-স্বামী বিবেকানন্দ
হিন্দুধর্মের তিনটি মূল তত্ত্বঃ ঈশ্বর, আপ্তবাক্যস্বরূপ বেদ, কর্ম ও পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাস। যদি কেহ ঠিক ঠিক মর্ম গ্রহণপূর্বক বেদ অধ্যয়ন করে, তবে উহার মধ্যে সে সমন্বয়ের ধর্ম দেখিতে পাইবে।
অন্যান্য ধর্মের সহিত হিন্দুধর্মের পার্থক্য এই যে, হিন্দুধর্মে আমরা সত্য হইতে সত্যে উপনীত হই-নিম্নতর সত্য হইতে ঊর্ধ্বতর সত্যে, কখনও মিথ্যা হইতে সত্যে নয়।
ক্রমবিকাশের দৃষ্টিতে বেদ অনুশীলন করা উচিত। একত্বের উপলব্ধিরূপ ধর্মের পূর্ণতা প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত ধর্ম-চেতনার অগ্রগতির সমগ্র ইতিহাস উহার মধ্যে নিহিত রহিয়াছে।
বেদ অনাদি ও নিত্য। ইহার অর্থ এরূপ নয়-যেমন কেহ কেহ ভ্রমবশতঃ মনে করেন যে, উহার বাক্য (শব্দ)-সমূহই অনাদি, শাশ্বত; কিন্তু উহার আধ্যাত্মিক নিয়মসমূহই অনাদি। এই অপরিবর্তনীয় শাশ্বত নিয়মগুলি বিভিন্ন সময়ে মহাপুরুষ বা ঋষিগণ কর্তৃক আবিষ্কৃত হইয়াছে। ঐগুলির মধ্যে কতকগুলি বিস্মৃত ও কতকগুলি রক্ষিত হইয়াছে।
যখন বহু লোক বিভিন্ন কোণ ও দূরত্ব হইতে সমুদ্রের প্রতি দৃষ্টিপাত করে, তখন নিজ নিজ দৃষ্টি অনুযায়ী সমুদ্রের এক একটি অংশ প্রত্যেকের দৃষ্টিগোচর হয়। প্রত্যেকে বলিয়া থাকে, সে যাহা দেখিয়াছে, তাহাই প্রকৃত সমুদ্র; তাহাদের সকলের কথাই সত্য, কারণ তাহারা সকলেই সেই এক বিশাল বিস্তৃত সমুদ্রের বিভিন্ন অংশ দেখিয়া থাকে। সেইরূপ যদিও বিভিন্ন শাস্ত্রে উক্তিসকল পৃথক্ ও পরস্পর-বিরোধী বলিয়া মনে হয়, সেগুলি সবই সত্য প্রকাশ করিয়া থাকে, কারণ ঐ-সকল উক্তি এক অনন্ত সত্তার বিভিন্ন বর্ণনা।
যখন কেহ সর্বপ্রথম মরীচিকা দেখে, তখন উহা তাহার নিকট সত্য বলিয়াই প্রতীত হয়, পরে তৃষ্ণা-নিবারণের বৃথা চেষ্টা করিয়া সে হৃদয়ঙ্গম করে যে, উহা মরীচিকা। কিন্তু ভবিষ্যতে যখনই ঐ দৃশ্য তাহার নয়নগোচর হয়, তখন উহা সত্য বলিয়া প্রতীয়মান হওয়া সত্ত্বেও সে যে মরীচিকা দেখিতেছে, এ-ধারণা তাহার মনে সর্বক্ষণ বিরাজ করে। জীবন্মুক্তের নিকট মায়ার জগৎ এইরূপ।
যেমন কতকগুলি ক্ষমতা কোন বিশেষ পরিবারের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে বর্তমান থাকে, তেমনি বৈদিক রহস্যের কতকগুলি কোন কোন পরিবারের মধ্যেই কেবল জানা ছিল। এই পরিবারগুলির বিলোপ-সাধনের সহিত ঐ-সকল রহস্যও অন্তর্হিত হইয়াছে।
বৈদিক শব-ব্যবচ্ছেদ-বিদ্যা আয়ুর্বেদীয় বিদ্যা অপেক্ষা কম পূর্ণাঙ্গ ছিল না। শরীরের বহু অংশের বিভিন্ন নাম ছিল, যেহেতু যজ্ঞের জন্য তাহাদের পশু ব্যবচ্ছেদ করিতে হইত। সমুদ্র অর্ণবপোতে পূর্ণ বলিয়া বর্ণিত হয়। সমুদ্রযাত্রার ফলে সাধারণ লোক বৌদ্ধ হইয়া যাইবে, কতকটা এই আশঙ্কাহেতু পরবর্তী কালে সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ হয়।
বৌদ্ধধর্ম বৈদিক পৌরোহিত্য-ব্যবসায়ের বিরুদ্ধে নব-গঠিত ক্ষত্রিয়-সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ। বৌদ্ধধর্ম হইতে উহার সার গ্রহণ করিয়া লইয়া হিন্দুধর্ম বৌদ্ধমতকে পরিত্যাগ করিয়াছিল। দাক্ষিণাত্যের সকল আচার্যের প্রচেষ্টা ছিল, হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম উভয়ের মধ্যে মিলন স্থাপন। শঙ্করাচার্যের উপদেশের মধ্যে বৌদ্ধ প্রভাব দেখা যায়। তাঁহার শিষ্যগণ তাঁহার উপদেশ এতদূর বিকৃত করিয়াছিলেন যে, পরবর্তী কালের কোন কোন সংস্কারক আচার্যের অনুগামিগণকে ‘প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন-ইহা ঠিকই হইয়াছে।
স্পেন্সারের ‘অজ্ঞেয়’ কি বস্তু? উহা আমাদের মায়া। পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ অজ্ঞেয়ের প্রসঙ্গে ভয় পান, কিন্তু আমাদের দার্শনিকগণ অজানার উদ্দেশ্যে একটি বিপুল অভিযান আরম্ভ করিয়াছিলেন এবং উহাতে তাঁহারা জয়ী হইয়াছিলেন।
পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ শকুনির ন্যায় ঊর্ধ্বে বিচরণ করিয়া থাকেন, কিন্তু তাঁহাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে নিম্নে গলিত শবের প্রতি। অজানাকে তাঁহারা অতিক্রম করিতে পারেন না, অতএব পৃষ্ঠপ্রদর্শনপূর্বক সর্বশক্তিমান্ ডলারকেই পূজা করিয়া থাকেন।
