জলে স্থলে নাম সংকীর্তন
পয়ার
মতুয়ার গণ সব করিল গমন।
পদব্রজে চলে যায় বহুতর জন।।
পাঁচ হাত মুখে এক নৌকা সাজাইয়ে।
উত্তর দেশীয় সবে যায় তরী বেয়ে।।
কীর্তন করিছে সবে বাজাইয়ে খোল।
তার মধ্যে কেহ উঠে বলে হরিবোল।।
যে নায় উঠিলে লোক ধরে বিশ ত্রিশ জন।
সেই নৌকায় লোক উঠে বিয়াল্লিশ জন।।
বার চৌদ্দ জন লোক হইয়াছে বেশী।
নাম সংকীর্তন করে হ’য়ে মিশামিশি।।
দুই নৌকা জুড়ি বাহে কেহ মারে লম্ফ।
তাহাতে নদীর জল হইতেছে কম্প।।
গোস্বামী গোলোক নাচে আনন্দ হৃদয়।
কভু আগা নায় কভু যান পাছা নায়।।
গায় গায় মিশামিশি লোক সব ভীড়।
তার মধ্যে গোস্বামী উন্মত্ত নহে স্থির।।
সকল মতুয়া নাচে করি জড়াজড়ি।
তার মধ্যে গোস্বামী করেছে দৌড়াদৌড়ি।।
হাতে হাতে ধরাধরি হইয়া সবায়।
তার নীচ দিয়া প্রভু যান আগা নায়।।
যখনে সকলে বসি নামপদ গায়।
লম্ফ দিয়া গোস্বামী পড়েন পাছা নায়।।
নদীমধ্যে যত লোক নৌকা পরে ছিল।
আশ্চর্য মানিয়া সবে নিকটে আসিল।।
সব নৌকা গিয়া গোস্বামীর নৌকা ধরে।
সঙ্গে সঙ্গে তাহারাও হরিনাম করে।।
যত সব বাজে নৌকা হ’ল আগুয়ান।
সকলে বলে হরি হিন্দু মুসলমান।।
জলমগ্ন লোক যেন ভুলে খায় জল।
তেমনি সকলে বলে বল হরি বল।।
পদ ধরে গান করে ঈশ্বরাধিকারী।
উঠেছে তরঙ্গ নাচে মধুমতী নারী।।
অক্রুর বিশ্বাস আগা নৌকার চরাটে।
দাঁড়ায়ে কীর্তন করে হাতে ল’য়ে বৈঠে।।
হাতে বৈঠা লম্ফ দিয়া নেচে নেচে উঠে।
গোস্বামী লাফিয়া পড়ে তাহার নিকটে।।
পাগল শুইয়া পড়ি ডাকে হরিচাঁদে।
অক্রুর দাঁড়ায়ে তার দুই পদ মধ্যে।।
যেন দুই দাঁড় দুই পার্শ্বে নৌকা বায়।
হস্ত দিয়া সেই মত নৌকা টেনে যায়।।
চারি ছয় দাঁড়ে নৌকা যেই মত চলে।
সেই মত নৌকা চলে হস্ত টান বলে।।
গোস্বামীর নৌকা সঙ্গে যত নৌকা ধরা।
সব নৌকা সেইমত চলিল সুধারা।।
যত নৌকা ধরাধরি করিছে আসিয়ে।
বাহ্যজ্ঞান নাহি কারু প্রেমে মত্ত হ’য়ে।।
সময় সময় কারু বাহ্যস্মৃতি হয়।
চাহিলে পাগল পানে তাহা ভুলে যায়।।
হেনকালে জয়পুরবাসী চারিজন।
হৃদয় সীতানাথ ভোলানাথ রাইচরণ।।
ষোল হাত দৈর্ঘ্য নৌকা প্রস্থে নয় পোয়া।
হরিধ্বনি শুনি চারিজন দিল বাওয়া।।
বহু পরিশ্রমে নৌকা ধরিল আসিয়া।
ঠেকাইল নৌকা আগানা’র তল দিয়া।।
কেহ বলে সর বেটা মরিতে আসিলি।
নৌকার গলইর তলে নৌকা কেন দিলি।।
