ভবঘুরেকথা
স্বামী বিবেকানন্দ

-স্বামী বিবেকানন্দ

[আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিস্কো অঞ্চলে ১০ এপ্রিল ১৯০০ খ্রীঃ প্রদত্ত]

(প্রেমকে একটি ত্রিকোণের প্রতীক দ্বারা প্রকাশ করা যাইতে পারে। প্রথম কোণটি এই যে,) প্রেম কোন প্রশ্ন করে না। ইহা ভিক্ষুক নয়। … ভিখারীর ভালবাসা ভালবাসাই নয়। প্রেমের প্রথম লক্ষণ হইতেছে ইহা কিছুই চায় না, (বরং ইহা) সবই বিলাইয়া দেয়। ইহাই হইল প্রকৃত আধ্যাত্মিক উপাসনা, ভালবাসার মাধ্যমে উপাসনা! ঈশ্বর করুণাময় কিনা, এই প্রশ্ন আর উঠে না।

তিনি ঈশ্বর, তিনি আমার প্রেমাস্পদ। ঈশ্বর সর্বশক্তিমান্ এবং অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন কিনা, তিনি সান্ত কিংবা অনন্ত, এ-সব আর জিজ্ঞাস্য নয়। যদি তিনি মঙ্গল বিতরণ করেন ভালই, যদি অমঙ্গল করেন, তাহাতেই বা কি আসে যায়? কেবল ঐ একটি-অনন্ত প্রেম ছাড়া তাঁহার অন্যান্য সবগুণই তিরোহিত হয়।

ভারতবর্ষে একজন প্রাচীন সম্রাট্ ছিলেন। তিনি একবার শিকারে বাহির হইয়া বনের মধ্যে জনৈক বড় যোগীর সাক্ষাৎ পান। সাধুর উপর তিনি এতই সন্তুষ্ট হইলেন যে, তাঁহাকে রাজধানীতে আসিয়া কিছু উপহার লইবার জন্য অনুরোধ করিলেন। (প্রথমে) সাধু রাজী হন নাই, (কিন্তু) বারংবার সম্রাটের পীড়াপীড়িতে অবশেষে যাইতে স্বীকার করিলেন। তিনি (প্রাসাদে) উপস্থিত হইলে সম্রাট্‌কে জানানো হইল।

সম্রাট্ বলিলেন, ‘এক মিনিট অপেক্ষা করুন, আমি আমার প্রার্থনা শেষ করিয়া লই।’ সম্রাট্‌ প্রার্থনা করিতেছিলেন, ‘প্রভু, আমাকে আরও ধন দাও- আরও (জমি-জায়গা, স্বাস্থ্য), আরও সন্তান-সন্ততি।’ সাধু উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং ঘরের বাহিরে যাইবার জন্য অগ্রসর হইতে লাগিলেন। রাজা বলিলেন, ‘কই, আপনি আমার উপহার তো গ্রহণ করিলেন না?’ যোগী উত্তর দিলেন, ‘আমি ভিক্ষুকের নিকট ভিক্ষা করি না।

এতক্ষণ পর্যন্ত আপনি নিজেই অধিক ভূসম্পত্তি, টাকাকড়ি, আরও কত কি প্রার্থনা করিতেছিলেন, আপনি আর আমাকে কি দিবেন? আগে নিজের অভাবগুলি মিটাইয়া নিন।’

প্রেম কখনও যাচ্ঞা করে না, ইহা সব সময় দিয়াই যায়। … যখন একটি যুবক তাহার প্রিয়তমাকে দেখিতে যায়, … তাহাদের মধ্যে বেচাকেনার সম্বন্ধ থাকে না; তাহাদের সম্বন্ধ হইতেছে প্রেমের, আর প্রেম ভিক্ষুক নয়। (এইরূপে) আমরা বুঝিতে পারি যে, প্রকৃত আধ্যাত্মিক উপাসনার অর্থ ভিক্ষা নয়। যখন আমরা সমস্ত চাওয়া-‘প্রভু, আমাকে এটা দাও, ওটা দাও’-শেষ করিয়াছি তখনই ধর্মজীবন আরম্ভ হইবে।

দ্বিতীয়টি (ত্রিকোণ-স্বরূপ প্রেমের দ্বিতীয় কোণ) এই,-প্রেমে ভয় নাই। তুমি আমাকে কাটিয়া টুকরা টুকরা করিতে পার, তবু আমি তোমাকে ভালবাসিতেই (থাকিব)। মনে কর, তোমাদের মধ্যে একজন মা-শরীর খুব দুর্বল-দেখিলে, রাস্তায় একটি বাঘ তোমার শিশুটিকে ছিনাইয়া লইতেছে। ব