জগতে উন্নতির দুইটি ধারা আছে-রাজনৈতিক ও ধর্মভিত্তিক। প্রথমটিতে গ্রীকরাই সব-আধুনিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি গ্রীসের প্রতিষ্ঠানগুলির সম্প্রসারণ মাত্র; শেষেরটিতে অর্থাৎ ধর্মের উন্নতির ব্যাপারে হিন্দুদেরই একচেটিয়া অধিকার।
অনন্ত প্রেমময় ঈশ্বর এবং মহৎ ও অনন্ত প্রেমের পাত্রকে নীলবর্ণরূপে চিত্রিত করা হয়। কৃষ্ণের রঙ নীল, সলোমনের৫প্রেমের ঈশ্বরের রঙও নীল। ইহা একটি প্রাকৃতিক নিয়ম যে, যাহা কিছু গভীর ও অসীম, তাহাই নীল রঙের সহিত যুক্ত। এক অঞ্জলি জল গ্রহণ কর, উহার কোন রঙ নাই। কিন্তু গভীর বিশাল সমুদ্রের দিকে তাকাও, দেখিবে উহা নীল।
আমার ধর্ম এরূপ একটি ধর্ম-খ্রীষ্টধর্ম যাহার একটি শাখা ও বৌদ্ধধর্ম যাহার বিদ্রোহী সন্তান।
যখন একটি মৌলিক পদার্থ পাওয়া যায়-যাহা হইতে অপর পদার্থগুলির উপাদান সিদ্ধ হয়, তখনই রসায়নবিদ্যা উন্নতির চরম সীমায় উপনীত হয়। অন্যান্য শক্তিসমূহ যে-শক্তির বিভিন্ন অভিব্যক্তি, সেই মূল শক্তিপ্রাপ্ত হইলে পদার্থবিদ্যার উন্নতির অবসান ঘটে। সেইরূপ আধ্যাত্মিক একত্বের সন্ধান পাইলে ধর্মের ক্ষেত্রে উন্নতি করিবার আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। হিন্দুধর্মে তাহাই ঘটিয়াছে।
বেদে নাই-এরূপ কোন ধর্ম-সম্বন্ধীয় নূতন ধারণা কোথাও প্রচারিত হয় নাই।
প্রত্যেক বিষয়ে দুই জাতীয় বিকাশ বর্তমান-বিশ্লেষণমূলক (analytical) ও সমন্বয়মূলক (synthetical)। প্রথমটিতে হিন্দুগণ অন্যান্য জাতিকে ছাড়াইয়া গিয়াছেন। শেষেরটিতে তাঁহাদের স্থান শূন্য।৪
হিন্দুগণ বিশ্লেষণ ও সূক্ষ্ম বিষয় অনুধাবন করিবার ক্ষমতা অনুশীলন করিয়াছেন। এ পর্যন্ত কোন জাতি পাণিনির ন্যায় ব্যাকরণ উদ্ভাবন করিতে সমর্থ হন নাই।
রামানুজের বিশিষ্ট কাজ হইতেছে জৈন ও বৌদ্ধদের হিন্দুধর্মে লইয়া আসা। রামানুজ মূর্তিপূজার একজন শ্রেষ্ঠ সমর্থক। তিনি প্রেম ও বিশ্বাসকে মুক্তিলাভের প্রকৃষ্ট উপায় বলিয়া নির্দেশ দিয়া গিয়াছেন।
এমন কি ভাগবতে জৈনদের চব্বিশ তীর্থঙ্করের অনুরূপ চব্বিশ অবতারের উল্লেখ আছে। ঋষভদেবের নাম উভয়ের মধ্যে বর্তমান।
যোগাভ্যাস করিলে সূক্ষ্ম বস্তু ধারণা করিবার ক্ষমতা হয়। সিদ্ধপুরুষ বিষয় হইতে গুণসমূহকে পৃথক্ করিয়া এবং বস্তুসত্তা প্রদানপূর্বক তাহাদের স্বতন্ত্রভাবে চিন্তা করিতে সমর্থ। অন্যান্য ব্যক্তিগণ হইতে এখানেই সিদ্ধপুরুষের শ্রেষ্ঠতা।
দুইটি বিপরীত বস্তু চরম অবস্থায় গিয়া সর্বদা মিলিত হয় এবং একরূপ দেখায়। শ্রেষ্ঠ আত্মবিস্মৃত ভক্ত, যাঁহার মন অনন্ত পরব্রহ্মের ধ্যানে মগ্ন এবং অত্যন্ত হীন মদ্যপায়ী উন্মাদ-এই দুইজনকে বাহ্যতঃ একরূপ দেখায়। সময় সময় উহাদের সাদৃশ্যহেতু একটিকে অপরটিতে পরিবর্তিত হইতে দেখিয়া আমরা আশ্চর্য হইয়া যাই।
অত্যন্ত দুর্বল-স্নায়ুবিশিষ্ট ব্যক্তিগণ ধার্মিক হিসাবে কৃতকার্য হয়। তাহাদের মাথায় কিছু ঢুকিলে ঐ-বিষয়ে তাহারা অত্যধিক উৎসাহী হইয়া উঠে।
জনৈক ঈশ্বর-ভক্তকে উন্মাদ বলিয়া অভিযোগ করিলে তিনি উত্তর দিয়াছিলেন, ‘এ-জগতে সকলেই উন্মাদ-কেহ কাঞ্চনের জন্য, কেহ কামিনীর জন্য এবং কেহ ঈশ্বরের জন্য। ডুবিয়া মরাই যদি মানুষের অদৃষ্ট হয়, তাহা হইলে পঙ্কিল জলাশয়ে ডুবিয়া মরা অপেক্ষা দুগ্ধ-সাগরে ডুবিয়া মরাই শ্রেয়ঃ।’
অনন্ত প্রেমময় ঈশ্বর এবং মহৎ ও অনন্ত প্রেমের পাত্রকে নীলবর্ণরূপে চিত্রিত করা হয়। কৃষ্ণের রঙ নীল, সলোমনের৫প্রেমের ঈশ্বরের রঙও নীল। ইহা একটি প্রাকৃতিক নিয়ম যে, যাহা কিছু গভীর ও অসীম, তাহাই নীল রঙের সহিত যুক্ত। এক অঞ্জলি জল গ্রহণ কর, উহার কোন রঙ নাই। কিন্তু গভীর বিশাল সমুদ্রের দিকে তাকাও, দেখিবে উহা নীল। তোমার সন্নিহিত যে শূন্যস্থান, উহার কোন বর্ণ নাই, কিন্তু সীমাহীন আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত কর, দেখিবে উহা নীল।
আদর্শবাদী হিন্দুদের মধ্যে যে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গীর অভাব ছিল, ইহাই তাহার প্রমাণ। চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের কথাই ধর। হিন্দুর চিত্রকলায় কি দেখিতে পাও? সর্বপ্রকার কিম্ভূতকিমাকার ও অস্বাভাবিক মূর্তি। হিন্দু মন্দিরে কি নজরে পড়ে? ‘চতুর্ভঙ্গ’ নারায়ণ বা ঐ-জাতীয় কোন মূর্তি।
