আইয়োনীয় দর্শন
-দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
আজকাল দার্শনিক বলতে, অন্তত চলিতভাবে, আমাদের মনে আসে একরকম আধপাগলা ধরনের মানুষের কথা, বিশ্বের চরম রহস্য-চিন্তায় এমনই সে মশগুল যে সাধারণ কর্মজীবনে খুঁটিনাটির ব্যাপারেও তার ঔদাসীন্য–তার চালচলন, এমন কী তার চেহারাতেও নাকি এই ঔদাসীন্যের ছাপ।
হয়তো চুল আঁচড়ায় না, দাড়ি কামায় না, জামার বোতাম আঁটতে ভুলে যায়, কিংবা জামাটাই গায়-গলায় উলটো করে; বাজারে চালের দর কত জিজ্ঞেস করলে তার মুখে অসহায় শিশুর ভাব ফুটে ওঠে, পুঁথিপত্র নিয়ে সে যখন তন্ময় তখন ঘরে আগুন লাগল কি-না লাগল এ খেয়ালটুও তার থাকে না।
এই বুঝি জাত দার্শনিকের নিখুঁত ছবি; একান্ত জ্ঞানবিভোর, আর তাই যেন একান্ত অকৰ্মণ্য! দার্শনিক বলতে এমনতর ছবি কেন আমাদের মনে উকি দেয়? তার কারণ, আধুনিক দুনিয়ায় জ্ঞানচর্চা আর মেহনত-জীবনের মধ্যে দেখা দিয়েছে বিশাল গভীর খাদ, কিংবা, যা একই কথা, তত্ত্বান্বেষণের সঙ্গে সামাজিক মেহনতের সম্পর্ক গেছে ঘুচে।
আর তাই দার্শনিক বলতে আমরা বুঝি নিছক জ্ঞানবিভোর এক মানুষ, সহজ কর্মজীবনের দিক থেকে চেয়ে দেখলে যাকে কিন্তুতকিমাকার দেখায়। কাজের মানুষ তাই ঠাট্টা করে বলে; দর্শন হলো এক অন্ধের পক্ষে এক অন্ধকার ঘরে একটা কালো বেড়ালের সন্ধান, ঘরটায় অবশ্য কোনো বেড়ালেরই চিহ্ন নেই।
অথচ, দর্শনের এ হেন দুর্নাম এমন কিছু চিরকেলে দুর্নাম নয়। ইতিহাসবিচারে দেখতে পাওয়া যায়, কোনো কোনো যুগে সামাজিক মেহনতের সঙ্গে দর্শনের আর দার্শনিকের নিবিড় আত্মীয়তা ফুটে উঠেছে। দার্শনিক বলতে তখন কোন চিন্তাবিলাসীর ছবি মনে আসে না।
তখন প্রকৃতবিজ্ঞানের যে ইজত। দার্শনিকেরও সেই ইজ্জত, প্রকৃত বিজ্ঞানের যে সামাজিক প্রতিষ্ঠা দর্শনেরও সেই সামাজিক প্রতিষ্ঠা; অর্থাৎ, তত্ত্বান্বেষণ আর কর্মজীবনের মধ্যে যখন যোগাযোগ, তখন দর্শন আর বিজ্ঞানের মধ্যে সীমারোখাটা অস্পষ্ট, কিংবা, যা প্রায় একই কথা, দর্শন তখন প্রকৃত অর্থে বিজ্ঞানে পরিণত।
অবশ্যই, থ্যালিসের কোনো পূর্ণাঙ্গ জীবনচরিত তখনকার দিনে কেউই লিখে যাননি। তবুও নানান প্রাচীন পুঁথিপত্র থেকে তাঁর জীবনী সম্বন্ধে কতকগুলো টুকরো কথা উদ্ধার করা যায়। আজকের ঐতিহাসিক মোটামুটি এরই ভিত্তিতে থ্যালিসের একটা জীবনচরিত গড়ে তোলবার চেষ্টা করেন।
যে-যুগে ইওরোপীয় দর্শনের জন্ম সেই যুগ সম্বন্ধে এই কথাই। আর ইওরোপীয় দর্শনের ইতিহাসে সকলেই র্যাকে আদি দার্শনিক বা প্রথম দার্শনিক বলে স্বীকার করেন, তিনি মোটেই নিছক তন্ময় চিন্তাবিলাসী ছিলেন না। বরং তাঁর বৈজ্ঞানিক প্রতিভা, কর্মজীবনে কৃতিত্ব বা ব্যবহারিক সাফল্য তখনকার যুগের তুলনায় অসামান্য বলেই স্বীকৃত।