ল তো, তুমি তখন কোথায় থাকিবে? জানি, তুমি ঐ ব্যাঘ্রটির সম্মুখীন হইবে। অন্য সময়ে পথে একটি কুকুর পড়িলেই তোমাকে পলাইতে হয়, কিন্তু এখন তুমি বাঘের মুখে ঝাঁপ দিয়া তোমার শিশুটিকে কাড়িয়া লইবে। ভালবাসা ভয় মানে না। ইহা সমস্ত মন্দকে জয় করে। ঈশ্বরকে ভয় করা ধর্মের সূত্রপাত মাত্র, উহার পর্যবসান হইল প্রেমে। সমস্ত ভয় যেন তখন মরিয়া গিয়াছে।

তৃতীয়টি (ত্রিকোণাত্মক প্রেমের তৃতীয় কোণ) এই-প্রেম নিজেই নিজের লক্ষ্য। ইহা কখনই অপর কোন কিছুর ‘উপায়’ হইতে পারে না। যে বলে, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি এই-সব পাইবার জন্য’, সে ভালবাসে না। প্রেম কখনই কোন উদ্দেশ্য-সাধনের উপায় নয়; ইহা নিশ্চিতভাবে পূর্ণতম সিদ্ধি।

প্রেমের সীমা এবং আদর্শ কি? ঈশ্বরে পরম অনুরাগ-ইহাই সব। কেন মানুষ ঈশ্বরকে ভালবাসিবে? এই ‘কেন’র, কোন উত্তর নাই, কেন-না ভালবাসা তো কোন অভীষ্টসিদ্ধির জন্য নয়। ভালবাসা আসিলে উহাই মুক্তি, উহাই পূর্ণতা, উহাই স্বর্গ। আর কি চাই? অন্য আর কি প্রাপ্তব্য থাকিতে পারে? প্রেম অপেক্ষা মহত্তর আর কি তুমি পাইতে পার?

আমরা সকলে প্রেম অর্থে যাহা বুঝি, আমি তার কথা বলিতেছি না। একটুখানি ভাবপ্রবণ ভালবাসা দেখিতে বেশ সুন্দর। পুরুষ নারীকে ভালবাসিল, আর নারী পুরুষের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। কিন্তু দেখাও তো যায় যে, পাঁচ মিনিটের মধ্যে জন (John) জেনকে (Jane) পদাঘাত করিল এবং জেনও জনকে লাথি মারিতে ছাড়িল না। ইহা বৈষয়িক ভাব, ভালবাসাই নয়। যদি জন বাস্তবিকই জেনকে ভালবাসিত, তবে সেই মুহূর্তেই সে পূর্ণ হইয়া যাইত। (তাহার প্রকৃত) স্বরূপই প্রেম; সে স্বয়ংপূর্ণ।

জন কেবলমাত্র জেনকে ভালবাসিয়া যোগের সমুদয় শক্তি পাইতে পারে, (যদিও) সে হয়তো ধর্মের, মনস্তত্ত্বের বা ঈশ্বর-সম্বন্ধীয় মতবাদসমূ্হের একটি অক্ষরও জানে না। আমি বিশ্বাস করি, যদি কোন পুরুষ ও নারী পরস্পরকে যথার্থ ভালবাসিতে পারে, তাহা হইলে যোগিগণ যে-সকল বিভুতি লাভ করিয়াছেন বলিয়া দাবী করেন, এই দম্পতিও সেই-সকল শক্তি (অর্জন করিতে সমর্থ হইবে,) যেহেতু প্রেম যে স্বয়ং ঈশ্বর। সেই প্রেমস্বরূপ ভগবান্‌ সর্বত্র বিরাজমান এবং (সেইজন্য) তোমাদেরও মধ্যে এই ভালবাসা রহিয়াছে, তোমরা জান বা না জান।

একদিন সন্ধ্যার সময় আমি একটি যুবককে একটি তরুণীর জন্য অপেক্ষা করিতে দেখিয়াছিলাম। … মনে করিলাম, যুবককে পরীক্ষা করিবার ইহা একটি উপযুক্ত অবসর। সে তাহার প্রেমের গভীরতার মধ্য দিয়া অতীন্দ্রিয় দর্শন ও দূর-শ্রবণের ক্ষমতা লাভ করে। ষাট কি সত্তর বার যুবকটি একবারও ভুল করে নাই, এবং তরুণী ছিল দুইশত মাইল দূরে। (সে বলিত) ‘এইভাবে তরুণী সাজগোজ করিয়াছে।’ (কিংবা) ‘ঐ সে চলিয়া যাইতেছে।’ আমি ইহা নিজের চোখে দেখিয়াছি।

