কোন এক দ্বীপে তিন প্রবীণ সন্ন্যাসী বাস করতেন। তাঁরা এতই সরল ছিলেন যে, প্রার্থনাকালে তাঁরা শুধু এই ক’টি কথাই বলতেন, ‘আমরাও তিনজন, আপনিও ত্রিমূর্তি- আমাদের প্রতি দয়া করুন।’ এই অত্যন্ত সরল সাদাসিধা প্রার্থনার সময় নানাবিধ অলৌকিক ব্যাপার সব ঘটতে লাগল।
স্থানীয় বিশপ এই তিন সন্ন্যাসী আর তাঁদের অশাস্ত্রীয় প্রার্থনার কথা শুনতে পেয়ে ভাবলেন যে, তাঁদের সঙ্গে দেখা করে শাস্ত্রানুযায়ী তাঁদের কেতাদুরস্ত প্রার্থনা শিক্ষা দেওয়া নিতান্তই প্রয়োজন। তিনি সেই দ্বীপটিতে এলেন; সন্ন্যাসীদের বললেন, ঈশ্বরের কাছে তাঁদের দিব্য প্রার্থনা ঠিক যথোপযুক্তভাবে হচ্ছে না। তিনি তাঁদের নানারকম শাস্ত্রবিধিসম্মত প্রার্থনা করার শিক্ষা আর উপদেশ দিলেন।
তারপর বিশপ মহোদয় কটি নৌকা করে স্থান ত্যাগ করলেন। যেতে যেতে দেখলেন যে, একটা উজ্জ্বল জ্যোতির্মণ্ডল নৌকার পিছন পিছন ছুটে আসছে। জ্যোতিটি কাছে এসে পৌঁছাতেই তিনি দেখলেন ঐ তিন সন্ন্যাসী হাত ধরাধরি করে ঢেউয়ের উপর দিয়ে ছুটে আসছেন নৌকাটি ধরবার জন্য।
বিশপের কাছে পৌঁছাতেই তাঁরা চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, ‘আপনি যে প্রার্থনাগুলি শিখিয়েছিলেন তা আমরা ভুলে গেছি; তাই তাড়াতাড়ি আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে এসেছি, সেগুলো আর একবার বলে দিন।’ দেখে শুনে তো বিশপ মশাই ভীষণ অবাক।
ভয়ে ভীত হয়ে মাথা নেড়ে সবিনয়ে বললেন, ‘সাধু মহোদয়গণ! আপনারা পুরানো প্রার্থনাই বলতে থাকুন; নূতন কিছুর আর দরকার নেই।’
প্রশ্ন হলো : সাধু তিনটি জলের উপর দিয়ে হেঁটে এলেন কি করে?
যীশুখ্রীষ্ট তাঁর ক্রুশবিদ্ধ দেহকে পুনরুত্থিত করলেন কেমন করে?
লাহিড়ীমশাই আর শ্রীযুক্তেশ্বর গিরিজী অলৌকিক ব্যাপার প্রদর্শন করতেন কি করে?