ইওরোপীয় সংস্কৃতির অন্যান্য নানান দিকের মতো ইওরোপীয় দর্শনেরও জন্মভূমি হলো গ্রীস। গ্রীকদের মধ্যে যিনি প্রথম দার্শনিক তার নানা থ্যালিস। যীশুখ্রীষ্ট জন্মাবার ৬৪০ বছর আগে তাঁর জন্ম এবং নব্বই বছর বয়সে, অর্থাৎ, যীশুখ্রীষ্ট জন্মাবার ৫৫০ বছর আগে, তার মৃত্যু।
অবশ্য, শুধু গ্রীক বললেই কথাটা স্পষ্ট হয় না। ইওরোপের মানচিত্রটা একবার মনে করুন : গ্রীসের পুর্বদিকে যে সমূদ্র তার ওপারে ছোট ছোট স্বীপ, তারপর তুর্কি। তুর্কির পশ্চিমে অনেকখানি উপকূল অংশকে ছোট এশিয়া বা এশিয়া মাইনর বলা হয়।
প্রাচীনকালে গ্রীকদের প্রধান চারটি জাতির মধ্যে আয়োনীয় নামের জাতি এই এশিয়া মাইনর-এ এসে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। সে উপনিবেশের যে-বারোটি শহরের কথা ইতিহাসে প্রসিদ্ধ, তারই ভিতর একটি শহরের নাম মিলেটাস, আর যে অঞ্চলে এই মিলেটাস শহর সেই অঞ্চলেরই নাম আয়োনিয়া।
ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক থেকে আয়োনীয়দের তখন খুব নাম-ডাক। এমন-কী, তখনকার দিনেই ওরা আমাদের দেশ পর্যন্ত সওদাগরি করতে আসত; খুব সম্ভব ওদের নাম থেকেই আমাদের দেশে “যবন” শব্দ প্রথম চালু হয়।
আয়োনীয়দের এমন যে সরগরম ব্যবসা-বাণিজ্য, তার একটি প্রধান ঘাটি ছিল ওই মিলেটাস শহর। আর এই কর্মমুখর শহরেই জন্ম হলো ইওরোপীয় দর্শনের, থ্যালিস ছিলেন এই শহরের বাসিন্দা।
সওদাগরি শহরটার আবহাওয়া আর তখনকার দিনের যে সমাজব্যবস্থা তার ছায়া কেমনভাবে তাঁর দর্শনে প্রতিফলিত হয়েছে সে-কথা একটু পরে তোলা যাবে। তার আগে দেখা যাক থ্যালিসের জীবনী, দেখা যাক তখনকার প্রয়োগ প্রধান বিজ্ঞানের সঙ্গে আর কর্মজীবনের সঙ্গে তার কী-রকম গভীর যোগাযোগ।
অবশ্যই, থ্যালিসের কোনো পূর্ণাঙ্গ জীবনচরিত তখনকার দিনে কেউই লিখে যাননি। তবুও নানান প্রাচীন পুঁথিপত্র থেকে তাঁর জীবনী সম্বন্ধে কতকগুলো টুকরো কথা উদ্ধার করা যায়। আজকের ঐতিহাসিক মোটামুটি এরই ভিত্তিতে থ্যালিসের একটা জীবনচরিত গড়ে তোলবার চেষ্টা করেন।
অবশ্য, প্রাচীন ইতিহাসে থ্যালিসের এত যে খ্যাতি, তা তাঁর বিষয়বুদ্ধির গুণেও নয়, জ্যামিতি-বিজ্ঞানে বুৎপত্তির দরুনও নয়। খ্যাতিটা হলো দার্শনিক প্রতিভার। তা-ও, দর্শন সম্বন্ধে তিনি এমন কিছু পুঁথিপত্র লিখে যাননি, অন্তত তাঁর লেখা কোনো পুঁথির কোনো খবর আমরা পাইনি।