তাহা হইলে জনের নিকট হইতে কিছু আশা কর। (যদি তাহার জন্যই তাহাকে ভালবাস), তবে জনের কাছ হইতে তুমি কিছুরই প্রত্যাশা রাখ না। সে তাহার ইচ্ছানুযায়ী যাহা খুশী করিতে পারে, (এবং) তুমি তাহাকে একইভাবে ভালবাসিবে।

ইহাই হইতেছে প্রশ্নঃ তোমার স্বামী কি ঈশ্বর নন? তোমার সন্তান কি ঈশ্বর নয়? তুমি যদি তোমার পত্নীকে ঠিক ঠিক ভালবাসিতে পার, জগতের সকল ধর্মের ভাবই তোমাতে ফুটিয়া উঠিবে। তোমার মধ্যেই তুমি লাভ করিবে ধর্মের ও যোগের সমস্ত রহস্য। কিন্তু ভালবাসিতে পার কি? প্রশ্ন তো ইহাই। তুমি বল, ‘মেরী, আমি তোমায় ভালবাসি … অহো, আমি তোমার জন্য মরিতে পারি।’ (কিন্তু যদি তুমি) দেখ, মেরী অপর এক ব্যক্তিকে চুম্বন করিতেছে, তুমি তাহার গলা কাটিতে চাহিবে।

আবার মেরী যদি জনকে অন্য একটি মেয়ের সহিত কথা বলিতে দেখে, তবে সে রাত্রে ঘুমাইতে পারিবে না এবং জনের জীবন নরকের ন্যায় দুর্বিষহ করিয়া তুলিবে। ইহার নাম ‘ভালবাসা’ নয়। ইহা যৌন ক্রয়-বিক্রয়। ইহাকে ‘প্রেম’ বলা অতীব নিন্দনীয়। সংসারের মানুষ দিবা-রাত্র ঈশ্বর ও ধর্মের কথা বলিয়া থাকে-তেমনি প্রেমের কথাও। প্রত্যেক বিষয়কে একটি ভণ্ডামিতে পরিণত করা-ইহাই তো তোমরা করিতেছ! সকলেই প্রেমের কথা বলে, (তবু) সংবাদপত্রের স্তম্ভে (আমরা পড়ি), প্রত্যেক দিন বিবাহ-বিচ্ছেদের কাহিনী।

যখন তুমি জনকে ভালবাস, তখন কি তাহার জন্যই তাহাকে ভালবাস, অথবা তোমার জন্য? (যদি তুমি তোমার নিজের জন্য তাহাকে ভালবাস), তাহা হইলে জনের নিকট হইতে কিছু আশা কর। (যদি তাহার জন্যই তাহাকে ভালবাস), তবে জনের কাছ হইতে তুমি কিছুরই প্রত্যাশা রাখ না। সে তাহার ইচ্ছানুযায়ী যাহা খুশী করিতে পারে, (এবং) তুমি তাহাকে একইভাবে ভালবাসিবে।

এই তিনটি বিন্দু, তিনটি কোণ লইয়া (প্রেম)-ত্রিভুজ। প্রেম ব্যতীত দর্শনশাস্ত্র শুষ্ক হাড়ের মত, মনস্তত্ত্ব একপ্রকার মতবাদ-বিশেষ এবং কর্ম শুধুই পণ্ডশ্রম। (প্রেম থাকিলে) দর্শন হইয়া যায় কবিতা, মনোবিজ্ঞান হয় (মরমী অনুভূতি) আর কর্ম সৃষ্টির মাঝে মধুরতম বলিয়া পরিগণিত হয়। (কেবলমাত্র) গ্রন্থ-অধ্যয়নে (লোকে) শুষ্ক হইয়া যায়। কে বিদ্বান্‌?-যে অন্ততঃ একবিন্দু প্রেমও অনুভব করিতে পারে। ঈশ্বরই প্রেম এবং প্রেমই ঈশ্বর।