আপনি কি সেজন্য দুঃখিত হইবেন?’ স্বামী উত্তর দিলেন ‘নিশ্চয় নয়।’ তখন পত্নী তাঁহাকে গৃহের মধ্যে লইয়া গিয়া বস্ত্রখণ্ড সরাইয়া মৃতদেহ তিনটি তাঁহাকে দেখাইলেন। স্বামী শান্তভাবে উহা সহ্য করিয়া শবদেহগুলি যথোচিত সৎকার করিলেন। বিশ্বের যাবতীয় ঘটনার নিয়ন্তা করুণাময় ঈশ্বরের অস্তিত্বে যাঁহাদের বিশ্বাস দৃঢ়, তাঁহারা ঐরূপ মনোবলের অধিকারী হন।
কিন্তু কোন ইতালীয় পট অথবা গ্রীসদেশীয় মূর্তি সম্বন্ধে ভাবিয়া দেখ, ইহাদের মধ্যে প্রকৃতি-পর্যবেক্ষণের কি অপূর্ব প্রকাশ! প্রদীপ হস্তে একটি নারীর চিত্র-অঙ্কনের জন্য হয়তো একজন বিশ বৎসর ধরিয়া নিজ হাতে প্রদীপ জ্বালিয়া বসিয়াছিল।
হিন্দুগণ আত্মসমীক্ষাপ্রসূত বিজ্ঞানসমূহে উন্নতি করিয়াছিলেন। বিভিন্ন-প্রকৃতি মানুষের জন্য বেদে বিভিন্ন ধর্মাচরণের বিধান দেওয়া হইয়াছে। বয়স্ককে যাহা শিক্ষা দেওয়া যায়, তাহা শিশুকে শিক্ষা দেওয়া চলে না।
গুরু হইবেন মানুষের চিকিৎসক। তিনি শিষ্যের প্রকৃতি অবগত হইয়া তাহার পক্ষে যাহা সর্বাপেক্ষা উপযোগী, সেই প্রণালী শিক্ষা দেবেন।
যোগাভ্যাসের অসংখ্য পথ আছে। কোন কোন প্রণালী কোন কোন ব্যক্তির পক্ষে উৎকৃষ্ট ফল প্রদান করিয়াছে। কিন্তু ঐগুলির মধ্যে সাধারণভাবে সকলের পক্ষে দুইটির গুরুত্ব অধিক-(১) ইন্দ্রিয় ও মনের যাবতীয় প্রত্যয়কে লয় করিয়া চরম সত্যে পৌঁছান, (২) আমিই সব, তুমিই সমগ্র বিশ্ব, এইরূপ চিন্তা করা।
দ্বিতীয় পদ্ধতির সাধককে প্রথমটি অপেক্ষা দ্রুততর লক্ষ্যে পৌঁছাইয়া দিলেও উহা সর্বাপেক্ষা নিরাপদ নয়। সাধারণতঃ ঐ প্রণালী-অবলম্বনে মহা বিপদের আশঙ্কা আছে এবং ইহা সাধককে বিপথে পরিচালিত করিয়া উদ্দেশ্য-লাভে বিঘ্ন জন্মায়।
খ্রীষ্টধর্মে ও হিন্দুধর্মে উপদিষ্ট প্রেমের মধ্যে পার্থক্য এই যে, খ্রীষ্টধর্ম প্রতিবেশীকে ভালবাসিতে শিক্ষা দেয়, কারণ আমরা ইচ্ছা করি যে, প্রতিবেশীরাও আমাদিগকে ভালবাসুক। হিন্দুধর্মে প্রতিবেশীদিগকে আত্মবৎ ভালবাসিতে-বস্তুতঃ তাহাদের মধ্যে আমাদের স্বরূপ উপলব্ধি করিতে বলে।
সচরাচর একটি বেজিকে লম্বা শিকলে বাঁধিয়া কাঁচের আলমারিতে রাখা হয়, যাহাতে সে স্বাধীনভাবে বিচরণ করিতে পারে। আলমারির বাহিরে ঘুরিয়া বেড়াইলেও কোন বিপদের আভাস পাইলেই সে একলাফে কাঁচের আলমারিতে ঢুকিয়া পড়ে। যোগী এই পৃথিবীতে এভাবেই বিচরণ করেন।
সমগ্র বিশ্ব এক অবিচ্ছিন্ন সত্তা; ইহার একপ্রান্তে জড় জগৎ ও অপর প্রান্তে ঈশ্বর-কতকটা এইরূপ ভাব দ্বারা বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের নীতি ব্যাখ্যা করা যাইতে পারে।
বেদের বহু উক্তি সগুণ ঈশ্বরের অস্তিত্ব-জ্ঞাপক। দীর্ঘকাল উপাসনার ফলে ঋষিগণ ঈশ্বর দর্শন করিয়াছেন এবং অজ্ঞাত রাজ্যের রহস্য উদ্ঘাটন করিয়া জগৎকে ইহা যাচাই করিতে আহ্বান করিয়াছেন। দাম্ভিক লোকেরাই ঋষি-নির্দেশিত পথ অনুসরণ না করিয়া এবং তাঁহাদের উপদেশ পালন না করিয়া সমালোচনা ও বিরুদ্ধাচরণ করে। এখনও পর্যন্ত এমন কেহ সাহসপূর্বক বলিতে পারে নাই যে, ঋষিদের নির্দেশ যথাযথ পালন করিয়াও তাহার কোন প্রকার অনুভূতি হয় নাই এবং ঋষিগণ মিথ্যাবাদী।
এরূপ বহু লোক আছে, যাহারা বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ পরীক্ষার মধ্য দিয়া গিয়া উপলব্ধি করিয়াছে যে, ঈশ্বর তাহাদিগকে ত্যাগ করেন নাই। জগৎ এরূপ যে, ঈশ্বরে বিশ্বাস যদি আমাদিগকে কোন সান্ত্বনা না দেয়, তবে আত্মহত্যাই শ্রেয়ঃ।
একজন ধার্মিক প্রচারক প্রচারকার্যে বাহিরে গিয়াছিলেন। অকস্মাৎ কলেরায় আক্রান্ত হইয়া তাঁহার তিনটি পুত্র মারা যায়। ঐ ব্যক্তির পত্নী প্রিয় পুত্র তিনটির মৃতদেহ একখণ্ড বস্ত্রে আবৃত করিয়া গৃহের ফটকে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। স্বামী প্রত্যাবর্তন করিলে তিনি তাঁহাকে ঐ স্থানে অপেক্ষা করিতে বলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘স্বামিন্, আপনার নিকট কেহ কোন দ্রব্য গচ্ছিত রাখিয়াছিলেন এবং আপনার অনুপস্থিতিকালে আসিয়া হঠাৎ উহা ফেরৎ লইয়া গিয়াছেন।
আপনি কি সেজন্য দুঃখিত হইবেন?’ স্বামী উত্তর দিলেন ‘নিশ্চয় নয়।’ তখন পত্নী তাঁহাকে গৃহের মধ্যে লইয়া গিয়া বস্ত্রখণ্ড সরাইয়া মৃতদেহ তিনটি তাঁহাকে দেখাইলেন। স্বামী শান্তভাবে উহা সহ্য করিয়া শবদেহগুলি যথোচিত সৎকার করিলেন। বিশ্বের যাবতীয় ঘটনার নিয়ন্তা করুণাময় ঈশ্বরের অস্তিত্বে যাঁহাদের বিশ্বাস দৃঢ়, তাঁহারা ঐরূপ মনোবলের অধিকারী হন।