এই জীবনচিত্রের একটা প্রধান কথা হলো, তখনকার দিনে বিজ্ঞানের যতটুকু উন্নতি হয়েছিল তার সঙ্গে থ্যালিসের ঘনিষ্ঠ পরিচয়। অবশ্যই, থ্যালিসের আগে বিজ্ঞানের সত্যিই জন্ম হয়েছিল কি-না, তা তর্কের বিষয়; কেননা তাঁর আগে পর্যন্ত জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি ধর্ম ও পৌরাণিক বিশ্বাসের দখল থেকে মুক্তি পায়নি।
তবু জ্যামিতিতে অগ্রণী ছিল মিশর, জ্যোতির্বিদ্যায় ব্যাবিলোনিয়া, নৌবিদ্যায় গ্রীকদের চেয়েও বেশি নাম-ডাক ছিল ফিনিসীয় বণিকদের। খুব সম্ভব, ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষেই থ্যালিস মিশর দেশে গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে তিনি শিখেছিলেন জ্যামিতি।
কিন্তু মিশরবাসীরা এ-বিজ্ঞানের প্রয়োগ জানত শুধুই জমিজায়গা মাপ-জোখ করবার ব্যাপারে, বস্তুত এই কাজের দাবিই ওদের মধ্যে জ্যামিতি-বিজ্ঞানের জন্ম দিয়েছিল। থ্যালিস কিন্তু জ্যামিতির হিসেবা-নিকেশের উপর নির্ভর করে একটি উপায় বের করলেন, যে উপায়ের সাহায্যে সমুদ্রের বুকে জাহাজ কতখানি দূরে রয়েছে তা নির্ণয় করা সম্ভব।
তাছাড়া, জ্যামিতিতে একটি কথা জানা হলো এক-জিনিস, কথাটাকে প্রমাণ করতে পারা আর এক-জিনিস। প্রমাণ করবার শর্তগুলি মিশরবাসীদের কাছে স্পষ্টভাবে ধরা পড়েনি, ধরা পড়ল থ্যালিসের কাছে।
যেমন ধরা যাক, মিশরবাসীরাও জানত একটা বৃত্তের (circle) ব্যাস (diameter) বৃত্তটিকে সমান দু’ভাগে বিভক্ত করে; কিন্তু এ কথাকে নিভুলভাবে প্রমাণ করতে তারা জানত না।
প্রমাণ করবার পথ দেখালেন থ্যালিস। তাঁর এইরকম একটা কোনো কীর্তির কথা মনে রেখে আধুনিক যুগের দিকপাল দার্শনিক ইমানুয়েল কাণ্ট থ্যালিসকেই ইতিহাসের প্রথম প্রকৃত গণিত-বিজ্ঞানীর সম্মান দিতে চেয়েছেন। কিন্তু তিনি প্রথম গণিত-বিজ্ঞানী হোন আর নাই হোন, এ-কথায় কোন সন্দেহ নেই যে, থ্যালিস মিশর থেকে জ্যামিতি শুধু শিখেই আসেননি, জ্যামিতিকে আরো উন্নত করার ব্যাপারে তার অবদান ছিল অনেকখানি।
ব্যাবিলোনবাসীদের জ্যোতির্বিজ্ঞানের বেলাতেও একই কথা। ওরা গ্রহনক্ষত্রের একটা ছক তৈরি করেছিল; সেই ছকের উপর নির্ভর করে ৫৮৫ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে থ্যালিসই প্রথম হিসেব করে বলে দেন করে গ্রহণ হবে সেই দিনটির কথা। নৌবিদ্যায় আকাশের তারার উপর নির্ভর করে দিক নির্ণয়ের যে-কৌশল ব্যাবিলোনবাসীরা আয়ত্ত করেছিল, গ্রীক নৌবিদ্যায়। সেই কৌশল আমদানি করলেন থ্যালিস।
শুধু বিজ্ঞানের কথাই নয়। বিষয়বুদ্ধির দিক থেকেও তিনি রীতিমত ধুন্ধর ছিলেন। একবার কারা নাকি তাকে অকৰ্মণ্য বলে ঠাট্টা করেছিল, এতে তিনি বিলক্ষণ বিরক্ত হন এবং ঠিক করেন ব্যবসা-বুদ্ধি দেখিয়ে বণিকদেরও তাক লাগিয়ে দিতে হবে। এবং সে বছর জলপাই-তেলের ব্যবসা করে তিনি বিস্তর সম্পত্তি করে ফেললেন, দেখিয়ে দিলেন লক্ষ্মী-সরস্বতী উভয়কেই কেমন করে একসঙ্গে বশ করা যায়।