আর ঈশ্বর তো সব স্থানেই রহিয়াছেন। ভগবান্‌ প্রেমস্বরূপ এবং সর্বত্র বিরাজমান-এইটি যে অনুভব করে, সে বুঝিতে পারে না যে, সে মাথায় ভর করিয়া বা পায়ের উপর ভর দিয়া দাঁড়াইয়া আছে-যেমন যে-লোক এক বোতল মদ খাইয়াছে, সে জানে না যে-সে কোথায় রহিয়াছে। …যদি আমরা দশ মিনিট ভগবানের জন্য কাঁদি, পরবর্তী দুই মাস আমরা কোথায় আছি-সে জ্ঞান আমাদের থাকিবে না।

… আহারের সময়ও আমরা মনে রাখিতে পারিব না, কি খাইতেছি-তাহাও জানিব না। ঈশ্বরকেও ভালবাসিবে, আবার সর্বদা বেশ ব্যবসা-বুদ্ধি থাকিবে-ইহা (কি করিয়া) সম্ভবপর? … প্রেমের সেই সর্বজয়ী সর্বব্যাপী শক্তি কিরূপে আসিতে পারে? …

মানুষ বিচারশীল নয়। তাহারা সকলেই পাগল। শিশুরা (পাগল) খেলায়, তরুণ তরুণীকে লইয়া, বৃদ্ধেরা তাহাদের অতীতের চর্বিত-চর্বণে।৭ কেহ বা পাগল অর্থের পিছনে। কেহ কেহ তবে ঈশ্বরের কন্য পাগল হইবে না কেন? জন (John) জেনের (Jane) জন্য যেরূপ পাগল হইয়া ছুটিতেছে, ঈশ্বরের প্রেমের জন্য সেইরূপ উন্মাদ হও।

কোথায়, এমন লোক কোথায়? (অনেকে) বলে, ‘আমি কি এইটি ছাড়িব? অমুকটা ত্যাগ করিব? একজন জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, ‘বিবাহ কি করিব না?’ না, কোন বিষয়ই ছাড়িতে যাইও না। বিষয়ই তোমাকে ছাড়িয়া যাইবে। অপেক্ষা কর, তুমি সব কিছুই ভুলিবে।

(সম্পূর্ণরূপে) ভগবৎপ্রেমে পরিণত হওয়া-এখানেই প্রকৃত উপাসনা। রোম্যান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ে সময় সময় ইহার কিছু আভাস পাওয়া যায়; সেই-সব অত্যাশ্চর্য সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীগণ অলৌকিক ভগবৎপ্রেমে কিরূপ আত্মহারা হইয়া বেড়াইতেছেন! এইরূপ প্রেমই লাভ করিতে হইবে। ঐশ্বরিক প্রেম এই প্রকার হওয়াই উচিত-কিছুই না চাহিয়া, কিছুই অন্বেষণ না করিয়া।

প্রশ্ন হইয়াছিল-কিভাবে উপাসনা করিতে হইবে? তোমর সমস্ত বিষয়-সম্পদ, তোমার সকল পরিজন, সন্তান-সন্ততি-সবকিছু অপেক্ষা প্রিয়তর ভাবিয়া ঈশ্বরকে উপাসনা কর। (তাঁহাকে উপাসনা কর) যেন তুমি স্বয়ং ভালবাসাকেই ভালবাসিতেছ। এমন একজন আছেন, যাঁহার নাম ‘অনন্ত প্রেম’-ইহাই ঈশ্বরের একমাত্র সংজ্ঞা। যদি এই … বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ধ্বংস হইয়া যায়, কিছুমাত্র ভাবিও না। যতক্ষণ অনন্তপ্রেমস্বরূপ তিনি রহিয়াছেন, ততক্ষণ আমাদের ভাবনা কিসের? উপাসনার অর্থ কি, (তোমরা) দেখিলে তো? অন্য সব চিন্তা অবশ্যই চলিয়া যায়।

ঈশ্বর ছাড়া সমস্তই তিরোহিত হয়। সন্তানের প্রতি পিতা বা মাতার যে ভালবাসা, স্বামীর উপর স্ত্রীর যে প্রেম, পত্নীর প্রতি স্বামীর যে ভালবাসা, বন্ধুর প্রতি বন্ধুর যে আকর্ষণ-এই-সব প্রেম একত্র ঘনীভূত করিয়া ঈশ্বরকে দিতে হইবে। যদি কোন নারী কোন পুরুষকে ভালবাসে, তবে সে অন্য-পুরুষকে ভালবাসিতে পারে না। যদি কোন পুরুষ কোন নারীকে ভালবাসে, তাহা হইলে তাহার পক্ষে অন্য কোন (নারীকে) ভালবাসা সম্ভব নয়। ইহাই হইল ভালবাসার ধর্ম।

