ভবঘুরেকথা
মতুয়া সংগীত

গোস্বামী হীরামনের প্রতি কালাচাঁদ ফকিরের অত্যাচারের বিবরণ।
পয়ার

সাহাপুর মধ্যেতে আঁধারকোটা গ্রাম।
সেখানে ফকির আছে কালাচাঁদ নাম।।
সে ফকির পরিচয় কহিব এখন।
নাম কালাচাঁদ নমঃশূদ্রের নন্দন।।
বাওয়াল করিত গিয়া বাওয়ালীর সনে।
শিক্ষা তার মুসলমান ফকিরের স্থানে।।
লক্ষ্মীকালা ফকির সে ব্রাহ্মণের ছেলে।
বাদায় থাকিত সেও ফকিরামী নিয়ে।।
তাহার নিকটে শিক্ষা করে কালাচাঁদ।
ফকিরামী শিখে বাদা করেন আবাদ।।
আদি যে ফকির সেও মুসলমান ছিল।
সে ফকির হইতে ইহারা শিক্ষা নিল।।
চকে গিয়া দিত গাজী কালুর দোহাই।
চকে চকে বনে বনে নামিত সবাই।।
কালীর দোহাই দিত মনসা পূজিত।
বরকোত বিবি, লক্ষ্মীকালাকে ডাকিত।।
মাদার মুরসিদ বলি ছাড়িত জিগীর।
খোদার ফকির মুই আল্লাহ ফকির।।
আল্লা আলী হজরত আর লক্ষ্মীকালা।
হিন্দু ছেলে দিত গলে তছমীর মালা।।
হেলেল্লা হেলেল্লা বলে হইত আকুল।
হাতে ছিল লক্ষ্মীকালা দত্ত এক রুল।।
চকে গিয়া লোকে সুন্দরী কাঠ কাটিত।
রুল দিয়া গাছে এক আঘাত করিত।।
সেই আঘাতের শব্দ যতদূরে যেত।
তাহার মধ্যেতে সব সুন্দরী ছেদিত।।
দূরে গিয়া একজনে শব্দ শুনিত। (একেকজনে)
চারিদিকে চারি জন দাঁড়ায়ে রহিত।।
যতদূর শব্দ করি উঠিত সে রুল।
তাহার মধ্যেতে নাহি থাকিত শার্দূল।।
এই ধর্ম ছিল তার লোকমুখে শুনি।
হিন্দুধর্ম কিয়দংশ সকল যাবনি।।
শুকর কচ্ছপ নাহি করিত ভোজন।
মেষ অজা পেজ রসুন কুকুড়া ভক্ষণ।।
কচ্ছপ বরাহ মাংস বলিত হারাম।
রুলের আঘাতে করে রোগের আরাম।।
জ্ঞাতিগণে ডেকে বলে শ্রীচৈতন্য বালা।
এই ফকিরকে এনে সার এ পাগলা।।
লোক পাঠাইয়া সেই ফকির আনিল।
লোক সঙ্গে করিয়া সে ফকির আসিল।।
বাটীর উপরে যবে উঠিল ফকির।
হক আল্লা বলিয়া সে ছাড়িল জিগীর।।
যথা ছিল হীরামন সেইখানে যায়।
রুলখানা ধরি হীরামনকে দেখায়।।
এক এক বার রুল ঊর্ধ্বেতে ফেলায়।
ফেলাইয়া শূন্য হতে পুনঃ ধরি লয়।।
লোফা লোফী করে রুল হীরামন আগে।
দর্প করি হীরামনে কহে রাগে রাগে।।
হারে রে পাগলা কেন কর পাগলাই।
তোরে সারিবারে এল লক্ষ্মীকালা সাঁই।।
রুলাঘাতে করিব যে পাগলাই দূর।
দেখিব কেমন তুই পাইলি ঠাকুর।।
মম বাক্য না রাখিস করিস বাড়াবাড়ি।
পাগলামি করিলে মারিব রুলের বাড়ী।।
সারিবি কি না সারিবি বলরে এখন।
শুনিবি কি না শুনিবি আমার বচন।।
দৃকপাত তাতে নাহি করে হীরামন।
ঝুঁকে ঝুঁকে করে হরিনাম সংকীর্তন।।
প্রেমোন্মত্ত হীরামন উঠিয়া দাঁড়ায়।
ফকিরের পানে হীরে ফিরে ফিরে চায়।।
ফকির কহিছে তুই আয় হীরামন।
বাহিরে আসিয়া বাছা লওরে আসন।।
তাহা শুনি হীরামন উঠিয়া দাঁড়ায়।
আসন পাতিয়া এসে বসিল তথায়।।
ফকির তখন রুল হস্তেতে করিয়া।