অবশ্য, প্রাচীন ইতিহাসে থ্যালিসের এত যে খ্যাতি, তা তাঁর বিষয়বুদ্ধির গুণেও নয়, জ্যামিতি-বিজ্ঞানে বুৎপত্তির দরুনও নয়। খ্যাতিটা হলো দার্শনিক প্রতিভার। তা-ও, দর্শন সম্বন্ধে তিনি এমন কিছু পুঁথিপত্র লিখে যাননি, অন্তত তাঁর লেখা কোনো পুঁথির কোনো খবর আমরা পাইনি।
তখনকার মানুষের চোখের সামনে তাদের ছোট্ট পৃথিবীটুকু- নদীর কিনারার ওই জায়গাগুলো মাঝে মাঝে জলের প্লাবনে মুছে যায়, তারপর আবার উর্বর পলিপড়া জমি জেগে ওঠে জলের নীচ থেকে। তাই তাদের কল্পনা ঘুরে ফিরে বার বার জলকেই সৃষ্টি-প্রলয়ের জন্যে দায়ী করতে চেয়েছে।
তার দার্শনিক প্রতিভার মাত্র একটি ভাঙা-চোরা টুকরো-মাত্র একটি কথা- সুদূর অতীত পেরিয়ে আমাদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছেছে। তাছাড়া, আপাতদৃষ্টিতে, কথাটার মধ্যে দার্শনিক প্রতিভার এমন কিছু যুগান্তকারী স্বাক্ষর খুঁজে পাওয়া যায় না।
কথাটা হলো : জল-ই পরম সত্তা, জল থেকেই সব কিছুর উৎপত্তি, জলের মধ্যে সব কিছু বিলীন হয়ে যায়। ভাবতে অবাক লাগে, শুধুমাত্র এইটুকু কথার জোরে খ্যালিস কেমনভাবে ইওরোপীয় দর্শনের আদিপুরুষ হিসেবে স্বীকৃত হন, বিশেষ কয়ে স্বীকৃতিটা যখন সৰ্ববাদিসম্মত।
গ্রীক যুগে এ্যারিস্টটুল-এর যে গ্রন্থে গ্রীক-দর্শনের একটা ধারাবাহিক পরিচয় দেবার প্রথম চেষ্টা, সেই গ্রন্থ থেকে শুরু করে অতি-আধুনিক যুগে বার্টরাও রাসেল পাশ্চাত্ত্য দর্শনের যে ইতিহাস রচনা করেছেন, সেই ইতিহাস পর্যন্ত সর্বত্রই থ্যালিসের এই গৌরব।
অথচ, এমনিতে দেখলে কথাটার মধ্যে না আছে অভিনবত্ব, না যাথার্থ। অভিনবত্ব কোথায়? থ্যালিসের আগেও কবি হোমার এবং হেসইড, কল্পনা করেছিলেন জল থেকে পৃথিবী সৃষ্টি হবার কথা, এমন-কী মিশর ও ব্যাবিলোনএর প্রাচীন পুরাণেও এ-জাতীয় কল্পনার স্বাক্ষর। ব্যাবিলোনের পুরাণে বলা হয়েছে, এককালে সব কিছু ছিল জল, শুধু জল; স্রষ্টা–যাঁর নাম কিনা মার্দুক–সেই আদি প্লাবন থেকে সৃষ্টি করলেন পৃথিবী।
তাহলে? থ্যালিসের আত যে গৌরব তা ঠিক কিসের দরুন? উত্তরে বলা হয়, জল থেকে পৃথিবী সৃষ্টি হবার উপাখ্যানটা যদিও অতীতের পৌরাণিক কল্পনায় একাধিকবার উকি দিয়েছে, তবুও তা নেহাতই পৌরাণিক কল্পনা হিসেবে, ধর্মের অঙ্গ হিসেবে। আর তাই, সেগুলি দর্শনের মর্যাদা পাবার যোগ্য নয়।
দর্শনের মর্যাদা প্রথম জুটল। থ্যালিসের, কেননা থ্যালিসই প্রথম পৌরাণিক চিন্তার কাঠামোটা পুরোপুরি বাদ দিয়ে, প্রকৃত বৈজ্ঞানিকের মেজাজ নিয়ে বিশ্বের রহস্য উদঘাটন করবার চেষ্টা করেছিলেন।
