-নূর মোহাম্মদ মিলু
‘কাসিদায়ে বুরদা’ শরীফের রচয়িতা হযরত শেখ আবু আবদুল্লাহ শরফউদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে সাইদ ইবনে হাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ বুসিরী(র:)। ইমাম বুসিরী(র:) নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ লাভ করেন। বুসির বর্তমান মিশরের একটি জনপদ। যতদূর জানা যায়, ইমাম বুসিরী(র:) ৬০৮ সালের ১লা শওয়াল ইংরেজি ১২১৩ (১২১১*) সালের ৭মার্চ দুলাস কসবার সান হাজীয়া কবিলায় জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের অধিকাংশ সময় বুসিরন অতিবাহিত করায় তিনি ইমাম বুসিরী নামে খ্যাত ছিলেন। তিনি কায়রোতে ইংরেজি ১২৯০ (১২৯৪*) সালে ওফাত করেন।
হযরত ইমাম বুসিরী(র:) একজন প্রসিদ্ধ বুজুর্গ, সুপ্রসিদ্ধ কবি, বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও বহু ভাষাবিদ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি প্রচুর কবিতা রচনা করেন। সে যুগে তাঁর মতো স্বভাবসিদ্ধ কবি আর কেউ ছিল না। তৎকালীন জামানার আলেম সমাজ ও শাসকগোষ্ঠীর নিকট ইমাম বুসিরী(র:) যথেষ্ট সম্মান ও শ্রদ্ধারপাত্র ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তাকওয়া ও পরহেজগারীর জন্যও তার বেশ খ্যাতি ছিল ।
রচনার প্রেক্ষাপট
একবার তিনি দুরারোগ্য পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হন। ফলে তাঁর শরীরের এক পার্শ্ব অবশ হয়ে যায়। ফলে তাঁর চলাফেরা বন্ধ হয়ে যায়। রোগ থেকে মুক্তির জন্য তিনি যথাসাধ্য চিকিৎসা করান কিন্তু কোন ফল হয় না। এতে কবি নিরাশ হয়ে পরেন। একদিন এক অদৃশ্য ইঙ্গিতে ইমাম বুসিরী(র:) এক জু’মার রাতে একা এক নির্জনে ঘরে পূর্ণ ইখলাসের সাথে সরওয়ারে কায়নাত সরদারে দো-জাহান হযুর পুরনূর প্রিয়নবী(সা:) শানে একটি প্রশংসার কবিতা বা কাসীদা রচনা করেন। ইমাম বুসিরী(র:) আশা করেন হয়তবা এই কাসীদার বরকতে মহান আল্লাহ্ সুবহানু তা’আলা তাঁকে দুরারোগ্য ব্যাধি হতে শেফা দান করবেন। মহান আল্লাহ্ সুবহানু তা’আলার শাহী দরবারে রোগ মুক্তির জন্য কান্নাকাটি করেন এবং প্রার্থনা করতে করতে এই অবস্থায় ঘুমিয়ে পরেন। স্বপ্নে নূরনবী (সা:)এর জিয়ারত নসীব হল। কবি স্বপ্নে এই কাসীদাটি সম্পূর্ণ আবৃতি সহকারে রাসুলুল্লাহ (সা:) কে শুনালেন। হযুর(সা:) শ্রবণ করে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর পবিত্র হাত মুবারক দ্বারা কবির পক্ষাঘাত আক্রান্তস্থানে মুছে দিলেন ও তাঁর পবিত্র নক্সাদার ইয়ামেনী চাঁদর দ্বারা ইমাম বুসিরী(র:)কে ঢেকে দিলেন। ইমাম বুসিরী(র:)-এর ঘুম ভেঙ্গে গেল। তিনি জেগে উঠে বসলেন ও দেখতে পেলেন যে তাঁর শরীরে রোগের কোন চিহ্নই নেই! তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছেন। আরো অবাক হলেন যে, তাঁর শরীরে একটি নকশাযুক্ত ইয়ামেনী চাঁদর শোভা পাচ্ছে।
সকালে উঠে তিনি তাই করেন এবং খোদার মর্জিতে পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেন। তাই এই কাসিদাশরীফ যে কোনো লোক রোগমুক্তির আশায় পাঠ করবে আল্লাহপাক এই কাসিদার উছিলায় রোগমুক্ত করে দেবেন ইনশাআল্লাহ