আসিলি নৌকার তলে ডুবিয়া মরিতে।
ভোলানাথ বলে আমরা এসেছি ডুবিতে।।
গোস্বামী বলেছে বাছা কে ডুবিতে চাও।
অক্রুর বিশ্বাস কহে জয়পুর নাও।।
লম্ফ দিয়া উঠিলেন গোঁসাই গোলোক।
জয়পুর নাও যদি এইত তারক।।
না হ’লে এমন বোল কে পারে বলিতে।
তারকের গণ নৈলে চাহে কে ডুবিতে।।
নৌকা মধ্যে নামে মত্ত ছিল যত লোক।
সকলের মুখে শব্দ তারক তারক।।
মধ্যে ফাঁক করে দিল সকল তরণী।
তার মধ্যে জয়পুরে নৌকা নিল টানি।।
তারকের নৌকা এই বলিয়া গোঁসাই।
লম্ফ দিয়া বলে তারকের নৌকা বাই।।
পড়িয়া নৌকার মাঝে ভাসিয়া চলিল।
অক্রুর বিশ্বাস এসে লাফিয়া পড়িল।।
রাইচাঁদ নিবারণ বদন গোঁসাই।
গোলোকের পুত্র গিরি মথুর দু’ভাই।।
গোলোক ঠাকুর গিরি মথুরের পিতে।
ঈশ্বরাধিকারী সবে বসি একত্রেতে।।
নাম করে প্রেমাবেশে বড় নৌকা থেকে।
সিংহনাদ প্রায় ধ্বনি উঠে ঝোঁকে ঝোঁকে।।
বলিতে বলিতে হরি নৃত্য গীত রসে।
বর্ণির খালের মধ্যে সব নৌকা পশে।।
যাহারা বিদেশী নৌকা সঙ্গে এসেছিল।
ছাড়িয়া কতক নৌকা বড় নদী গেল।।
নিজ নিজ স্থানে যায় কাঁদিয়ে কাঁদিয়ে।
কেহ কেহ সঙ্গে রৈল প্রেমে মত্ত হ’য়ে।।
লোক ভিড় জয়পুরে নৌকার উপরে।
গায় গায় লোক ফাঁক নাহি ডালি জুড়ে।।
ঊর্ধ্ব সংখ্যা ধরে নায় বিশ ত্রিশ জন।
নৌকার উপরে লোক ঊনত্রিশ জন।।
তার মধ্যে গোস্বামী উল্লম্ফন করিছে।
নৌকা হ’তে কেহ কেহ কিনারে পড়েছে।।
নায় নায় যোড়াযোড়ি ক্ষণে লাগে তটে।
কিনারার লোক গিয়া নৌকাপরে উঠে।।
গোস্বামী গোলোক গিয়া পড়েন কিনারে।
ফিরে লম্ফ দিয়া পড়ে নৌকার উপরে।।
নৌকায় যত মানুষ ছিলেন বসিয়া।
মাথার উপর দিয়া পড়েছে লাফিয়া।।
কূল হ’তে পড়ে এসে বড় নৌকা মাঝ।
দুইবার দেখা গেল পাছে আছে ল্যাজ।।
আঙ্গুল পাছায় লম্বা আট নয় হাত।
শরীর প্রমাণ লম্বা তের চৌদ্দ হাত।।
গোলোক কীর্তনিয়া ঈশ্বরাধিকারী।
ভক্তি ভয় আনন্দে সকলে বলে হরি।।
তালুকের মহেশচন্দ্র শ্রীহরি পোদ্দার।
আড়ঙ্গ বৈরাগী মহানন্দ কোটিশ্বর।।
এমত অনেক ভক্ত দেখে চমৎকার।
ধুমকেতু তারা তুল্য লেজের আকার।।
এমত আশ্চর্য কার্য দেখে সব নরে।
জয় হরি গৌর হরি বলে উচ্চৈঃস্বরে।।
পড়িল গোস্বামী গিয়া কূলের উপর।
রাখালেরা হরি বলে শুনিতে সুন্দর।।
মিশিল গোঁসাই সব রাখালের সঙ্গে।
জয় জয় হরিধ্বনি দিতেছেন রঙ্গে।।
পাগলের লীলাখেলা বড় চমৎকার।
বিরচিল কবি চূড়ামণি সরকার।।