আসলে, জল থেকে সব কিছু সৃষ্টি হবার কথাটা, জলকে পরম সত্তা মনে করাটা বড় কথা নয়; এমন-কী ঠিক কথাও নয়। আধুনিক বিজ্ঞানের কৃপায় আমরা তো স্পষ্টভাবেই জেনেছি জলকে পরম সত্তা বলাটা ভুল, জলের মূলে রয়েছে দু’ রকমের গ্যাস, সেগুলির মূলে রয়েছে আরো মৌলিক সত্য।
তবু অতীতের কল্পনায় সৃষ্টিরহস্যের সঙ্গে জলের যোগাযোগ; কেননা মানুষের যে-সব প্রাচীনতম সভ্যতা, সেগুলি গড়ে উঠেছিল। সেকালের বড় বড় নদীর কিনারায়; মিশরের নীল নদ, ভারতের গঙ্গা আর সিন্ধু, ইরাকের ইউফ্রেটিস আর টাইগ্রিস, চীনের ইয়াং-সি-কিয়াং আর হোয়াং হো।
তখনকার মানুষের চোখের সামনে তাদের ছোট্ট পৃথিবীটুকু- নদীর কিনারার ওই জায়গাগুলো মাঝে মাঝে জলের প্লাবনে মুছে যায়, তারপর আবার উর্বর পলিপড়া জমি জেগে ওঠে জলের নীচ থেকে। তাই তাদের কল্পনা ঘুরে ফিরে বার বার জলকেই সৃষ্টি-প্রলয়ের জন্যে দায়ী করতে চেয়েছে।
আচার্য শঙ্করের ব্যক্তিগত প্রতিভাও তো খুবই অসামান্য। তবু, অতখানি প্রতিভার গতি কী হলো? ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের পায়ে আত্মনিবেদন : ধর্মমোহের পুরো কাঠামোকে নির্বিবাদে মেনে নিয়ে শ্রুতিস্মৃতির কথাগুলিকেই সবচেয়ে দুর্ধর্ষ যুক্তির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা! থ্যালিসের বেলায় মোটেই তা নয়। কেন নয়? এ-প্রশ্নের জবাব শুধু তার ব্যক্তিগত প্রতিভায় খুঁজে পাওয়া যায় না।
কিন্তু বিশেষ করে মনে রাখা দরকার প্রাচীনদের কল্পনায় শুধু জল নয়, জলের সঙ্গেই সৃষ্টিপ্রলয়ের এক অধিদেবতাও। জল থেকে সৃষ্টি, সৃষ্টি করেছেন এক আদি বিধাতা-পুরুষ। ব্যাবিলোনবাসীরা তার নাম দিয়েছিল মার্দুক; অন্য দেশে অন্য কোনো নাম।
থ্যালিসের যেটা আসল গৌরব, সেটা হলো এই “মাদুককে সরাসরি বাদ দেবার” গৌরব। (ফ্যারিংটন)। বিধাতা-পুরুষের কথা বাদ দিয়ে তিনি শুধু পার্থিব জিনিসের সাহায্যে পরম সত্তাকে চেনাবার চেষ্টা করেছিলেন।
থ্যালিস ইওরোপের আদি-দার্শনিক, কেননা তিনিই প্রথম পৌরাণিক কল্পনাকে পিছনে ফেলে বিজ্ঞানের আলোয় বিশ্বব্রহস্যের কিনারা করতে চেয়েছিলেন। তাঁর কথাটুকু আর যাই হোক, ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গ নয়, নয় পৌরাণিক কল্পনার ক্রীতদাস।
মিশরের সভ্যতা, ব্যাবিলোনের সভ্যতা-গ্রীক সভ্যতার চেয়ে অনেক পুরানো। মিশরে আর ব্যাবিলোনে জ্যোতিষাদির জন্ম হয়েছিল, পণ্ডিতেরা চেষ্টা করেছিলেন বিশ্বের মূল রহস্যকে চেনবার বা বোঝবার; কিন্তু তবু মিশর বা ব্যাবিলোনে জন্ম হয়নি দর্শনের, জন্ম হলো গ্রীসে। গ্রীসেই প্রথম।
