ভবঘুরেকথা
পঞ্চপ্রেম ধ্যান চক্র আধ্যাত্মিক আত্মজ্ঞান

-রব নেওয়াজ খোকন

মহাজগতের মূল চালিকাশক্তির স্বরূপ জানার আকাঙ্ক্ষা থেকে উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটে দর্শনের। ধর্মগ্রন্থ কিংবা ইতিহাসকে কেন্দ্র করে বহুমতের বিভ্রান্তি যখন ঘোলাজলের মতো অস্বচ্ছ করে দেয় পরমসত্তার রহস্য, তখন দর্শনের প্রয়োজনীয়তা প্রাধান্য পায়। তবে দর্শনের উৎপত্তি ধর্মেরও আগে প্রাগৈতিহাসিক কালে। মানব সভ্যতা শুরুর সাথে সাথে এর সূচনা।

কোনো কোনো মনীষীর ধারণা, দর্শনকে পূঁজি করে ধর্মের অবতারণা। তবে এ মতটির সাথে ধর্মতাত্ত্বিকদের মতের ভিন্নতা রয়েছে। ধর্মগ্রন্থ যদি প্রত্যাদেশ বা ঐশি বাণী হয়ে থাকে, তবে দর্শনের ওপর নির্ভরশীলতার মতবাদটি অবান্তর। এ নিয়ে বিতর্কও রয়েছে বেশ। সে যাই হোক। বাস্তবতা হলো, দর্শন বহুধর্ম, বহুমতের মধ্যকার সমন্বিত প্রয়াস। ইতিহাস কিংবা ধর্মের কাছে দর্শন জিম্মি নয়। সে সবসময় নিজের ঠাঁট বজায় রেখে চলে। তবে ধর্মগ্রন্থ ও ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত তথ্য দর্শনচর্চাকে ত্বারান্বিত করে।

ধর্মকে ঐশী বাণী হিসেবে মর্যাদার একটি আসনে সসম্মানে জায়গা দিলেও, ইতিহাস নিয়ে রয়েছে দর্শনের খানিকটা দ্বন্দ্ব। ইতিহাসের বর্ণিত সত্যকে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে সে কোনো কালেই মানে নি। দার্শনিকের দৃষ্টিভঙ্গিটা এমন যে, ইতিহাস হলো সত্য-মিথ্যার মিশ্রণে তৈরি এক সুস্বাদু জগাখিচুড়ি। সত্য ও মিথ্যা দুটোই রয়েছে তাতে।

তবে কোনটির ভাগ বেশি, তা নির্ধারণ করাটা বেশ জটিল কাজ। জঘাখিচুড়ির এ রন্ধনপ্রণালীতে সত্যের পরিমাণ নির্ভর করে ইতিহাস-লেখকের বিচক্ষণতা, দর্শনবোধ ও প্রাজ্ঞিক চৈতন্যের ওপর। তবে বিচক্ষণতায় ইতিহাসবিদ যতোই পোক্ত হোন না কেন, তার রচিত ইতিহাসে মিথ্যা বা অলীক কল্পনার মিশেল থাকবেই।

আর সেজন্যেই ইতিহাস এতো মজাদার বিশ্বাসের যোগান দেয়। সাধারণ পাঠক-শ্রোতা তা হৃদয়ের কার্নিশে সযত্নে সাজিয়ে রাখে। ঠিক এই অবোধবোধে ঠোকা মেরে দার্শনিক ওমর খৈয়াম যথার্থই বলেছিলেন-

‘নগদ যা পাও, হাত পেতে নাও
বাকির খাতা শূন্য থাক,
লাভ কী শুনে দূরের বাদ্য
মাঝখানে যার বেজায় ফাঁক।’

তাঁর এ উক্তিটি ইতিহাস-নির্ভরতার প্রতি কটাক্ষ হলেও, সাধারণের মাঝে এর প্রভাব পরে নি বললেই চলে। কারণ মানুষ কল্পনানির্ভর রূপকথায় এতো বেশি আকৃষ্ট ও অভ্যস্ত যে, এমন দু-চারটা ঠোকা বা খোঁচায় টনক নড়বে না। অবৈজ্ঞানিক কাল্পনিকতাকেই আকড়ে ধরে অসীম শূন্যতার ভেতর নিজের সসীম সংকীর্ণতার আশ্রয় খোঁজে মানুষ।