মাটিতে আঘাত করে হক আল্লা বলিয়া।।
পুনঃ পুনঃ করে রুল মাটিতে আঘাত।
হীরামন তাতে নাহি করে দৃষ্টিপাত।।
ফকির বলেন তুই এসেছিস কেরে।
হকের বাজারে মোরে পরিচয় দেরে।।
কথা শুনি হীরামন চাহে একদৃষ্টে।
ফকির রুলের বাড়ী মারে তার পৃষ্ঠে।।
তাহাতেও হীরামন কিছুই না বলে।
পুনশ্চঃ আঘাত করে বাহুসন্ধি স্থলে।।
তাহাতেও হীরামন মৃদু মৃদু হাসে।
স্থির হ’য়ে থাকে সাধু আসনেতে বসে।।
ফকির সে হীরামনে ওঠ ওঠ কয়।
অমনি সে হীরামন উঠিয়া দাঁড়ায়।।
ফকির যখনে বলে বয় বয় বয়।
হীরামন আসনে বসেন সে সময়।।
ফকির বলেন তবে সবারে ডাকিয়া।
দেখ সবে গেছে এর পাগল সারিয়া।।
যাহা কহি তাহা করে ব্যাধিমুক্ত হ’ল।
বিদায় করহ মোরে বিপদ ঘুচিল।।
তা শুনি চৈতন্য বালা ফকিরকে কয়।
অদ্য থাক কল্য মোরা করিব বিদায়।।
সংসারে কার্য হীরে করিবে যখন।
তোমাকে বিদায় মোরা করিব তখন।।
ফকির বলিল হীরে দণ্ডবৎ কর।
আসন ছাড়িয়া বাছা উঠে যারে ঘরে।।
পরদিন ফকিরকে বলে সব বালা।
পাগল সেরেছে নাকি দেখ লক্ষ্মীকালা।।
হীরামনে ডাক দিয়া আনহ প্রত্যক্ষে।
আরোগ্য হ’য়েছে কিনা দেখহ পরীক্ষে।।
হীরামনে ডাক দিয়া তখনে আনিল।
আসন উপরে হীরামন বার দিল।।
ফকির বলেছে বাছা কহ শুনি কথা।
হেট মুণ্ডে রহে সাধু নাহি তুলে মাথা।।
মাথা নাহি তুলে সাধু শ্বাস ছাড়ে দীর্ঘ।
সবে বলে কই হ’ল রোগের আরোগ্য।।
রুষিয়া উঠিল তবে ফকির বর্বর।
বড়শী পোড়ায়ে ধরে গ্রীবার উপর।।
সারিয়া না সারিস করিস অপযশ।
এরূপে যাতনা দেয় সপ্তম দিবস।।
ফকিরকে কহে সবে যদি নাহি পার।
তবে আর কেন মিছে পরিশ্রম কর।।
ফকির একথা শুনি দড়ি পাকাইল।
পিটমোড়া দিয়ে হীরামনকে বাঁধিল।।
দল কাটা বেকী অস্ত্র পোড়ায়ে আগুনে।
গ্রীবার উপরে অম্নি ধরিল তখনে।।
কিছু নাহি কহে হীরামন মৃদু হাসে।
ফকির কহিছে ইহা সহে কই মানুষে।।
ইহাকে সারিতে আমি হইলাম ত্যাক্ত।
সারা বড় কষ্ট হ’ল দৃষ্টি বড় শক্ত।।
ইহাকে যে ধরেছে করিব তারে ধ্বংস।
খাওয়াইতে হবে কাঁচা কচ্ছপের মাংস।।
চেষ্টা করি কাঠা আন আর আন ঢালো।
তারে খাওয়াইব এবে যে এসে ধরিল।।
আনিয়া কচ্ছপ মাংস তাহাকে খাওয়ায়।
হাত পেতে এনে মাংস গ্রাসে গ্রাসে খায়।।
তবু হীরামন নাহি হয়েন সদ্ভাব।
ফকির বলেছে এযে বড় অসম্ভব।।
পুনঃ পৃষ্ঠমোড়া দিয়া দুবাহু বাঁধিল।
হস্তদ্বয় বাঁধি তার একত্র করিল।।
সূক্ষ্ম তন্তু দিয়া তার বাঁধিল যে কর।
দুই দুই আঙ্গুল করিয়া একতর।।
ওঝা বলে ছেড়ে যাবি কিনা যাবি বোঝ।
এত বলি আঙ্গুলির মধ্যে মারে গোঁজ।।
খর্জূর কন্তক তবে চারিটি আনিয়া।
নখতলে মাংস মধ্যে দিল বিঁধাইয়া।।
ভাল রজ্জু দিয়া দিল পিঠ মোড়া বাঁধা।
নাহি তাতে হা হা হুঁ হুঁ নাহি তাতে কাঁদা।।