আমার গুরুদেব বলিতেন, ‘মনে কর এই ঘরের মধ্যে এক থলে মোহর রহিয়াছে, আর পাশের ঘরে একটি চোর আছে-সে ঐ মোহরের থলের কথা জানে। চোরটি কি ঘুমাইতে পারিবে? নিশ্চয়ই নয়। সব সময়েই সে পাগল হইয়া ভাবিতে থাকিবে, কি উপায়ে মোহরগুলি আত্মসাৎ করা যায়।’

… (এইরূপে) কোন লোক যদি ভগবানকে ভালবাসে, তবে সে কি করিয়া অন্য কিছুকে ভালবাসিবে? ঈশ্বরের বিপুল প্রেমের সম্মুখে অন্য কিছু দাঁড়াইবে কিরূপে? উহার কাছে সবকিছুই অন্তর্হিত হইয়া যাইবে। সেই প্রেমকে লাভ করিবার জন্য-বাস্তব করিয়া তুলিবার জন্য, উহা অনুভব করিয়া উহাতেই অবস্থান করিবার জন্য পাগল হইয়া ছুটাছুটি না করিয়া মন থামিতে পারে কি?

আমরা এইভাবে ঈশ্বরকে ভালবাসিবঃ ‘আমি ধন চাই না, (বন্ধুবান্ধব বা সৌন্দর্য চাই না) বিষয়-সম্পত্তি, বিদ্যা, এমন কি মুক্তিও চাই না। যদি ইহাই তোমার ইচ্ছা হয়, আমাকে সহস্র মৃত্যুর কবলে পাঠাইয়া দাও। আমার শুধু এই প্রার্থনা যে, আমি যেন তোমাকে ভালবাসিতে পারি, আর যেন কেবল ভালবাসার জন্যই ভালবাসি। বিষয়াসক্ত ব্যক্তিদিগের বিষয়ের প্রতি যে টান, সেরূপ তীব্র ভালবাসা যেন আমার হৃদয়ে আসে, কিন্তু কেবল সেই চিরসুন্দরের জন্য।

ঈশ্বরকে বন্দনা! প্রেমময় ঈশ্বরকে বন্দনা!’ ঈশ্বর ইহা ছাড়া অন্য কিছু নন। অনেক যোগী যে-সব অদ্ভুত ক্ষমতা দেখাইতে পারেন, তিনি সেগুলি গ্রাহ্য করেন না। ক্ষুদ্র জাদুকরেরা ক্ষুদ্র কৌশল প্রদর্শন করিয়া থাকেন। ঈশ্বর শ্রেষ্ঠ জাদুকর; তিনি সমুদয় জাদুবিদ্যা দেখাইতে পারেন। কে জানে কত ব্রহ্মাণ্ড (আছে,) কে ভ্রূক্ষেপ করে? …

আর একটি উপায় আছে। সবকিছু জয় করিতে, সমস্ত কিছু দমন করিতে-শরীর (এবং) মন উভয়ের উপর আধিপত্য বিস্তার করিতে হইবে। … কিন্তু (ভক্ত বলেন) ‘সবকিছু জয় করিবার সার্থকতা কি? আমার কাজ ঈশ্বরকে লইয়া।’

একজন যোগী ছিলেন, খুব ভক্ত! গলক্ষত-রোগে তিনি যখন মুমূর্ষু তখন অপর একজন যোগী-দার্শনিক-তাঁহাকে দেখিতে আসিলেন। (শেষোক্ত) যোগী বলিলেন, ‘দেখুন, আপনি আপনার ক্ষতের উপর মন একাগ্র করিয়া উহা সারাইয়া ফেলুন না কেন?’ তৃতীয় বার যখন এইরূপ বলা হইল, তখন (সেই পরমযোগী) উত্তর দিলেন, ‘তুমি কি ইহা সম্ভব মনে কর, যে-মন সম্পূর্ণরূপে আমি ভগবানকে নিবেদন করিয়াছি, (তাহা এই হাড়মাসের খাঁচায় টানিয়া আনিব)?’

যীশুখ্রীষ্ট তাঁহার সাহায্যের জন্য দেবসেনাদলকে আহ্বান করিতে সম্মত হন নাই। ‘এই ক্ষুদ্র শরীর কি এতই মূল্যবান্ যে ইহাকে দুই বা তিন দিন বেশী বাঁচাইয়া রাখিবার জন্য আমি বিশ হাজার দেবদূতকে ডাকিয়া আনিব?’