নীতি একটি আপেক্ষিক শব্দ। জগতে বিশুদ্ধ নীতি বলিয়া কোন পদার্থ আছে কি? ঐ ধারণা কুসংস্কার মাত্র। প্রত্যেক যুগের প্রত্যেক ব্যক্তিকে একই আদর্শের দ্বারা বিচার করিবার অধিকার আমাদের নাই। প্রত্যেক দেশে প্রত্যেক যুগের প্রতিটি ব্যক্তি বিশেষ অবস্থার অধীন। অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাবের পরিবর্তনও অপরিহার্য। এক সময়ে গোমাংস-ভক্ষণ নীতিসঙ্গত বলিয়া বিবেচিত হইত।
অখণ্ডকে কখনও চিন্তা করা যায় না। সীমাবচ্ছিন্ন না হইলে আমরা কোন বস্তুর ধারণা করিতে পারি না। অনন্ত ঈশ্বরকে সান্তরূপেই ধারণা ও পূজা করা সম্ভব।
জন ব্যাপটিস্ট ছিলেন একজন ‘এসীন’ (Essene)। উহা এক বৌদ্ধসম্প্রদায়বিশেষ। দুইটি শিবলিঙ্গকে আড়াআড়িভাবে স্থাপন করিলেই উহা খ্রীষ্টধর্মের ক্রুশে পরিণত হয়। প্রাচীন রোমের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এখনও বৌদ্ধপূজার্চনার চিহ্ন দৃষ্ট হয়।
দক্ষিণ ভারতে কতকগুলি ‘রাগের’ বা সুরের প্রচলন আছে। ঐ রাগগুলিকে স্বতন্ত্র মনে করা হইলেও প্রকৃতপক্ষে প্রধান ষড়্রাগ হইতেই ঐগুলির উৎপত্তি। দক্ষিণ ভারতের সঙ্গীতে মূর্চ্ছনা বা শব্দের দোদুল্যমান স্পন্দনের প্রয়োগ খুব কম। সেখানে পূর্ণাঙ্গ সঙ্গীতযন্ত্রের ব্যবহারও দুর্লভ। দক্ষিণদেশের বীণাযন্ত্র প্রকৃত বীণা নয়। আমাদের সামরিক সঙ্গীত বা সামরিক কবিতা-কোনটাই নাই। ভবভূতি কিয়ৎপরিমাণে বীররসপ্রিয় কবি।
যীশুখ্রীষ্ট ছিলেন সন্ন্যাসী। তাঁহার ধর্ম মূলতঃ কেবল সন্ন্যাসীদের উপযোগী। তাঁহার শিক্ষার সারমর্ম-‘ত্যাগ কর’; আর অধিক কিছু নাই। এই শিক্ষা কতিপয় বিশেষ অধিকারীরই উপযোগী।
‘অপর গাল ফিরাইয়া দাও’-এই শিক্ষা কার্যতঃ অসম্ভব, অসাধ্য। পাশ্চাত্যগণ ইহা জানে। যাহারা ধর্মলাভের আকাঙ্ক্ষা করে, যাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য পূর্ণত্ব-লাভ, তাহাদের জন্যই ঐ উপদেশ। সাধারণ লোকের ধর্ম হইল-‘নিজ অধিকারে প্রতিষ্ঠিত হও।’ সন্ন্যাসী ও গৃহস্থ-সকলের নিকট একই প্রকার নৈতিক উপদেশ প্রচার করা যাইতে পারে না।
সকল সাম্প্রদায়িক ধর্মই ধরিয়া লইয়াছে যে, সব মানুষই সমান। বিজ্ঞান কিন্তু উহা সমর্থন করে না। মানুষের শারীরিক পার্থক্য অপেক্ষা মানসিক পার্থক্য অধিক। হিন্দুধর্মের একটি মূল নীতি হইল প্রত্যেক মানুষই পৃথক্-বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। এমন কি, মদ্যপ ও বেশ্যাসক্তের জন্যও হিন্দুধর্মে কিছু মন্ত্রের বিধান রহিয়াছে।
নীতি একটি আপেক্ষিক শব্দ। জগতে বিশুদ্ধ নীতি বলিয়া কোন পদার্থ আছে কি? ঐ ধারণা কুসংস্কার মাত্র। প্রত্যেক যুগের প্রত্যেক ব্যক্তিকে একই আদর্শের দ্বারা বিচার করিবার অধিকার আমাদের নাই। প্রত্যেক দেশে প্রত্যেক যুগের প্রতিটি ব্যক্তি বিশেষ অবস্থার অধীন। অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাবের পরিবর্তনও অপরিহার্য। এক সময়ে গোমাংস-ভক্ষণ নীতিসঙ্গত বলিয়া বিবেচিত হইত।
তখন জলবায়ু শীতল ছিল এবং খাদ্য-শস্যের ব্যবহার বিশেষ প্রচলিত ছিল না। খাদ্যের মধ্যে মাংসই ছিল প্রধান, সুতরাং সেই যুগে ও সেই সময়ে মাংস একরূপ অপরিহার্য ছিল। কিন্তু বর্তমানে গোমাংস-ভক্ষণ নীতিবিরুদ্ধ বলিয়া গণ্য হয়।
ঈশ্বরই একমাত্র অপরিবর্তনীয়। সমাজ চলমান। জগৎ শব্দের অর্থ যাহা অনবরত চলিতেছে। ঈশ্বর অচল।
আমার কথা হইতেছে-‘সংস্কার’ নয়, কিন্তু ‘অগ্রসর হও-চরৈবেতি।’ জগতে উহার বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হওয়ার ফলে আমরা নিজদিগকে বিভিন্ন অবস্থার সহিত খাপ খাওয়াইয়া চলার মধ্যেই জীবনের সকল রহস্য নিহিত। উহাই জীবন-বিকাশের অন্তর্নিহিত মূল নীতি। বহিঃপ্রকৃতি আমাদিগকে দাবাইয়া রাখিতে চায়, উহার বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হওয়ার ফলে আমরা নিজদিগকে বিভিন্ন অবস্থার উপযোগী করিয়া তোলার অথবা পরিবেষ্টনীর সহিত খাপ-খাওয়াইয়া চলিবার ক্ষমতা লাভ করি।
পরিবর্তিত অবস্থার উপযোগী করিয়া তোলার ক্ষমতা যাহার মধ্যে বেশী, সে-ই দীর্ঘজীবী হইয়া থাকে। আমি এই তত্ত্ব প্রচার না করিলেও সমাজ পরিবর্তিত হইতেছে ও হইবেই। মানুষকে হয় বাঁচিয়া থাকিতে হইবে, নতুবা অনাহারী থাকিতে হইবে-এই প্রয়োজনই জগতে কার্য করিতেছে, খ্রীষ্টান ধর্ম অথবা বিজ্ঞান নয়।