কেহ যদি বলে কেন এত কষ্ট কর।
ওঝা বলে তোমরা তা বুঝিবারে নার।।
হা হা হুঁ হুঁ নাহি করে পাও নাহি দিশে।
যার দৃষ্টি তার কষ্ট ওর কষ্ট কিসে।।
হীরাতে কি হীরা আছে সে হীরা এ নয়।
তা হ’লে কি হারামের কাঁচা মাংস খায়।।
পুনর্বার বেকী অস্ত্র আগুনে পোড়ায়।
পোড়া ঘা উপরে যবে ধরিবারে যায়।।
এমন সময় উঠি হুঙ্কার করিয়া।
গাত্রমোড়া দিয়া দড়া ফেলিল ছিঁড়িয়া।।
হাত ঝাড়া দিলে কাঁটা খসিয়া পড়িল।
আঙ্গুল বন্ধন হাত মোড়ায়ে ছিঁড়িল।।
স্বাভাবিক ভাবে যে শরীর তার ছিল।
ভয়ঙ্কর দেহ তার দিগুণ বাড়িল।।
বেকী অস্ত্র কাড়িয়া লইল অতি কোপে।
আরক্তলোচন ক্রোধে ওষ্ঠাধর কাঁপে।।
দাঁড়াইল হীরামন অপরূপ দেহ।
যে দেখিল সে হইল জ্ঞান হারা মোহ।।
ভূমিকম্প প্রায় বাড়ী লড়িয়া উঠিল।
স্ত্রী পুরুষ নাহি হুশ ঢলিয়া পড়িল।।
ছিল সে চৈতন্য বালা পীড়ির উপরে।
তার দিকে ধেয়ে যায় বেকী অস্ত্র ধরে।।
কতদিনে শাস্তিভোগী মনে বড় কোপ।
ক্রোধভরে চৈতন্যরে মারে এক কোপ।।
সে কোপ লাগিল গিয়া চালের উপরে।
চাল কাটি খাম্বা কাটি লাগে তার শিরে।।
চেঁচায়ে চৈতন্য বলে রক্ষা করে কেবা।
রাখরে রাখরে ওরে কালাচাঁদ বাবা।।
কিয়দংশ কোপ লাগে চৈতন্যরে শিরে।
রক্ত বয় মোহ যায় বাক্য নাহি সরে।।
মোহপ্রাপ্ত ফকির সে চৈতন্য পাইল।
বাবারে চাচারে বলে চেঁচায়ে দৌড়িল।।
ফকিরের প্রতি পরে হইল ধাবমান।
ফেলিয়া মারিল সেই বেকী অস্ত্র খান।।
পাও কাটে ফকিরের বেকী অস্ত্র পশি।
দৌড়িয়া ফকির গেল চারি পাঁচ রসি।।
রুধিরের ধারা বহে পাও গেল কাটি।
অজ্ঞান হইয়া ভূমে করে ছটফটি।।
এল এল বলে ওঝা ওঠে আর পড়ে।
কৃষকেরা বলে শালা দূর পাতি নেড়ে।।
দলে দলে কৃষাণ রয়েছে মাঠ জুড়ে।
বসে বলে দূর দূর শালা পাতি নেড়ে।।
ফকির তাড়ায়ে পড়ে গৃহেতে প্রস্থান।
হীরামনে দেখে সবে ভয়ে কম্পমান।।
সবে চিত ভয়ে ভিত ভূতবৎ রয়।
সবে ভাবে যেন কবে প্রমাদ ঘটায়।।
সাধুজনে বলে এযে কৃষ্ণ প্রেমোন্মাদ।
এ জনার মন রহিয়াছে হরিচাঁদ।।
অক্রুর গুরুচরণ আর কোটিশ্বর।
তারা বলে এ মানুষ রুদ্র অবতার।।
মন মানুষেতে মন হ’য়েছে ইহার।
সামান্য মানুষ নহে উগ্র কলেবর।।
যে ভাবে ঘটেছে সেই ভাবেতে থাকুক।
কেহ কিছু না বলিও যা ইচ্ছা করুক।।
বিনয় চৈতন্য বলে শুন ওরে বাপ।
অপরাধী তোর ঠাই করিয়াছি পাপ।।
শুনি কথা হীরামন মৃদুভাষে বলে।
লাফিয়া প্রস্রাব কর কমলের দলে।।
হারে কটা ভেক বেটা কর কট্ কট্।
ষট্ পদে সুধাস্বাদে তুমি কর হট্।।
এইভাবে কিছুদিন নিজালয় থেকে।
চলিলেন হীরামন উত্তরাভিমুখে।।
হরি হরি হরি হরি হরি হরি বল।
হরি বলি রসনা শ্রীহরিধামে চল।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!