আধুনিক বিজ্ঞান আজ পর্যন্ত এর কোন সদুত্তর দিতে পারেনি। যদিও আণবিক যুগের আগমনে বিশ্বমানস হঠাৎ প্রসারতা লাভ করেছে। মানুষের অভিধানে ‘অসম্ভব’ কথাটা ক্রমশঃই গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছে।
আরেকটি উদাহরণ- পরমাণু অর্থাৎ জড়কণার চূড়ান্ত অবস্থা হচ্ছে একটি পৃথিবীরই মত, যেন একটি চুম্বক, যার ধনাত্মক আর ঋণাত্মক, দুইটি মেরু আছে। সমগ্র প্রতিভাসিক জগৎ অথবা জগতপ্রপঞ্চ হচ্ছে মেরুপ্রবণতার অদম্য প্রভাবের অধীন; দেখা গেছে, পদার্থবিদ্যা, রসায়ণশাস্ত্র অথবা অন্য যে কোন বিজ্ঞানই হোক না কেন, তারা সহজাত বিরুদ্ধবাদিতা বা বিপরীত নীতিশূন্য নয়।
প্রাচীন বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, এই জড়জগৎ দ্বৈতবাদ আর সাপেক্ষন্যায় বা আপেক্ষিকবাদ যার উপর ‘মায়াবাদ’ প্রতিষ্ঠিত, সেই একটিমাত্র মূলবিধি দ্বারাই পরিচালিত হয়। সকল প্রাণের প্রাণ পরমাত্মা হচ্ছেন অদ্বয়তত্ত্ব; সৃষ্টলোকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন ও বৈচিত্র্যময় প্রকাশ করার জন্য তিনি একটি মিথ্যা বা অসত্য আবরণে নিজেকে আবরিত করেন।
ভ্রান্তিজনক মোহময় সেই দ্বৈত আবরণই হচ্ছে ‘মায়া’। আধুনিককালের বহু বড় বড় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারই ঋষিদিগের এই সরল সত্য উক্তিকে সমর্থন করেছে।
নিউটনের গতিতত্ত্বও হচ্ছে ‘মায়ার’ বিধি- “প্রত্যেক ক্রিয়ার সর্বদাই একটা সমান আর বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। যে কোন দুইটি বস্তুর পারস্পরিক ক্রিয়া সর্বদাই সমান ও বিপরীতভাবে ক্রিয়াশীল।” কাজেই, ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া অবিকল সমান। “স্বতন্ত্র একটিমাত্র শক্তি তাই অসম্ভব; সেই জন্য সর্বদাই দুইটি করে শক্তি থাকবে, যারা সমান আর বিপরীত।”
এ’কারণে সকল মৌলিক স্বাভাবিক ক্রিয়াশীলতা থেকেই মায়িক উৎপত্তি প্রকাশ পায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে- বিদ্যুতের ক্রিয়া হচ্ছে আকর্ষণ আর বিকর্ষণ; এর ইলেকট্রন আর প্রোটন দুই বিপরীত বিদ্যুৎধর্মী।
আরেকটি উদাহরণ- পরমাণু অর্থাৎ জড়কণার চূড়ান্ত অবস্থা হচ্ছে একটি পৃথিবীরই মত, যেন একটি চুম্বক, যার ধনাত্মক আর ঋণাত্মক, দুইটি মেরু আছে। সমগ্র প্রতিভাসিক জগৎ অথবা জগতপ্রপঞ্চ হচ্ছে মেরুপ্রবণতার অদম্য প্রভাবের অধীন; দেখা গেছে, পদার্থবিদ্যা, রসায়ণশাস্ত্র অথবা অন্য যে কোন বিজ্ঞানই হোক না কেন, তারা সহজাত বিরুদ্ধবাদিতা বা বিপরীত নীতিশূন্য নয়।
এই মায়ার অবগুণ্ঠন উন্মোচন করার মানেই হচ্ছে সৃষ্টিরহস্য ভেদ করা। যে যোগী এইভাবে বিশ্বপ্রকৃতির রহস্য ভেদ করতে পারেন, তিনিই প্রকৃত অদ্বৈতবাদী। আর বাকি সব প্রাণহীন মূর্তিপূজা করেই ক্ষান্ত। মানুষ যতদিন প্রকৃতির এই দ্বৈতভাবের অধীন হয়ে থাকবে, ততদিন এই দ্বিমুখিনী মায়াই হবে তার উপাস্যা দেবী। সে কখনই একমাত্র সত্যস্বরূপ ঈশ্বরকে জানতে পারবে না।