(জাগতিক দিক্ হইতে) এই শরীরই আমার সর্বস্ব। ইহাই আমার জগৎ, আমার ভগবান্‌। আমি শরীর। দেহে চিমটি কাটিলে আমি মনে করি, আমাকেই কাটিলে। যদি মাথা ধরিল তো মুহূর্তে আমি ভগবানকে ভুলিয়া যাই। আমি দেহের সহিত এমনই জড়িত! ঈশ্বর এবং সব কিছুকেই নামাইয়া আনিতে হইবে, আমার সর্বোচ্চ লক্ষ্য-এই দেহের জন্য। এই দৃষ্টিকোণ হইতে যীশুখ্রীষ্ট যখন ক্রুশবিদ্ধ অবস্থায় মরণ বরণ করিলেন এবং (তাঁহার সাহায্যের জন্য) দেবদূতগণকে ডাকিলেন না, তখন তিনি মূর্খের কাজই করিয়াছিলেন;

তাঁহাদিগকে নামাইয়া আনিয়া ক্রুশ হইতে মুক্তিলাভ করা তাঁহার অবশ্য কর্তব্য ছিল। কিন্তু যিনি প্রেমিক, তাঁহার নিকট এই দেহ কিছুই নয়; তাঁহার দিক্‌ হইতে দেখিলে-কে এই অকিঞ্চিৎকর জিনিষের জন্য মাথা ঘামাইবে? এই শরীর থাকে কি যায়-বৃথা চিন্তায় কি লাভ? রোম্যান সৈন্যগণের ভাগ্য-নির্ণয়ের জন্য ব্যবহৃত বস্ত্রখণ্ডের চেয়ে এর দাম বেশী নয়।

(জাগতিক দৃষ্টি) ও প্রেমিকের দৃষ্টিতে আকাশ-পাতাল তফাত। ভালবাসিয়া যাও। যদি কেহ ক্রুদ্ধ হয়, তোমাকেও যে ক্রুদ্ধ হইতে হইবে, এমন কোন কারণ নাই। যদি কেহ নিজেকে হীন করিয়া ফেলে, তোমাকেও যে সেই হীন স্তরে নামিতে হইবে, তার কি মানে? … ‘অন্য লোক বোকামি করিয়াছে বলিয়া আমিও রাগ করিব? অশুভকে প্রতিরোধ করিও না।’ ঈশ্বরপ্রেমিকগণ এইরূপই বলিয়া থাকেন। জগৎ যাহাই করুক, যে ভাবেই ইহা চলুক, (তাঁহাদের উপর) ইহা কোন প্রভাব বিস্তার করিতে পারে না।

তাহা হইতেও যদি অব্যাহতি পাও তো ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দাও। ভালবাসিতে আরম্ভ কর। ক্ষমতার মোহ নিশ্চয়ই কাটান চাই। আমার ও ভগবানের মধ্যে প্রেম ছাড়া আর কিছুই যেন খাড়া না হয়। ভগবান্‌ প্রেমস্বরূপ, আর কিছুই নন; আদিতে প্রেম, মধ্যে প্রেম-অন্তেও প্রেম।

জনৈক যোগী অলৌকিক শক্তি অর্জন করিয়াছিলেন। তিনি বলিতেন, ‘দেখ, আমার কী শক্তি! আকাশের দিকে তাকাও; আমি ইহাকে মেঘ দিয়া ঢাকিয়া দিব।’ বৃষ্টি আরম্ভ হইল। (কেহ) বলিল, ‘প্রভু, অদ্ভুত আপনার শক্তি! কিন্তু আমাকে তাহাই শিক্ষা দিন, যাহা পাইলে আমি আর কোন কিছু চাহিব না।’ … শক্তিরও ঊর্ধ্বে যাওয়া-কিছুই চাই না, শক্তিলাভেরও বাসনা নাই! (ইহার তাৎপর্য) শুধু বুদ্ধির দ্বারা জানা যায় না।

… হাজার হাজার বই পড়িয়াও তুমি জানিতে সমর্থ হইবে না … যখন আমরা ইহা বুঝিতে আরম্ভ করি, সমুদয় জগৎ-রহস্য যেন আমাদের সম্মুখে খুলিয়া যায়। … একটি ছোট মেয়ে তাহার পুতুল লইয়া খেলিতেছে-সব সময় সে নূতন নূতন স্বামী পাইতেছে, কিন্তু যখন তাহার সত্যকারের স্বামী আসে, তখন (চিরদিনের জন্য) সে তাহার পুতুল-স্বামীগুলি দূরে ফেলিয়া দেয়। … জগতের সবকিছু সম্বন্ধে ঐ একই কথা। (যখন)

