ভবঘুরেকথা
স্বামী বিবেকানন্দ

-স্বামী বিবেকানন্দ

দ্বৈতবাদী বলে, সর্বদা দণ্ডহস্তে শাসন করিতে উদ্যত একজন ঈশ্বরকে না ভাবিলে তুমি নীতিমান্ হইতে পার না। ব্যাপারটা কি রকম? ধর একটি ঘোড়া আমাদের নীতি সম্বন্ধে বক্তৃতা দিবে। আর ঘোড়াটি ছ্যাকরা গাড়ীর হতভাগ্য ঘোড়া, সে চাবুক ভিন্ন এক পাও অগ্রসর হয় না-এইটি তাহার স্বভাবে পরিণত হইয়াছে। এই ঘোড়ার বক্তৃতার বিষয় হইল ‘মানুষ’, তাহার মতে মানুষমাত্রই নীতিহীন। কেন? কারণ মানুষকে নিয়মিতভাবে চাবুক মারা হয় না। কিন্তু চাবুকের ভয় মানুষকে আরও নীতিহীন করিয়া তোলে।

তোমরা সকলে বলো যে, ঈশ্বর বলিয়া একটি সত্তা আছেন এবং তিনি সর্বব্যাপী। চক্ষু বন্ধ কর এবং চিন্তা করিতে থাক-ঈশ্বর কিরূপ। তুমি কি দেখিবে? যখনই তোমার মনে ঈশ্বরের সর্বব্যাপিত্বের ভাবটি আনিবার চেষ্টা করিবে, তখনই দেখিবে সাগর, নীল আকাশ, বিস্তৃত বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তর কিংবা এরূপ কোন বস্তু-যাহা তুমি পূর্বে দেখিয়াছ-তাহারই চিন্তা মনে উঠিতেছে। যদি তাই হয়, সর্বব্যাপী ভগবান্ সম্বন্ধে তোমার কোনই ধারণা নাই। ‘সর্বব্যাপিত্ব’ তোমার কাছে একটা অর্থহীন শব্দ।

ঈশ্বরের অন্যান্য বিশেষণের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। ঈশ্বরের সর্বশক্তিমত্তা বা সর্বজ্ঞত্ব সম্বন্ধেও আমাদের কী ধারণা আছে? কিছুই নাই। উপলব্ধিই ধর্ম; যতক্ষণ না তুমি ঈশ্বর-ভাবটি নিজের জীবনে উপলব্ধি করিতেছ, ততক্ষণ আমি তোমাকে যথার্থ ঈশ্বরোপাসক বলিব না। উপলব্ধির আগে ইহা শুধু কথার কথা ছাড়া আর কিছুই নয়। মস্তিষ্কে যতই মত, দর্শন, ও নীতি-পুস্তকের রাশি সঞ্চিত রাখ না কেন, তাহাতে কিছুই যায় আসে না। তুমি কী উপলব্ধি করিয়াছ, জীবনে ঐগুলি কতটা পরিণত করিয়াছ, তাহাই বিচার্য।

মায়ার আবরণের ভিতর দিয়া দেখিলে নির্গুণ ব্রহ্মকেই সগুণ ঈশ্বররূপে দেখা যায়। ব্রহ্মকে যখন পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা দর্শন করি, তখন তাঁহাকে একমাত্র সগুণ ভগবান্‌রূপেই দেখিতে পারি। আসল কথা পরমাত্মাকে কখনও বিষয়ীভূত করা যাইতে পারে না। জ্ঞাতা নিজেকে কি করিয়া জানিবেন? তবে তিনি যেন নিজের ছায়াকে প্রক্ষেপ করিতে পারেন এবং যদি বলিতে চাও-ইহাকে ‘বিষয়ীভূত করা’ বলিতে পার। সুতরাং সেই ছায়ার যে সর্বোচ্চ রূপ, নিজেকে বিষয়ীভূত করিবার যে প্রচেষ্টা, তাহাই সগুণ ঈশ্বর।

আত্মা হইতেছেন শাশ্বত কর্তা; সেই আত্মাকে জ্ঞেয়রূপে রূপান্তরিত করিবার জন্য আমরা নিরন্তর চেষ্টা করিতেছি; এবং আমাদের এই প্রচেষ্টা হইতে দৃশ্যজগতের ও যাহাকে আমরা ‘জড়’ বলি তাহার ও অন্যান্য সবকিছুর উদ্ভব হইয়াছে। কিন্তু এইগুলি অত্যন্ত দুর্বল প্রচেষ্টা এবং আমাদের কাছে আত্মার জ্ঞেয়রূপে যে সর্বোচ্চ প্রকাশ সম্ভব, তাহা সগুণ ঈশ্বর। এই জ্ঞেয়ই আমাদের স্বরূপ-উদ্ঘাটন-প্রচেষ্টার ফল।