প্রাকৃতিক বিজ্ঞান তাই মায়ার অতীত কোন নিয়ম বিধিবদ্ধ করতে পারে না- বিশ্বসৃষ্টির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে বিজড়িত। প্রকৃতি নিজেই হচ্ছে ‘মায়া’; কাজেই প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকে অবশ্যই তার অপরিহার্য সারাংশকে নিয়েই কাজ চালাতে হবে। প্রকৃতি তার নিজরাজ্যে অফুরন্ত আর চিরন্তন। ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানীরা তার অনন্তবৈচিত্রের এক রূপ থেকে অন্য রূপের মধ্যে প্রবেশ করা ছাড়া আর বেশি কিছু করতে পারবেন না।
বিজ্ঞান এক অনন্ত রহস্যস্রোতে ভেসে চলেছে- অন্ত আর খুঁজে পাচ্ছে না। বিজ্ঞান অবশ্য পূর্ব হতে বর্তমান আর ক্রিয়াশীল বিশ্বের নিয়ম আবিষ্কার করতে সক্ষম বটে, কিন্তু সেই বিধির “বিধি” আর তার একমাত্র যিনি নিয়ন্তা, তাঁকে খুঁজে বার করতে তা একেবারেই অক্ষম। মহাকর্ষ আর বৈদ্যুতিক শক্তির অপূর্ব আর বিরাট ক্রিয়া সব জানা গেছে বটে, কিন্তু মহাকর্ষ আর বিদ্যুতের শক্তিটা আসলে যে কি জিনিষ, তা কোনো মানুষই আজ পর্যন্ত জানতে পারে নি।
প্রাচীন মুনিঋষিরা এই মায়া অতিক্রম করবার ভার মানবজাতির হাতেই সমর্পণ করে গেছেন। বিশ্বসৃষ্টির মধ্যে এই দ্বৈতভাব অতিক্রম করে স্রষ্টার সহিত একাত্মবোধই মানবজীবনের চরম লক্ষ্য বলে বিবেচিত হয়েছে।
মায়াবদ্ধ জীবেরা, যারা এই বিশ্বনাট্যলীলার ছবি আঁকড়ে ধরে রয়েছে, তারা জোয়ার-ভাটা, দিবা-রাত্র, সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ, উত্থান-পতন, জন্ম-মৃত্যু- এই সব মেরুপ্রবণতার দ্বৈতভাবের মূলবিধি মানতে বাধ্য। কয়েক হাজার জন্মজন্মান্তরের মধ্যে দিয়ে এই চক্রে ঘুরে ঘুরে মানুষ শ্রান্ত আর ক্লান্ত হয়ে মায়াতীত কোন বস্তুর সন্ধানে আশাপূর্ণ হৃদয়ে তাকিয়ে থাকে।
এই মায়ার অবগুণ্ঠন উন্মোচন করার মানেই হচ্ছে সৃষ্টিরহস্য ভেদ করা। যে যোগী এইভাবে বিশ্বপ্রকৃতির রহস্য ভেদ করতে পারেন, তিনিই প্রকৃত অদ্বৈতবাদী। আর বাকি সব প্রাণহীন মূর্তিপূজা করেই ক্ষান্ত। মানুষ যতদিন প্রকৃতির এই দ্বৈতভাবের অধীন হয়ে থাকবে, ততদিন এই দ্বিমুখিনী মায়াই হবে তার উপাস্যা দেবী। সে কখনই একমাত্র সত্যস্বরূপ ঈশ্বরকে জানতে পারবে না।
………………………..
যোগী-কথামৃত(Autobiography of a Yogi) শ্রী শ্রী পরমহংস যোগানন্দ বিরচিত পূজনীয় ও পরমারাধ্য আমার গুরুদেব শ্রী শ্রী স্বামী শ্রীযুক্তেশ্বর গিরি মহারাজের শ্রীকরকমলে অর্পিত। মৎপ্রণীত ইংরাজী ‘অটোবায়োগ্রাফি অফ্ এ যোগী’র বঙ্গানুবাদে শ্রীমান ইন্দ্রনাথ শেঠের স্বেচ্ছা প্রণোদিত প্রয়াস ও অক্লান্ত প্রচেষ্টার জন্য আমি তাকে ধন্যবাদ ও আশির্বাদ জানাই। – পরমহংস যোগানন্দ
…………………………………
পুণঃপ্রচারে বিনীত -প্রণয় সেন
…………………………………
আরও পড়ুন-
আধ্যাত্মিক উপলব্ধি
পরমসত্তানুসন্ধানে আত্মোপলব্ধির গুরুত্ব
অলৌকিক ঘটনার নিয়ম
ভাববাদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….