কেননা, মিশর বা ব্যাবিলোনে বিশ্বরহস্যকে চেনবার চেষ্টাটা প্রকৃত বিজ্ঞানের আলোয় চেনবার চেষ্টা নয়, তার বদলে পৌরাণিক কুসংস্কারের পায়ে পায়ে ঘোরা, ধর্মবিশ্বাসের মোহ দিয়ে তত্ত্ব-জিজ্ঞাসাকে মেটাবার চেষ্টা। গ্রীসেই প্রথম তার হাত থেকে মুক্তি, স্বাধীন বুদ্ধি আর বিজ্ঞানের আলোয় পরম সত্যকে আবিষ্কার করার আয়োজন।
কিন্তু কেমন করে সম্ভব হলো এটা? এ কি শুধুই থ্যালিসের বাক্তিগত প্রতিভার ফল? কিংবা জাতি হিসাবে গ্রীক জাতি সত্যিই কি এমন কোনো আলোকসামান্য বৈশিষ্টের অধিকারী ছিল, যার কৃপায় এমনতর সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড সম্ভব হলো ওদের মধ্যে?
আসলে, ব্যক্তিগত প্রতিভা বা জাতিগত বৈশিষ্ট্য দিয়ে ঐতিহাসিক সমস্যার কিনারা করা যায় না। কেননা, তাতে শেষ পর্যন্ত কোনো-না-কোনোভাবে রহস্যকেই মেনে নিতে হয়। গ্রীকদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য নিশ্চয়ই ছিল, থালিসের নিশ্চয়ই ছিল অসামান্য প্রতিভা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, গ্রীকদের এমনতর বৈশিষ্ট্য সম্ভব হলো কী করে?
কী করে সম্ভব হলো থ্যালিসের এই প্রতিভা ঠিক এই পথে প্রবাহিত হওয়া? থ্যালিসের ব্যক্তিগত প্রতিভা তো প্রাচীন ধর্মমোহকে আরো মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করতেও পারত। আমাদের দেশের জনৈক চিন্তাশীলের সঙ্গে তুলনা করলে এই সম্ভাবনার কথাটা আরো স্পষ্টভাবে বুঝতে পারা যাবে।
আচার্য শঙ্করের ব্যক্তিগত প্রতিভাও তো খুবই অসামান্য। তবু, অতখানি প্রতিভার গতি কী হলো? ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের পায়ে আত্মনিবেদন : ধর্মমোহের পুরো কাঠামোকে নির্বিবাদে মেনে নিয়ে শ্রুতিস্মৃতির কথাগুলিকেই সবচেয়ে দুর্ধর্ষ যুক্তির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা! থ্যালিসের বেলায় মোটেই তা নয়। কেন নয়? এ-প্রশ্নের জবাব শুধু তার ব্যক্তিগত প্রতিভায় খুঁজে পাওয়া যায় না।
অবশ্যই, বিধাতার লীলাখেলা দিয়ে, তার খেয়ালখুশি বা আত্মবিকাশের একটা উপকথা সৃষ্টি করে পৃথিবীর সব সমস্যার একেবারে নিরাপদ আর নির্বিবাদ সমাধান নিশ্চয়ই করে দেওয়া যায়। ইতিহাস-বিচারে যেমনটা করে। থাকেন দার্শনিক হেগেলের ভক্তরা।
