হিংসার প্রতিফল
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ।
ঘটনা প্রবাহ এক করিব বর্ণন।।
পদুমা গ্রামেতে ছিল কাঙ্গাল ব্যাপারী।
তারক চান্দের দলে করিত দোঁহারী।।
তাহার জেষ্ঠ্য ভায়ের এক কন্যা ছিল।
উত্তম মণি নামেতে রূপে গুণে ভাল।।
পিতা মাতা কেহ নাই কাঙ্গালী পালিত।
কাঙ্গালীকে পিতৃজ্ঞানে সে মেয়ে ভাবিত।।
কন্যাসম সে কাঙ্গালী করিত পালন।
উত্তম বলিয়া তারে ডাকিত কখন।।
এই ভাবে কত দিন গত হয়ে যায়।
নয় বর্ষ গত হলে তারে বিয়ে দেয়।।
বিবাহ হইল তার চালনা গ্রামেতে।
বিধিলিপি ছিল যাহা কে পারে খণ্ডাতে।
তৃতীয় বছরে তার স্বামী মারা গেল।
বিধবা হইয়া শেষে পদুমায় এল।।
শিশু বেলা যার পিতা মাতা মারা যায়।
তার দুঃখ সারে নাক সব লোকে কয়।।
এসময় সে কাঙ্গালী সে হইল প্রাচীন।
আজ মরে কাল মরে দেহ হল ক্ষীণ।।
উত্তম মণির দুঃখে কাঙ্গালী দুঃখিত।
জলে ভরে আখি দু’টি তাহাকে কহিত।।
শুন শুন শুন মাগো বলি তব ঠাই।
সৎপথে থাক যদি কোন চিন্তা নাই।।
আমি আর বেশি দিন রব না ধরায়।
বিষয় সম্পদ যাহা দিলাম তোমায়।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ হৃদয় ধরিয়া।
তারকেরে ভালবাস মনপ্রাণ দিয়া।।
হরিভক্তগণ যদি আসে তব ঘরে।
সেবা করাইবে সবে অতি সমাদরে।।
হাতে কাম মুখে সদা হরি নাম লও।
চরিত্র পবিত্র রেখে জীবন কাটাও।।
এই ভাবে সে কাঙ্গালী কত বুঝাইল।
কিছু দিন পরে সে যে জীবন তেজিল।।
তারপর কত দিন গত হয়ে গেল।
একদিন সে তারক পাদুমায় এল।।
তারকেরে চক্ষে হেরি উত্তম তখন।
মনপ্রাণ সপে দিয়ে করিত ভজন।।
উত্তম মণির ঘরে তারক আসিত।
দুই চারিদিন তথা আনন্দে থাকিত।।
নিস্কাম নিয়মে তারে ভালবাসা দিত।
ভালবাসা এড়াইয়া যেতে না পারিত।।
এ সময় উত্তমের বয়স যৌবন।
পচিশ ছাব্বিশ তার হবে অনুমান।।
এই ভাবে সে তারক আসিত যাইত।
পাড়া প্রতিবেশী তারা কত কি ভাবিত।।
যে যেমন লোক সেই তেমন বুঝিয়া।
যার যার মন কথা বেড়াত কহিয়া।।
পাষণ্ডী যতেক লোক ভাবিত সদাই।
কেমন মানুষ এই তারক গোঁসাই।।
যুবতী মেয়ের সঙ্গে একি ব্যাবহার।
এক ঘরে শুয়ে থাকে কেমন বিচার।।
এই ভাবে কানাকানি করিত সকলে।
ছিল এক মাতুব্বর তার কাছে বলে।।
শুনিয়া সে মাতুব্বর ভাবে মনে মন।
কৌশল করিয়া তারে মারিব পরাণে।।
দুষ্ট লোক যত ছিল হয়ে একত্তর।
পরামর্শ করিলেন সেই মাতুব্বর।।
যেই দিন আসিবে সেই তারক গোঁসাই।