হিমালয়ের মহোচ্চ শিখরেই জগতের শ্রেষ্ঠ প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখিতে পাওয়া যায়। যদি কেহ সেখানে কিছুকাল বাস করে, তবে পূর্বে সে যতই অস্থির-চিত্ত থাকুক না কেন, অবশ্যই মানসিক শান্তি লাভ করিবে।
ঈশ্বর যাবতীয় বিশ্ব-বিধানের সর্বশ্রেষ্ঠ রূপ। ঈশ্বরের সত্যকে একবার জানিতে পারিলে অন্যান্য সব কিছুকে ইহার অধীন বলিয়া ব্যাখ্যা করা যাইতে পারে। পতনশীল বস্তুগুলির ক্ষেত্রে নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ-নিয়মের যে স্থান, ধর্মের ক্ষেত্রে ঈশ্বরেরও সেই স্থান।
প্রত্যেক পূজাই উচ্চস্তরের প্রার্থনা। যে-ব্যক্তি ধ্যান অথবা মানস-পূজা করিতে অক্ষম, তাহার পক্ষেই পূজা বা আনুষ্ঠানিক অর্চনার প্রয়োজন। তাহার পক্ষে কোন স্থূল বস্তু প্রয়োজন।
সাহসী ব্যক্তিরাই অকপট হইতে পারে। সিংহের সহিত শৃগালের তুলনা কর।
ঈশ্বর ও প্রকৃতির মধ্যে যাহা কিছু ভাল, তাহাকে ভালবাসা শিশুর পক্ষেও সম্ভব। কিন্তু ভয়ঙ্কর ও দুঃখজনক বস্তুকেও ভালবাসিতে হইবে। সন্তান যখন দুঃখ দেয়, তখনও পিতা তাহার প্রতি স্নেহ পোষণ করেন।
শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বরাবতার, তিনি মানবজাতির উদ্ধারের জন্য অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। গোপীলীলা প্রেমধর্মের পরাকাষ্ঠা, এই প্রেমে সকল ব্যক্তিত্ব লোপ পায় এবং পরম মিলন ঘটে। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ প্রচার করিয়াছেন, ‘আমাকে পাইবার জন্য অন্যান্য সকল বন্ধন ত্যাগ কর’-গোপীলীলায় এই তত্ত্ব অভিব্যক্ত হইয়াছে। ভক্তিতত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করিবার জন্য বৃন্দাবন-লীলার শরণ লও। এ-বিষয়ে বহু সংখ্যক পুস্তক আছে। ভক্তি ভারতবর্ষের সর্বজনীন ধর্ম। হিন্দুজাতির বৃহত্তম অংশ শ্রীকৃষ্ণের অনুবর্তী।
দরিদ্র, ভিক্ষুক, পাপী, পুত্র, পিতা, পত্নী-শ্রীকৃষ্ণ সকলেরই ঈশ্বর। আমাদের সর্বপ্রকার মায়িক সম্বন্ধের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে সম্বদ্ধ হইয়া তিনি এগুলিকে পবিত্র করেন এবং পরিণামে মুক্তি প্রদান করেন। শ্রীকৃষ্ণ-ভগবান্ দার্শনিক ও পণ্ডিতের নিকট নিজেকে লুকাইয়া রাখেন, প্রকট হন অজ্ঞ ও শিশুর নিকট। শ্রীকৃষ্ণ বিশ্বাস ও প্রেমের দেবতা-পাণ্ডিত্যের দ্বারা তাঁহাকে পাওয়া যায় না। গোপীদিগের নিকট প্রেম ও ঈশ্বর এক বস্তু। তাহারা জানিত শ্রীকৃষ্ণ প্রেমের মূর্ত বিগ্রহ।
দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণ কর্তব্য শিক্ষা দিতেছেন, বৃন্দাবনে প্রেম। তাঁহার বংশধরগণ দুর্বৃত্ত বলিয়া তিনি তাহাদের পরস্পরের বিনাশ নিবারণ করেন নাই।
ঈশ্বর সম্বন্ধে য়াহুদী ও মুসলমানগণের ধারণা যে, তিনি একজন আদালতের বড় বিচারক। আমাদের ঈশ্বর বাহিরে কঠোর, কিন্তু অন্তরে প্রেম ও করুণায় পূর্ণ।
অদ্বৈতবাদ কি, তাহা না বুঝিয়া কেহ কেহ উহার উল্টা অর্থ করিয়া থাকেন। তাঁহারা বলেন, শুদ্ধ ও অশুদ্ধ আবার কি? পাপ-পুণ্যের কি প্রভেদ-এগুলি সব মানুষের কুসংস্কার। ফলে তাঁহাদের আচরণে তাঁহারা কোন নৈতিক সংযম পালন করেন না। ইহা নিছক বদমাশি। এই ধরনের প্রচারের দ্বারা প্রভূত অনিষ্ট হয়।
জীব সাধারণতঃ পারিপার্শ্বিক অবস্থা অপেক্ষা দুর্বল, নিজেকে ঐ অবস্থার উপযোগী করিবার জন্য সংগ্রাম করিতেছে। কখনও কখনও তাহার ঐ উপযুক্ততা লাভের প্রচেষ্টা প্রয়োজনকে ছাড়াইয়া যায়। উহার ফলে তাহার সমগ্র শরীরের জাত্যন্তর ঘটে। নন্দী একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন, কিন্তু তাঁহার পবিত্রতা এত বেশী হইয়াছিল যে, মানব-শরীরের পক্ষে উহা ধারণ করা সম্ভব ছিল না। সুতরাং তাহার দেহকোষস্থিত পরমাণুগুলি দেব-দেহে পরিণত হইয়াছিল।
পাপ ও পুণ্য-অনিষ্টকর পাপ ও হিতকর পুণ্য-এই দুই প্রকার কর্মের দ্বারা দেহ গঠিত। শরীরে কণ্টক বিদ্ধ হইলে ঐ কণ্টকটি তুলিয়া ফেলিবার জন্য অপর একটি কণ্টকের প্রয়োজন, পরে দুইটিই ফেলিয়া দিতে হয়। সিদ্ধিলাভের নিমিত্ত কেহ পুণ্যরূপ কণ্টকের দ্বারা পাপরূপ কণ্টক দূর করেন। ইহার পরও তিনি জীবনধারণ করিতে পারেন এবং শুধু পুণ্য অবশিষ্ট থাকায় তাঁহার দ্বারা পুণ্যকর্মই অনুষ্ঠিত হয়। জীবন্মুক্তের মধ্যে কিঞ্চিন্মাত্র পুণ্য অবশিষ্ট থাকায় তিনি জীবিত থাকেন, কিন্তু তিনি যাহা কিছু করেন, তাহাই শুদ্ধ।