তিনি সকালে ঘর থেকে বের হলে স্বীয় বন্ধু শেখ আবু রাজার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তিনি কবিকে বলেন জনাব! আপনার সেই কাসিদাটি দিনতো। যেটি আপনি রাসূলুল্লাহর প্রশংসায় রচনা করেছেন। ইতোপূর্বে কবি কাসিদাতুল বুরদাহর কথা কাউকে জানাননি। তিনি বললেন, আপনি কোন কাসিদাটি চাচ্ছেন? আমিতো অনেক কাসিদাতেই রাসূলুল্লাহর প্রশংসা করেছি। বন্ধু বললেন সেইটি যার প্রথম লাইন-
ﺍﻣﻦ ﺗﺬﻛﺮ ﺟﻴﺮﺍﻥ ﺑﺬﻯ ﺳﻠﻢﻣﺰ
ﺟﺖ ﺩﻣﻌﺎ ﺟﺮﻯ ﻣﻦ ﻣﻘﻠﺔ ﺑﺪﻡ
কবি বললেন, হে আবু রাজা আপনি কোথা থেকে এই কবিতা মুখস্থ করলেন? আমি তো কাউকে এটা পড়ে শোনাইনি। আবু রাজা বললেন, আমি গতকাল শুনছিলাম, আপনি এটি রাসূলুল্লাহর সামনে আবৃতি করছেন। আর এটি তাঁর পছন্দ হওয়ায় তিনি আন্দোলিত হচ্ছেন, যেমন ফলদ্বরে শাখা বাতাসে আন্দোলিত হয়। ঐ কথা শুনে কবি তখন কাসিদাটি তাকে দিয়েছেন আর তখন থেকে দ্রুত এই কাসিদার কথা সর্বত্র ছড়িয়ে পরে এবং তার বরকত অসাধারণভাবে পরিলক্ষিত হতে থাকে। ক্রমে ক্রমে তা উজির বাহাউদ্দিনের হস্তগত হয়। উজির সাহেব একান্ত শ্রদ্ধাভরে দণ্ডায়মান হয়ে তা প্রতিনিয়ত শ্রবণ করতে থাকেন।
বর্ণিত আছে, উজিরের নায়েব সায়াদুদ্দীন ফারুকী সাহেব দৃষ্টি শক্তিহীন হয়ে যায়। স্বপ্নে এক বুযুর্গ ব্যক্তি তাঁহাকে বলেন, তুমি বাহাউদ্দীনের নিকট হতে ‘কাসিদায়ে বুরদা’ নিয়ে আপন নেত্র যুগলে বুলিয়ে দাও। সকালে উঠে তিনি তাই করেন এবং খোদার মর্জিতে পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেন। তাই এই কাসিদাশরীফ যে কোনো লোক রোগমুক্তির আশায় পাঠ করবে আল্লাহপাক এই কাসিদার উছিলায় রোগমুক্ত করে দেবেন ইনশাআল্লাহ ।
নামকরণ
পরবর্তীকালে ইমাম বুসিরী(র:) এই কাসীদাটি পুস্তক আকারে প্রকাশ করেন এবং উম্মতে মুহাম্মদী (সা:) কে উৎসর্গ করেন। এ কাসিদার মূলনাম ‘আল কাওয়াকিবুদ দুররিয়া ফি মাদহি খাইরিল বারিয়্যাহ’ (শ্রেষ্ঠ মানবের প্রশংসায় উজ্জ্বল নত্রমালা)। এ নামেই কাসিদাটি প্রথম দিকে খ্যাতি লাভ করে। মূলনাম ছাড়াও কাসিদাটির আরো দু’একটি নাম প্রচলিত আছে। এর একটি নাম বুরআহ অর্থাৎ আরোগ্য। যেহেতু কবি এই কাসিদার বদৌলতে রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করেছিলেন। তাই এই নামকরণ।
কবির স্বপ্নের মধ্যে এই কাসিদা শুনে রাসূলুল্লাহ খুশি হয়েছিলেন। যার বরকতে তিনি পাঘাত থেকে আরোগ্যলাভ করেছিলেন। এই তাৎপর্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এর আরো একটি নাম ‘বুরদিয়্যাহ’ প্রচলিত আছে।
তবে এই কাসিদার সর্বাধিক পরিচিতি নাম আল বুরদাহ। বুরদাহ শব্দের অর্থ ডোরাকাটা বা নকশি চাদর। এই নামকরণের একটি তাৎপর্য এই যে, নকশি চাদরের যেমন নানান রং ও বিচিত্র নকশা থাকে, তেমনি রাসূলুল্লাহর প্রশংসায় এই কাসিদাতে বিচিত্র বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। এই নামকরণের সর্বাধিক প্রচলিত তাৎপর্য এই যে, কবির স্বপ্নের মধ্যে এই কাসিদা শুনে রাসূলুল্লাহ খুশি হয়েছিলেন। যার বরকতে তিনি পাঘাত থেকে আরোগ্যলাভ করেছিলেন। এই তাৎপর্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এর আরো একটি নাম ‘বুরদিয়্যাহ’ প্রচলিত আছে।