প্রেমসূর্য উদিত হয়, তখন এই-সব খেলার শক্তি-সূর্য-এই সমস্ত (কামনা-বাসনা) অন্তর্হিত হয়। শক্তি লইয়া আমরা কি করিব? যেটুকু শক্তি তোমার আছে, তাহা হইতেও যদি অব্যাহতি পাও তো ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দাও। ভালবাসিতে আরম্ভ কর। ক্ষমতার মোহ নিশ্চয়ই কাটান চাই। আমার ও ভগবানের মধ্যে প্রেম ছাড়া আর কিছুই যেন খাড়া না হয়। ভগবান্‌ প্রেমস্বরূপ, আর কিছুই নন; আদিতে প্রেম, মধ্যে প্রেম-অন্তেও প্রেম।

এক রানীর সম্বন্ধে একটি গল্প আছে। তিনি রাস্তায় রাস্তায় (ভগবৎপ্রেমের বিষয়) প্রচার করিতেন। ইহাতে তাঁহার স্বামী ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহাকে দেশের সর্বত্র অত্যন্ত নির্যাতন করিয়া তাড়া করিতেন। রানী তাঁহার ভগবৎপ্রেম বর্ণনা করিয়া গান গাহিতেন। তাঁহার গানগুলি সর্বত্র গীত হয়। ‘চোখের জলে আমি (প্রেমের অক্ষয়লতা পুষ্ট করিয়াছি)’।৮ ইহাই চরম, মহান্‌ (লক্ষ্য)। ইহা ব্যতীত আর কি আছে? (লোকে) ইহা চায়, উহা চায়। তাহারা সবাই পাইতে ও সঞ্চয় করিতে চায়। এই জন্যই এত কম লোক (প্রেম) বুঝিতে পারে, এত কম লোক ইহা লাভ করিতে পারে। তাহাদিগকে জাগাও এবং বল। তাহা হইলে তাহারা এ-বিষয়ে আরও কিছু সঙ্কেত পাইবে।

প্রেম স্বয়ং শাশ্বত, অন্তহীন ত্যাগ-স্বরূপ। তোমাকে সবকিছু ছাড়িতে হইবে। কিছুই তোমার অধিকারে রাখা চলিবে না। প্রেম লাভ করিলে তোমার আর কিছুরই প্রয়োজন হইবে না। … ‘চিরকালের জন্য কেবল তুমিই আমার ভালবাসার ধন থাকিও।’ প্রেম ইহাই চায়। ‘আমার প্রেমাস্পদের অধরোষ্ঠের একটি মাত্র চুম্বন! আহা, যে তোমার চুম্বনের সৌভাগ্য লাভ করিয়াছে, তাহার সমস্ত দুঃখ যে চলিয়া গিয়াছে। একটি মাত্র চুম্বনে মানুষ এত সুখী হয় যে, অন্য বস্তুর উপর ভালবাসা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হইয়া যায়। সে শুধু তোমারই স্তুতিতে মগ্ন থাকে, আর একমাত্র তোমাকেই দেখে।’৯ মানবীয় ভালবাসাতেও (দিব্য প্রেমের সত্তা লুকান থাকে)। গভীর প্রেমের প্রথমক্ষণে সমস্ত জগৎ যেন এক সুরে তোমার হৃদয়-বীণার সঙ্গে ঝঙ্কৃত হইয়া উঠে। বিশ্বের প্রত্যেকটি পাখি যেন তোমারই প্রেমের গান গাহিয়া থাকে, প্রতিটি ফুল যেন তোমার জন্যই ফুটিয়া থাকে। চিরন্তন অসীম প্রেম হইতেই (মানবীয়) ভালবাসা উদ্ভূত।

ঈশ্বরপ্রেমিক কোন কিছুকে ভয় করিবেন কেন? দস্যু-তস্করের, দুঃখ-দুর্বিপাকের-এমন কি নিজের জীবনের ভয়ও তাঁহার নাই। … প্রেমিক অনন্ত নরকে যাইতেও প্রস্তুত, কিন্তু উহা কি নরক থাকিবে? স্বর্গ, নরক-এই-সব ধারণা ত্যাগ করিয়া আমাদিগকে উচ্চতর প্রেম আস্বাদন করিতে হইবে। … শত শত লোক প্রেমের অনুসন্ধানে তৎপর, কিন্তু উহা আসিলে ভগবান্‌ ছাড়া আর সবই অদৃশ্য হইয়া যায়।