যাহা কিছু উন্নতির দিকে লইয়া যায়, তাহাই পুণ্য; যাহা হইতে আমাদের অবনতি, তাহাই পাপ। মানুষের মধ্যে তিন প্রকার গুণ আছে-পশুত্ব, মনুষ্যত্ব ও দেবত্ব। যাহা দেবত্বের উৎকর্ষ সাধন করে, তাহাই পুণ্য। যাহা দ্বারা পশুভাব বৃদ্ধি পায়, তাহাই পাপ। পাশব প্রকৃতি নাশ করিয়া মনুষ্যত্ব লাভ করিতে হইবে-অর্থাৎ প্রেমিক ও দয়ালু হইতে হইবে।
এই অবস্থাও অতিক্রম করিয়া তোমাদিগকে সচ্চিদানন্দস্বরূপ হইতে হইবে-অগ্নির তেজ অথচ দাহ নাই, অপূর্ব প্রেম অথচ জাগতিক প্রেমের দুর্বলতা নাই, দুঃখবোধ নাই।
ভক্তি দুই প্রকার-বৈধী ও রাগানুগা। শাস্ত্রের অনুশাসনে দৃঢ় বিশ্বাসকে ‘বৈধী ভক্তি’ বলে। রাগানুগা ভক্তি পাঁচ প্রকার-(১) শান্ত-খ্রীষ্টধর্মে ইহা রূপায়িত হইয়াছে। (২) দাস্য-রামের প্রতি হনুমানের আচরণে উহা পরিস্ফুট। (৩) সখ্য-শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অর্জুনের ভাবের মধ্য দিয়া উহা প্রকাশিত। (৪) বাৎসল্য-শ্রীকৃষ্ণের প্রতি বসুদেবাদির যে-ভাব, তাহাই বাৎসল্য। (৫) মধুরভাব-শ্রীকৃষ্ণ ও গোপীগণের জীবনে মধুরভাবের (পতি-পত্নীর সম্বন্ধ) বিকাশ দেখা যায়।
কেশবচন্দ্র সেন সমাজকে একটি ডিম্বাকার (elliptic) কক্ষে পরিভ্রমণশীল গ্রহের সহিত তুলনা করিয়াছেন। ঈশ্বর কেন্দ্রগত সূর্য। গ্রহকক্ষের যে-বিন্দুটি সূর্যের নিকটতম, সমাজ কখনও সেই বিন্দুটির মত ঈশ্বরের সমীপবর্তী হয়, আবার কখনও সূর্য হইতে সর্বাপেক্ষা দূরে অবস্থিত বিন্দুটির ন্যায় ঈশ্বর হইতে দূরে সরিয়া যায়।
অবতার আসিয়া ইহাকে ঈশ্বরের সমীপবর্তী করেন। পরে আবার ইহা দূরে সরিয়া যায়। কেন ঐরূপ হইবে? বলিতে পারি না। অবতারের প্রয়োজন কি? সৃষ্টির কি প্রয়োজন ছিল? ঈশ্বর কেন আমাদের সকলকে পূর্ণ করিয়া সৃষ্টি করেন না? ইহাই লীলা, ইহা আমাদের জ্ঞানের অগোচর।
মানুষ ব্রহ্মত্ব লাভ করিতে পারে, কিন্তু ঈশ্বর হইতে পারে না। যদি কেহ ঈশ্বরত্ব লাভ করিয়া থাকেন, তবে তাঁহার রচিত সৃষ্টি দেখাও। বিশ্বামিত্রের সৃষ্টি তাঁহার নিজের কল্পনামাত্র। ঐ সৃষ্টিকে বিশ্বামিত্রের নিয়মে চলিতে হইত। যদি যে-কেহ স্রষ্টা হইতে পারেন, তবে বহু নিয়মের সংঘর্ষের ফলে এই জগতের অবসান ঘটিবে। জগতের ভারসাম্য এরূপ সুন্দর যে, যদি একটি পরমাণুরও সাম্যাবস্থা ভঙ্গ কর, তবে সমগ্র জগৎ লয়প্রাপ্ত হইবে।
এমন সব মহাপুরুষ হইয়া গিয়াছেন, যাঁহাদের সহিত আমাদের বিপুল পার্থক্য কোন গাণিতিক অঙ্ক দ্বারা নির্ণয় করা যায় না। কিন্তু ঈশ্বরের সহিত তুলনায় তাঁহারাও জ্যামিতিক বিন্দুমাত্র। অনন্তের সহিত তুলনায় সবই অকিঞ্চিৎকর। ঈশ্বরের সহিত তুলনা করিলে বিশ্বামিত্র একটি ক্ষুদ্র মনুষ্য-পতঙ্গ ব্যতীত আর কি?
আধ্যাত্মিক ও জাগতিক উভয় ক্ষেত্রে ক্রমবিকাশ-নীতির আদি প্রবর্তক হইলেন পতঞ্জলি।
জীব সাধারণতঃ পারিপার্শ্বিক অবস্থা অপেক্ষা দুর্বল, নিজেকে ঐ অবস্থার উপযোগী করিবার জন্য সংগ্রাম করিতেছে। কখনও কখনও তাহার ঐ উপযুক্ততা লাভের প্রচেষ্টা প্রয়োজনকে ছাড়াইয়া যায়। উহার ফলে তাহার সমগ্র শরীরের জাত্যন্তর ঘটে। নন্দী একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন, কিন্তু তাঁহার পবিত্রতা এত বেশী হইয়াছিল যে, মানব-শরীরের পক্ষে উহা ধারণ করা সম্ভব ছিল না। সুতরাং তাহার দেহকোষস্থিত পরমাণুগুলি দেব-দেহে পরিণত হইয়াছিল।
প্রতিযোগিতারূপ ভয়ঙ্কর যন্ত্রই সবকিছুকে ধ্বংস করিয়া ফেলিবে। যদি বাঁচিয়া থাকিতে চাও তো নিজেকে যুগোপযোগী করিয়া তুলিবার চেষ্টা কর। আমরা যদি আদৌ বাঁচিয়া থাকিতে চাই, তাহা হইলে আমাদিগকে বিজ্ঞাননিষ্ঠ জাতিতে পরিণত হইতে হইবে। মানসিক শক্তিই প্রকৃত বল। ইওরোপীয়দিগের সংগঠন-ক্ষমতা তোমাদের শিক্ষা করা আবশ্যক। তোমাদের নিজেদের শিক্ষিত হওয়া এবং মেয়েদের শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। বাল্যবিবাহ প্রথা রহিত করিতেই হইবে।
ইহা সত্য যে, স্বাভাবিক অবস্থায় জাতি-প্রথা আবশ্যক হয়। যাহাদের কোন বিশেষ কার্যের প্রবণতা আছে, তাহারা একশ্রেণীভুক্ত হয়। কিন্তু কোন বিশেষ ব্যক্তির শ্রেণী নির্ণয় করিবে কে? কোন ব্রাহ্মণ যদি মনে করেন, অধ্যাত্মবিদ্যাচর্চায় তাঁহার বিশেষ ক্ষমতা আছে, তাহা হইলে প্রকাশ্যভাবে শূদ্রের সহিত মিলিত হইতে তিনি ভয় পান কেন? কোন বলবান্ অশ্ব কি নিস্তেজ অশ্বের সহিত দৌড়ের প্রতিযোগিতা করিতে ভয় পায়?