সাংখ্যমতে প্রকৃতি এই-সব অভিজ্ঞতা পুরুষ বা জীবাত্মাকে দিতেছে; জীব তাহার প্রকৃত স্বরূপ জানিতে পারিবে। অদ্বৈত বেদান্তমতে জীব নিজেকে জানিবার জন্য চেষ্টা করিতেছে। দীর্ঘ সংগ্রামের পর সে দেখে-জ্ঞাতা সর্বদা জ্ঞাতাই থাকেন; এবং তখনই অনাসক্তি আসে এবং জীব মুক্ত হয়।

যখন কোন সাধক সেই পূর্ণ অবস্থায় উপনীত হন, তখন তিনি সগুণ ঈশ্বরের সারূপ্য লাভ করেনঃ ‘আমি এবং আমার পিতা এক’। তিনি জানেন, তিনি পরব্রহ্মের সহিত; সগুণ ঈশ্বরের ন্যায় তিনি নিজেকে প্রক্ষেপ করেন। তিনি খেলা করেন, যেমন অতি পরাক্রান্ত রাজাও মাঝে মাঝে পুতুল লইয়া খেলা করেন।

স্থিতির বন্ধনকে ভাঙিয়া ফেলিবার জন্য কতকগুলি কল্পনা বাকী কল্পনাগুলির বন্ধন ছিন্ন করিতে সাহায্য করে। সমস্ত জগৎটাই একটা কল্পনা। এক শ্রেণীর কল্পনা আর এক শ্রেণীর কল্পনার উপশম ঘটায়। এই জগতে পাপ, দুঃখ ও মৃত্যু আছে-এই জাতীয় কল্পনাগুলি মারাত্মক। কিন্ত আর এক জাতীয় কল্পনা আছেঃ তুমি পবিত্র, ভগবান্ আছেন, দুঃখ নাই। এগুলিই ভাল এবং কল্যাণকর, বন্ধন-মোচনের সহায়ক। সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বরই সর্বোচ্চ কল্পনা, যাহা শৃঙ্খলের সব গ্রন্থি ভাঙিয়া ফেলিতে পারে।

তাহা হইলে তাহার সহিত পশুর কি প্রভেদ? ভক্তি উচ্চতর বস্তু, স্বর্গৈষণা অপেক্ষাও উচ্চতর। স্বর্গ বলিতে খুব বেশী মাত্রায় ভোগ করিবার স্থান বুঝায়। তাহা কি করিয়া ভগবান্ হইতে পারে?

‘ভগবান্, তুমি ইহা রক্ষা কর এবং উহা আমাকে দাও; ভগবান্, আমি এই ক্ষুদ্র প্রার্থনা নিবেদন করিতেছি, পরিবর্তে তুমি আমার দৈনন্দিন জীবনের অভাব পূরণ করিয়া দাও; হে ভগবান্, আমার মাথা-ধরা সারাইয়া দাও ইত্যাদি’-এইরূপ প্রার্থনা ভক্তি নয়। এগুলি ধর্মের নিম্নতম সোপান, কর্মের নিম্নতম রূপ। যদি কোন মানুষ দেহকে তৃপ্ত করিতে––দেহের ক্ষুধা মিটাইতেই সমস্ত মানসিক শক্তি নিয়োগ করে, তাহা হইলে তাহার সহিত পশুর কি প্রভেদ? ভক্তি উচ্চতর বস্তু, স্বর্গৈষণা অপেক্ষাও উচ্চতর। স্বর্গ বলিতে খুব বেশী মাত্রায় ভোগ করিবার স্থান বুঝায়। তাহা কি করিয়া ভগবান্ হইতে পারে?

একমাত্র মূঢ় ব্যক্তিরাই ইন্দ্রিয়-ভোগের পশ্চাতে ধাবিত হয়। ইন্দ্রিয়-কেন্দ্রিক জীবন যাপন করা সহজ। পান-ভোজন-ক্রিয়ারূপ পুরাতন অভ্যস্ত পথে ভ্রমণ করা কঠিন নয়। কিন্তু আধুনিক দার্শনিকগণ বলিতে চান, ‘এই অনায়াস-সাধ্য ভাবগুলি গ্রহণ কর এবং সেগুলির উপরই ধর্মের ছাপ দিয়া দাও।’ এই ধরনের মতবাদ বিপজ্জনক। ইন্দ্রিয়-ভোগে মৃত্যু। আধ্যাত্মিক স্তরে যে জীবন, তাহাই যথার্থ জীবন।

অন্য ভোগভূমির জীবন মৃত্যুরই নামান্তর। আমাদের এই জাগতিক জীবনকে একটি শব্দে বর্ণনা করা যাইতে পারে, উহা ‘অভ্যাসের ব্যায়ামাগার’। যথার্থ জীবন উপভোগ করিতে হইলে আমাদিগকে ইহার ঊর্ধ্বে উঠিতে হইবে।