অবশেষে প্রেম, প্রেমাস্পদ এবং প্রেমিক এক হইয়া যায়। ইহাই লক্ষ্য। … আত্মা ও মানুষের মধ্যে এবং আত্মা ও ঈশ্বরের মধ্যে পার্থক্য রহিয়াছে কেন? … কেবল এই প্রেম উপভোগ করিবার জন্য। ঈশ্বর নিজেকে ভালবাসিতে চাহিলেন, সেই জন্য তিনি নিজেকে নানা ভাগে বিভক্ত করিলেন। … প্রেমিক বলেন, ‘সৃষ্টির সমগ্র তাৎপর্য ইহাই’। আমরা সকলেই এক। ‘আমি ও আমার পিতা এক।’ এইক্ষণে ঈশ্বরকে ভালবাসিবার জন্য আমি পৃথক্‌ হইয়াছি। … কোন্‌টি ভাল-চিনি হওয়া, না চিনি খাওয়া? চিনি হওয়া-তাহাতে আর কী আনন্দ? চিনি খাওয়া-ইহাই হইল প্রেমের অনন্ত উপভোগ।

ভালমন্দ, ছোটবড় সবই তুমি। আমিও তোমার এই জগতের অংশ এবং তুমিও আমার প্রিয়। আমার শরীর, মন, আত্মা তোমারই পূজাবেদীতলে। হে প্রিয়, আমার এই উপহারগুলি প্রত্যাখ্যান করিও না।’

প্রেমের সমগ্র আদর্শ-(ঈশ্বরকে) আমাদের পিতা, মাতা, সখা, সন্তানভাবে (ভাবিবার প্রণালী-ভক্তিকে দৃঢ় করিবার এবং গভীরতরভাবে তাঁহার সান্নিধ্য লাভ করিবার জন্য)। স্ত্রী-পুরষের মধ্যেই ভালবাসার তীব্র অভিব্যক্তি। ঈশ্বরকে এইভাবেও ভালবাসিতে হইবে। নারী তাহার পিতাকে ভালবাসে,-মাতা, সন্তান এবং বন্ধুকেও ভালবাসে; কিন্তু পিতা, মাতা, সন্তান বা বন্ধুর কাছে সে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করিতে পারে না। কেবল একজনের কাছে তাহার গোপনীয় কিছুই থাকে না। এইরূপ পুরুষের পক্ষেও।

… পতি-পত্নীর সম্পর্ক সর্বাঙ্গীণ। এই সম্পর্কে অন্য সব ভালবাসা একীভূত হইয়াছে। পত্নী স্বামীর মধ্যে পিতা মাতা, সন্তান সবই পায়। স্বামীও পত্নীর মধ্যে মাতা, কন্যা প্রভৃতি সবকিছু লাভ করে। স্ত্রী-পুরুষের এই সর্বগ্রাসী পরিপূর্ণ প্রেম ঈশ্বরের দিকে পরিচালিত করিতে হইবে-যে-প্রেম নারী সম্পূর্ণ নির্ভয়ে লজ্জা না করিয়া, রক্তের সম্বন্ধ না মানিয়া তাহার প্রিয়তমকে নিবেদন করে। কোন অন্ধকার নাই।

তাহার নিজের নিকট হইতে যেমন গোপন করিবার কিছু নাই, সেইরূপ তাহার প্রেমাস্পদের নিকটেও গোপনীয় বলিতে কিছুই থাকে না। এইরূপ প্রেম (ঈশ্বরের উপর) আসা চাই। এই বিষয়গুলি ধারণা করা অত্যন্ত কঠিন। তোমরা ধীরে ধীরে এই-সব বুঝিতে পারিবে, তখন সমস্ত যৌন ভাবও দূরে চলিয়া যাইবে। ‘তাতল সৈকতে বারিবিন্দুসম’ এই জীবন ও ইহার সকল সম্পর্কগুলি।

তিনি স্রষ্টা ইত্যাদি-এই-সমস্ত ধারণা তো বালকদিগের উপযুক্ত। তিনি আমার প্রিয়, আমার জীবন-ইহাই আমার অন্তরের ধ্বনি হউক। …

‘আমার একমাত্র আশা আছে। লোকে তোমাকে বলে জগতের প্রভু।১০ ভালমন্দ, ছোটবড় সবই তুমি। আমিও তোমার এই জগতের অংশ এবং তুমিও আমার প্রিয়। আমার শরীর, মন, আত্মা তোমারই পূজাবেদীতলে। হে প্রিয়, আমার এই উপহারগুলি প্রত্যাখ্যান করিও না।’

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!