আমি গিয়ে বলিব সেই উত্তমের ঠাই।।
গোঁসাই এসেছে যদি মোর কথা লও।
আমাদের লয়ে তুমি হরিলুট দাও।।
মোর কথা শুনে সেই হরিলুট দিবে।
সেই দিন সবে মিলে সেখানে আসিবে।।
সেই খানে হরিনাম হইবে যখন।
হরিনামে মাতোয়ারা হইবি তখন।।
মাতোয়ারা হয়ে আমি দ্বীপ নিবাইব।
তারকের পিছে গিয়ে আমি লুকাইব।।
সেই ফাঁকে তোরা গিয়ে মুখে ঘুষি দিবি।
মাটিতে ফেলিয়ে তারে প্রহার করিবি।।
এই ভাবে পরামর্শ করিল সবাই।
কিছুদিন পরে এল তার গোঁসাই।।
তারকেরে চক্ষে হেরি উত্তম তখন।
ভক্তিভরে ধোয়াইল যুগল চরণ।।
বসিতে আসন দিল গৃহ মধ্যে নিয়া।
সেবা করাইল তারে কান্দিয়া কান্দিয়া।।
তাই যেনে পাষন্ডীরা কহিল তখন।
উত্তম মণির কাছে করিল বর্ণন।।
ভাল হল তব গৃহে আসিল গোঁসাই।
হরিলুট দাও যদি আসিব সবাই।।
তাই শুনে সে উত্তম তারকে জানায়।
হরিলুট দিতে বলে গ্রামের সবাই।।
তারক বলেছে তুমি হরিলুট দিবে।
ভাল কাজ কর তুমি আর ভাল হবে।।
তাই শুনে সে উত্তম তাহাই করিল।
বাতাসা কিনিয়ে এনে নিমন্ত্রণ দিল।।
নিমন্ত্রণ পেয়ে তারা সকলে আসিল।
তারকেরে সঙ্গে করি লুট সাজাইল।।
অন্তরেতে হিংসা নিয়ে আসিল সকলে।
বাহিরে সরল ভাষা হরি হরি বলে।।
সংকীর্তন করিতেছে সকলে মিলিয়া।
হরিনাম করে তারা মাতিয়া মাতিয়া।।
হেন কালে মাতুব্বর দ্বীপ নিভাইল।
তাই দেখে সে তারক অদৃশ্য হইল।।
হরি বলে ঘুষি মারে তারকে ভাবিয়া।
মাতুব্বরের নাকে মুখে লাগিল আসিয়া।।
নাকে মুখে রক্ত উঠে মাটিতে পড়িল।
চারি দিক হতে সবে মারিতে লাগিল।।
অন্ধকারে কেহ কারে চিনিতে না পারে।
তালে তালে হরি বলে জোরে ঘুষি মারে।।
মার খেয়ে মাতুব্বর অজ্ঞান হইল।
কারে কারো হস্ত পদ ফুলিয়া উঠিল।।
এই ভাবে অন্ধকারে এই কান্ড হয়।
তারক বাহিরে এসে উত্তমেরে কয়।।
কেবা কার মাথা খায় তারক কহিল।
তাই শুনে উত্তমণি হাসিতে লাগিল।।
হরি বলে ঘরে বসে সোর গোল হয়।
অন্য লোক আলো জ্বেলে আসিল তথায়।।
তারা সবে ঘরে গিয়ে দেখিবারে পায়।
মোড়োলের দৃশ্য দেখে করে হায় হায়।।
কার কার হস্তপদ ফুলিয়া উঠেছে।
তারকেরে হিংসা করে কুফল ফলেছে।।
তাই দেখে সবে এসে পড়িলেন পায়।
তারকের পদে পড়ে গড়াগড়ি যায়।।
কেহ কেহ কেন্দ কেন্দে তারকেরে কয়।
ওগো বাবা কর ক্ষমা ধরি তব পায়।।
তাই দেখে তারকের দয়া উপজিল।
হরি বলে সে তারক ক্ষমা করে দিল।।
সেই হতে তারা সবে হরি ভক্ত হল।
অধম বিনোদ বলে হরি হরি বল।।