যতক্ষণ ছোঁয়াছুঁয়ি তোমার ধর্ম, এবং রান্নার হাঁড়ি তোমার ইষ্ট, ততক্ষণ তুমি আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করিতে পারিবে না। ধর্মে ধর্মে যে দ্বন্দ্ব-তাহা অর্থহীন, কেবল কথার সংঘর্ষ মাত্র। প্রত্যেকেই ভাবে, ‘ইহা আমার মৌলিক চিন্তা’; এবং সে চায়-সবকিছুই তাহার মতানুসারে চলুক। এই ভাবেই ধর্মবিরোধের সূত্রপাত।

অপরকে সমালোচনা করিবার সময় আমরা সর্বদা নির্বোধের মত নিজের চরিত্রের একটি মাত্র বিশেষ উজ্জ্বল দিক্‌কেই সমগ্র জীবন বলিয়া ধরিয়া লই এবং উহার সহিত অপরের চরিত্রের অনুজ্জ্বল দিক্‌টি তুলনা করি। ব্যক্তিগত চরিত্র বিচার করিবার সময় আমরা এ-ভাবে ভুল করিয়া বসি।

গোঁড়ামি ও সাম্প্রদায়িকতার দ্বারা একটি ধর্মের অতি দ্রুত প্রচার হয়, সন্দেহ নাই; কিন্তু সেই ধর্মেরই প্রচার দৃঢ়ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়, যে-ধর্ম প্রত্যেককে তাহার মতের স্বাধীনতা দেয় এবং এইরূপে তাহাকে উচ্চতর সোপানে উন্নীত করে, যদিও এই প্রক্রিয়ার গতি মন্থর।

সর্বপ্রথম দেশকে (ভারতবর্ষকে) আধ্যাত্মিক ভাবে প্লাবিত কর, তারপর অন্যান্য ভাবগুলি আসিবে। ধর্ম ও অধ্যাত্মজ্ঞান-দান শ্রেষ্ঠ দান, কারণ ইহা অসংখ্য জন্মপ্রাপ্তি-রূপ বন্ধন মোচন করে। ইহার পর পার্থিব জ্ঞান-দান, ইহার সাহায্যে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের দিকে মানুষের চক্ষু খুলিয়া যায়। তৃতীয় দান জীবন-দান এবং চতুর্থ অন্ন-দান।

সাধন করিতে করিতে যদি শরীরের পতন হয়, তবে তাহাই হউক। তাহাতে কি আসে যায়? নিরন্তর সৎসঙ্গের দ্বারা কাল পূর্ণ হইলে ঈশ্বরানুভূতি হইবে। একটা সময় আসে, যখন মানুষ বুঝিতে পারে যে, মানবসেবার জন্য এক ছিলিম তামাক সাজা লক্ষ লক্ষ ধ্যান জপ অপেক্ষা বড় কাজ। যে এক ছিলিম তামাক ঠিকভাবে সাজিতে পারে, সে ধ্যানও ঠিকমত করিতে পারে।

দেবতারা উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত পরলোকগত জীবাত্মা ছাড়া আর কিছুই নন। তাঁহাদের নিকট হইতে আমরা সাহায্য পাইতে পারি।

তিনিই আচার্য, যাঁহার ভিতর দিযা ঐশী শক্তি ক্রিয়া করে। যে-শরীরের মাধ্যমে আচার্যত্ব লাভ হয়, তাহা অপর সাধারণ লোকের শরীর হইতে ভিন্ন। সে-শরীরকে ঠিকভাবে রাখিবার জন্য একটি বিশেষ যোগ বা বিজ্ঞান আছে। আচার্যের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অত্যন্ত কোমল ও মন অতি সংবেদনশীল, ফলে তিনি সুখ ও দুঃখ তীব্রভাবে অনুভব করিতে সমর্থ হন। বস্তুতঃ তিনি অ-সাধারণ।

জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, হৃদয়বান্‌ মানুষই জয়লাভ করে এবং ব্যক্তিত্বই সকল সাফল্যের গোপন রহস্য।

নদীয়ার অবতার ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যে মহাভাবের যেমন বিকাশ হইয়াছিল, তেমনটি আর কোথাও হয় নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ একটি শক্তি। কখনও মনে করিও না যে, এটি বা ওটি তাঁহার মত ছিল। কিন্তু তিনি একটি শক্তি, সেই শক্তি এখনও তাঁহার শিষ্যদের ভিতর মূর্ত হইয়া আছে এবং জগতে কার্য করিতেছে। ভাবের দিক্‌ দিয়া তিনি এখনও বাড়িয়া চলিয়াছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ একই দেহে জীবন্মুক্ত ও আচার্য ছিলেন।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!