এই-সকল চিন্তা সমাজে ভাসিয়া বেড়াইতেছে। তোমরা সকলেই ইহা জান, কিন্তু তোমরা কেহই ইহা কার্যে পরিণত করিতে সাহস কর না। বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধিবে কে? উপযুক্ত সময়ে এক অদ্ভুত মহাপুরুষের আগমন হইবে। তখন সকল ইঁদুরই সাহস লাভ করিবে।
যখনই কোন মহাপুরুষের আবির্ভাব হয়, তখন সমুদয় পারিপার্শ্বিক অবস্থা তাঁহার জন্য প্রস্তুত থাকে। তিনি যেন উটের পিঠের শেষ তৃণখণ্ডের মত। তিনি যেন কামানের গোলার স্ফুলিঙ্গ। তাঁহার কথায় কিছু একটা আছে-আমরা তাঁহার জন্য পথ প্রস্তুত করিতেছি।
কৃষ্ণ কি চতুর ছিলেন? না, চতুর ছিলেন না। যুদ্ধ নিবারণ করিবার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছিলেন। দুর্যোধনই যুদ্ধ বাধাইয়াছিল। কিন্তু একবার কার্যে প্রবৃত্ত হইলে উহা হইতে নিবৃত্ত হওয়া উচিত নয়-কর্তব্যপরায়ণ ব্যক্তির ইহাই ধর্ম। পশ্চাৎপদ হইও না, উহা কাপুরুষতার পরিচায়ক। একবার কার্যে প্রবৃত্ত হইলে উহা অবশ্যই সম্পন্ন করিতে হইবে, এক ইঞ্চিও আর নড়া উচিত নয়-অবশ্য ইহা কোন অন্যায় কার্যের জন্য নয়। এই যুদ্ধ ছিল ধর্মযুদ্ধ।
শয়তান নানা ছদ্মবেশে আসে-ক্রোধ ন্যায়ের বেশে, কামনা কর্তব্যের রূপ লইয়া। শয়তানের প্রথম আবির্ভাব লোকে জানিতে পারিলেও পরে ভুলিয়া যায়। যেমন উকিলের বিবেকবুদ্ধি-প্রথমে তাহারা বেশ বুঝিতে পারে যে, সমস্তই দুষ্টামি (বদমাশি)-তারপর মক্কেলের প্রতি তাহাদের কর্তব্যবুদ্ধি আসে। অবশেষে তাহারা কঠোর হয়।
যোগিগণ নর্মদার তীরে বাস করেন, সেখানকার জলবায়ু সমভাবাপন্ন বলিয়া তাঁহাদের বাসের পক্ষে উত্তম। ভক্তগণ অবস্থান করেন বৃন্দাবনে।
সিপাহীরা শীঘ্র মারা যায়; প্রকৃতি ত্রুটিপূর্ণ; মল্লবীরগণের শীঘ্র শীঘ্র মৃত্যু ঘটে। ভদ্রশ্রেণী সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী, আর দরিদ্রেরা সবচেয়ে কষ্টসহিষ্ণু। কোষ্ঠবদ্ধ ব্যক্তির পক্ষে ফলাহারই উপযুক্ত হইতে পারে। মস্তিষ্কের কাজ করিতে হয় বলিয়া সভ্য মানুষের বিশ্রাম প্রয়োজন এবং খাদ্যের সহিত তাহাকে মশলা ও চাটনি গ্রহণ করিতে হয়। অসভ্য লোকেরা প্রতিদিন চল্লিশ পঞ্চাশ মাইল হাঁটে, সাদাসিধা খাদ্যই তাহাদের রুচিকর। আমাদের ফলগুলি সবই কৃত্রিম এবং স্বাভাবিক আম অতি সামান্য ফল। গমও কৃত্রিম।
ব্রহ্মচর্য পালন করিয়া দেহে আধ্যাত্মিক শক্তি সঞ্চয় কর।
গৃহস্থের আয় অনুযায়ী ব্যয় করিবার নিয়ম আছে। সে আয়ের এক চতুর্থাংশ পরিবারবর্গের ভরণপোষণ, এক চতুর্থাংশ দানকার্যে, এক চতুর্থাংশ নিজের জন্য ব্যয় করিবে এবং এক চতুর্থাংশ সঞ্চয় করিবে।
বহুত্বে একত্ব, সমষ্টিতে ব্যষ্টি-ইহাই সৃষ্টির রীতি।
শুধু কারণকে অস্বীকার করিতেছ কেন? কার্যকেও অস্বীকার কর। কার্যের মধ্যে যাহা কিছু আছে, তাহা সবই কারণের মধ্যে রহিয়াছে।
খ্রীষ্টের জীবন মাত্র আঠার মাস সাধারণের নিকট প্রকাশিত ছিল। ইহার জন্য তিনি বত্রিশ বৎসর ধরিয়া নীরবে নিজেকে প্রস্তুত করিয়াছিলেন। সর্বসাধারণের সংস্পর্শে আসিবার পূর্বে মহম্মদের চল্লিশ বৎসর অতিক্রান্ত হইয়াছিল।
ইহা সত্য যে, স্বাভাবিক অবস্থায় জাতি-প্রথা আবশ্যক হয়। যাহাদের কোন বিশেষ কার্যের প্রবণতা আছে, তাহারা একশ্রেণীভুক্ত হয়। কিন্তু কোন বিশেষ ব্যক্তির শ্রেণী নির্ণয় করিবে কে? কোন ব্রাহ্মণ যদি মনে করেন, অধ্যাত্মবিদ্যাচর্চায় তাঁহার বিশেষ ক্ষমতা আছে, তাহা হইলে প্রকাশ্যভাবে শূদ্রের সহিত মিলিত হইতে তিনি ভয় পান কেন? কোন বলবান্ অশ্ব কি নিস্তেজ অশ্বের সহিত দৌড়ের প্রতিযোগিতা করিতে ভয় পায়?
‘কৃষ্ণ–কর্ণামৃতের’ রচয়িতা ভক্ত বিল্বমঙ্গলের জীবনী উল্লেখযোগ্য। ঈশ্বরকে দর্শন করিতে পারেন নাই বলিয়া তিনি নিজের দুইটি চোখ উৎপাটন করিয়াছিলেন। বিপথগামী ভালবাসাও যে পরিণামে প্রকৃত প্রেমে পরিণত হইতে পারে তাঁহার জীবন উহার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
একই ব্যক্তির মধ্যে মাতা দেখেন সন্তানকে, আবার পত্নী দেখেন অন্যভাবে। ইহার ফলও বিভিন্ন। মন্দ ব্যক্তি ঈশ্বরের মধ্যে দেখে মন্দ, ধার্মিক তাঁহার মধ্যে দেখেন পুণ্য। ঈশ্বরকে সকল রূপেই চিন্তা করা যায়। প্রত্যেকের ভাব অনুযায়ী তিনি রূপ পরিগ্রহ করেন। বিভিন্ন পাত্রে জল বিভিন্ন আকার ধারণ করে, কিন্তু সকল পাত্রেই জল আছে। অতএব সকল ধর্মই সত্য।
অত্যন্ত আগে ধর্মের ক্ষেত্রে উন্নতি এবং সর্ববিষয়ে সূক্ষ্মদৃষ্টি-এই দুইটির জন্য হিন্দুগণ সর্বদা উচ্চতর তত্ত্ব লইয়া ব্যাপৃত থাকিতেন। ইহার ফলে তাঁহারা ঐহিক বিষয়ে বর্তমান অবস্থায় পতিত হইয়াছেন। হিন্দুগণকে পাশ্চাত্যের নিকট কিঞ্চিৎ বস্তুতন্ত্রবাদ শিক্ষা করিতে হইবে এবং ইহার পরিবর্তে পাশ্চাত্যকে কিছু আধ্যাত্মিকতা শিখাইতে হইবে।
তোমাদের নারীগণকে শিক্ষা দিয়া ছাড়িয়া দাও। তারপর তাহারাই বলিবে, কোন্ জাতীয় সংস্কার তাহাদের পক্ষে আবশ্যক। তাহাদের সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে কথা বলিবার তোমরা পুরুষরা কে?