আর অবৈজ্ঞানিক বিশ্বাসের মূলে রয়েছে অজ্ঞতার বাহুল্য। অজ্ঞতার পুঁজি যার যত বেশি কাল্পনিক অলৌকিতায় তার ততো বেশি নির্ভরতা। অবুঝ শিশুর ভূত-পেত্নী বা রূপকথার গল্পের প্রতি জোরালো বিশ্বাস দেখলে আমরা বিষয়টা সহজে আন্দাজ করতে পারি। লৌকিকতার চেয়ে অলৌকিকতায় কৌতুহল বেশি থাকার কারণে দূরের বাদ্যে কান পাততে ভালো লাগে। রবীন্দ্রনাথের আত্মোপলব্ধিমূলক একটি কথায় এর স্পষ্টতা মেলে-

‘দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ঘাসের শীষের ওপর
একটি শিশিরবিন্দু। ‘

আমরা প্রতিনিয়তই কাছের বস্তুকে অবজ্ঞা করে দূরের পানে তাকাই। ক্ষুদ্রকে পায়ে দলে বৃহতের মাঝে কাঙ্ক্ষিতকে খুঁজে ফিরি। পরশপাথর পেতে, সীমাকে অতিক্রম করে অসীমতায় সাঁতার দিয়ে থাকি। এসবই আমাদের ভ্রান্তি। প্রজ্ঞার দারিদ্র্য। প্রজ্ঞার প্রাচুর্যই আত্মোপলব্ধির নির্দেশক।

আর এ আত্মোপলব্ধির পথ ধরেই দর্শনের এগিয়ে চলা। আত্মোপলব্ধির দর্শন বৃহৎ অপেক্ষা ক্ষুদ্র, দূর অপেক্ষা নিকটেই বেশি চর্চিত। এ-যে আপনার মাঝেই পরমসত্য বা পরমসত্তার অনুসন্ধানে বেশি আকৃষ্ট। নিজ দেহ-মনের সংযোগস্থলেই মহাজগতের মূল চালিকাশক্তি বা পরমসত্তার স্টেশন বলে মনে করে। এবং এটিই আত্মদর্শন নামে অভিহিত। বলা হয়, ‘যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তা আছে দেহভাণ্ডে।’

সেদিক থেকে অংক কষলে পরমসত্তার অনুসন্ধানের উৎসটি একেবারেই কাছের। ইতিহাসকে বা গ্রন্থগত সত্যকে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে না মেনে আত্মোপলব্ধির আশ্রয় নেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। চিরাচরিত বিশ্বাস্যকে চূড়ান্ত হিসেবে না নিয়ে স্বকীয় বোধের যাচাই কলে পিষে এর নির্যাসটুকু বের করে আনাই অধিক যুক্তিযুক্ত।

সেক্ষেত্রে ইতিহাসকে তথ্যভাণ্ডার হিসেবে মর্যাদার আসনে বসানো ও গৌণতার পদবি দিলে উভয়কূলই রক্ষা পায়। ইতিহাস তার অবদানের স্বীকৃতি পায়। আর আমাদের স্বকীয়তার উন্মেষ নিশ্চিত হয়। স্বকীয়তাকে অক্ষুণ্ণ রেখে যে-দর্শন চর্চিত, সেটিই সত্যদর্শন। আমিত্বের মাঝেই সকল জিজ্ঞাসার জবাব, সৃষ্টিরহস্যের সকল মীমাংসার গুপ্তধন। সকল ধর্মেরও মূলবাণী আসলে এটিই।

…………………………………
আরও পড়ুন-
আধ্যাত্মিক উপলব্ধি
পরমসত্তানুসন্ধানে আত্মোপলব্ধির গুরুত্ব
অলৌকিক ঘটনার নিয়ম

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!