল তখন।
ভোজন করিয়া মোরা করিব গমন।।
মৃত্যুঞ্জয় ডেকে বলে কাশীশ্বরী ঠাই।
শীঘ্র করে খেতে দাও শ্রীধামেতে যাই।।
তাই শুনে কাশীশ্বরী রন্ধন করিল।
রন্ধন করিয়া দেবী কহিতে লাগিল।।
সেবায় বসিবে সবে করেছি রন্ধন।
তাই শুনে দুই জন করিল ভোজন।।
ভোজনান্তে দুই জনে শ্রীহরি স্মরিয়া।
যাত্রা করে ওড়াকান্দি আনন্দে মাতিয়া।।
অগ্রভাগে মৃত্যুঞ্জয় করিল গমন।
পিছে পিছে চলিতেছে তারক সুজন।।
জলে ভরা আখি দু’টি চলে পিছে পিছে।
উদয় হইল গিয়ে ঠাকুরের কাছে।।
তারকে হেরিয়া হরি কহিল তখন।
হাসিমুখে কহিতেছে মধুর বচন।।
বল দেখি মৃত্যুঞ্জয় কোথা হতে আলি।
এই তোতা পাখি তুই কোথায় পাইলি।।
আমাকে দিয়ে যাবি এই তোতা পাখি।
তাইলেই অন্তরেতে হই আমি সুখি।।
এই কথা যখনেতে হরিচাঁদ কয়।
তারক হেরিয়া রূপ ভাবলি হৃদয়।।
অনিমেষে চেয়ে চেয়ে ভাবিতে ভাবিতে।
ঠাকুরের অঙ্গচিহ্ন লাগিল গুনিতে।।
এক হতে অষ্টবিংশ গুনিল যখন।
অন্তর্যামী হরিচাঁদ জানিল তখন।।
হস্তপদ বিস্তারিয়া আলস্য ছাড়িল।
আর চারি চিহ্ন তাহে দেখিতে পাইল।।
তাই দেখে সে তারক চরণে পড়িল।
চরণ ‍ধরিয়া শেষে কান্দিতে লাগিল।।
কেন্দে বলে ওগো প্রভু করি নিবেদন।
দয়া করে অধমেরে কর হে গ্রহণ।।
ক্ষীরোদের সাই তুমি পূর্ণানন্দ হরি।
তোমার গুণের সীমা বর্ণিতে কি পারি।।
তুমি হরি গুণনিধি জগতের সার।
আজ হতে মন প্রাণ সকল তোমার।।
ঠাকুর বলেছে বাছা মন ঠিক চাই।
তোর মত ভক্ত যেন যুগে যুগে পাই।।
প্রশস্থ গার্হস্থ ধর্ম পালন করিবে।
হাতে কাম মুখে সদা হরি নাম লবে।।
পর স্ত্রীকে মাতৃবত দেখিবে সদায়।
মুখে সত্য কথা কবে সকল সময়।।
আমার এ যুগ ধর্ম করিবে প্রচার।
সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় হরি নাম সার।।
তাই শুনে সে তারক কান্দিয়া কহিল।
মোর এক নিবেদন চরণে রহিল।।
দেশে দেশে ওগো প্রভু কবিগান গাই।
কন্ঠস্বর ভাল নয় চরণে জানাই।।
তারকের কথা শুনে হরিচাঁদ কয়।
শুন শুন ও তারক বলি যে তোমায়।।
হাটে গিয়ে যার সনে তব দেখা হবে।
মোর গান শোনে নাক তাহাকে কহিবে।।
সাত হাট সেধে সেধে হও অপমান।
তারপর ওগো বাছা গাও কবিগান।।
সে সব বৃত্তান্ত লীলামৃত লেখা আছে।
নিজ হাতে শ্রী তারক তাহা লিখিয়াছে।।
সেই হতে সে তারক হইলেন ভক্ত।
পাশরিতে নারে গুণ সদা কর ব্যক্ত।।
দেশে গিয়ে সে তারক হাটে হাটে গিয়ে।
মোর গান শোনে নাক বেড়ায় কহিয়া।।
সাত হাটে সেধে সেধে হল অপমান।
তারপর সে তারক গায় কবিগান।।
অধম বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে।
তারকের ছবি খান হৃদয়েতে বন্দে।।
তাই বলি ভাই সব বেলা বেশি নাই।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি বল ভাই।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!