ভাঙ্গী ও পারিয়াগণের বর্তমান অধঃপতিত অবস্থার জন্য দায়ী কাহারা? আমাদের হৃদয়হীন ব্যবহার ও সেই সঙ্গে অদ্ভুত অদ্বৈতবাদ-প্রচার-ইহা কি আঘাতের উপর অপমান নয়?
এই জগতে সাকার ও নিরাকার পরস্পর সম্বদ্ধ। নিরাকারকে সাকারের মধ্য দিয়াই প্রকাশ করা যাইতে পারে, আবার নিরাকারের পটভূমিতেই সাকারকে চিন্তা করা যাইতে পারে। আমাদের চিন্তারই বাহ্যরূপ জগৎ। প্রতিমা ধর্মেরই অভিব্যক্তি।
ঈশ্বরে যাবতীয় জীবপ্রকৃতি বিদ্যমান। কিন্তু মানুষ আমরা কেবল মানব-প্রকৃতির মধ্য দিয়াই তাঁহাকে দর্শন করিতে পারি। যেমন পিতা বা পুত্ররূপে আমরা মানুষকে ভালবাসি, তেমনি ঈশ্বরকে ভালবাসিতে পারি। নর ও নারীর মধ্যে যে প্রেম, তাহাই প্রবলতম প্রেম, উহাও আবার যত গোপনীয় হইবে ততই দৃঢ়তর হইবে। এই প্রেম শ্রীভগবানের প্রতি কিভাবে প্রযুক্ত হইতে পারে, তাহা রাধাকৃষ্ণের প্রেমের মধ্য দিয়াই ব্যক্ত হইয়াছে।
মানুষ পাপী হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছে-এ-কথা বেদে কোথাও কোথাও নাই। মানুষকে পাপী বলা মনুষ্যত্বের ঘোরতর অমর্যাদা করা।
সত্যকে সামনাসামনি প্রত্যক্ষ করার অবস্থা লাভ করা সহজ নয়। সেদিন সমগ্র চিত্রের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে অবস্থিত বিড়ালটিকে কেহ খুঁজিয়া পায় নাই, যদিও চিত্রের অধিকাংশ স্থান ব্যাপিয়াই বিড়ালটি ছিল।
কাহাকেও আঘাত করিয়া তুমি স্থিরভাবে বসিয়া থাকিতে পার না। সৃষ্টি এক অদ্ভুত যন্ত্র। ঈশ্বরের প্রতিশোধ হইতে পরিত্রাণ লাভের উপায় নাই।
কাম অন্ধ, মানুষকে নরকে লইয়া যায়। ভালবাসাই প্রেম, ইহা স্বর্গে লইয়া যায়।
কৃষ্ণ-রাধার প্রেমে কামের লেশ নাই। রাধা কৃষ্ণকে বলেন, ‘তুমি যদি আমার বুকে পদা স্থাপন কর, তাহা হইলে আমার সকল কাম দূরীভূত হইবে।’ ভগবানের প্রতি অনুরাগ হইলে কাম চলিয়া যায়, তখন থাকে শুধু প্রেম।
জনৈক কবি এক রজকিনীকে ভালবাসিতেন। স্ত্রীলোকটির পায়ে গরম ডাল পড়িয়াছিল, তাহার ফলে কবির চরণ পুড়িয়া যায়।
শিব ঈশ্বরের সুশান্ত প্রকাশ, কৃষ্ণে প্রকাশ ঈশ্বরের মাধুর্য। প্রেম ঘনীভূত হইয়া নীলরঙে পরিণত হয়। নীলরঙ প্রগাঢ় প্রেমের দ্যোতক। সলোমন ‘কৃষ্ণ’কে দর্শন করিয়াছিলেন। এখানে (ভারতে) অনেকেই কৃষ্ণকে দর্শন করিয়াছে।
এখনও হৃদয়ে বিশুদ্ধ প্রেম জাগিলে রাধাকে দর্শন করা যায়। রাধা হইয়া যাও এবং মুক্ত হও। নান্যঃ পন্থাঃ। খ্রীষ্টানেরা সলোমনের সঙ্গীতের মর্মগ্রহণ করিতে পারে না। তাহাদের মতে-ইহা চার্চের প্রতি খ্রীষ্টের গভীর অনুরাগের প্রতীক-ভবিষ্যদ্বাণী। তাহাদের নিকট ঐ সঙ্গীত অর্থহীন এবং সেজন্য উহার সম্পর্কে কোন কাহিনী সৃষ্টি করে।
হিন্দুগণ বুদ্ধকে অবতার বলিয়া বিশ্বাস করে। ঈশ্বরের প্রতি তাহাদের দৃঢ় বিশ্বাস। ভগবান্ আছেন কি নাই, বৌদ্ধেরা তাহা জানিবার চেষ্টা করে না। কশাঘাত করিয়া আমাদিগকে কর্মে তৎপর করিবার জন্যই বুদ্ধের আবির্ভাব। সৎ হও, রিপুগুলি দমন কর। তখন নিজেই জানিতে পারিবে, দ্বৈত বা অদ্বৈত দর্শনের কোন্টি সত্য-তত্ত্ব এক বা বহু। বুদ্ধ হিন্দুধর্মের একজন সংস্কারক ছিলেন।
একই ব্যক্তির মধ্যে মাতা দেখেন সন্তানকে, আবার পত্নী দেখেন অন্যভাবে। ইহার ফলও বিভিন্ন। মন্দ ব্যক্তি ঈশ্বরের মধ্যে দেখে মন্দ, ধার্মিক তাঁহার মধ্যে দেখেন পুণ্য। ঈশ্বরকে সকল রূপেই চিন্তা করা যায়। প্রত্যেকের ভাব অনুযায়ী তিনি রূপ পরিগ্রহ করেন। বিভিন্ন পাত্রে জল বিভিন্ন আকার ধারণ করে, কিন্তু সকল পাত্রেই জল আছে। অতএব সকল ধর্মই সত্য।
ঈশ্বর নিষ্ঠুর, আবার নিষ্ঠুর নন। তিনি সর্বভূতে আছেন আবার নাই। অতএব তিনি পরস্পরবিরুদ্ধ-ভাবময়। প্রকৃতিও পরস্পর-বিরোধী ভাবরাশি ব্যতীত আর কিছুই নয়।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….