কৃত্রিম জলসেচ ব্যবস্থার দরুনই এই সভ্যতাগুলিতে ক্রমশ কেন্দ্রীয় সরকার গড়ে উঠতে লাগল। বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন পরিকল্পনা অনুসারে একই নদীতে নানান রকম বাঁধ বেঁধে নানান ধরনের জলসেচ ব্যবস্থা করতে গেলে তো চলে না, তাই দরকার পড়ল কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার, আর এই কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার দায় গ্রহণ করার জন্যে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই সমাধান আমাদের বৈজ্ঞানিক বিবেককে কিছুতেই তুষ্ট করতে পারে না। পাকা ফলটা মাটির দিকে কেন পড়ল-এই প্রশ্নের উত্তরে নিশ্চয়ই বলা চলত; করুণাময়ের ইচ্ছে, তাই। কিন্তু উত্তরটা নিউটনের বৈজ্ঞানিক বিবেককে তুষ্ট করতে পারেনি। কেননা, বিজ্ঞান হলো বাস্তবপরায়ণ।
বাস্তব দিয়ে ব্যাখ্যা না হলে আমাদের বৈজ্ঞানিক বিবেক কখনোই খুশি হতে পারে না। ইতিহাসের বেলাতেও একই কথা। কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাখ্যা খুঁজতে হলে যতক্ষণ না বাস্তব বিষয় দিয়ে এই ব্যাখ্যা দেওয়া যায়, ততক্ষণ আমাদের বৈজ্ঞানিক চেতনা তুষ্ট হতে পারে না।
এই দাবির দরুনই সম্ভব হয়েছে ইতিহাসের বাস্তবপরায়ণ ব্যাখ্যা : ঐতিহাসিক ঘটনাবলিকে বাস্তব পৃথিবীর বিষয় দিয়ে বোঝবার আয়োজন। কেমন করে সম্ভব হলো থ্যালিসের দর্শন?
কেমন করে সম্ভব হলো পৌরাণিক, কল্পনাকে পিছনে ফেলে বিজ্ঞানের আলোয় বিশ্ব রহস্যের সমাধান খোজা? মিশর বা ব্যাবিলোনের প্রাচীনতম সভ্যতায় যা সম্ভব হয়নি, কেমন করে তা সম্ভব হলো গ্রীক সভ্যতায়?
এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া যাবে সমাজের গড়নের দিক থেকে।
মিশর প্রভৃতি প্রাচীনতর সভ্যতাগুলি গড়ে উঠেছিল। সেকালের বড় বড় নদীর কিনারায় কিনারায়। পলিপড়া উর্বর জমিতে খাদ্যের জোগান অনেক বেশি, তাই আদিম যাযাবর মানুষের দল এই সব জায়গাগুলিতেই ক্রমশ খিতিয়ে বসতে থাকে, গড়ে তোলে মানুষের প্রথম সভ্যতা।
কিন্তু খাদ্যের জোগান বেশি হলেও জল সরবরাহের ব্যাপারে দারুণ সমস্যা : প্রকৃতিতে জলের যে সরবরাহ, শুধু তার উপর নির্ভর করা চলে না। বর্ষার সময় বৃষ্টির জল আর বন্যার জলে নদীর কিনারাগুলি একেবারে জলাভূমিতে পরিণত হয়ে যাবার ভয়, আবার বৃষ্টি বন্ধ হলে বা বন্যার জল সরে গেলে দারুণ জলকষ্টের ভয়।
অথচ, জলই এই সভ্যতাগুলির প্রাণবস্তু, কেননা সভ্যতাগুলি প্রধানত চাষবাসের উপর নির্ভরশীল। তাই, মস্ত বড় সমস্যা হলো কৃত্রিম উপায়ে জলসেচের ব্যবস্থা করা, প্রকৃতিতে জলের যে খেয়ালী সরবরাহ তার উপর মানুষের দখল স্থাপন করবার সমস্যা। নদীতে বাধ বেঁধে বন্যার জল আটক রাখা, আবার খালি কেটে দরকার মতো এদিক-ওদিক জল সরবরাহ করা।
কৃত্রিম জলসেচ ব্যবস্থার দরুনই এই সভ্যতাগুলিতে ক্রমশ কেন্দ্রীয় সরকার গড়ে উঠতে লাগল। বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন পরিকল্পনা অনুসারে একই নদীতে নানান রকম বাঁধ বেঁধে নানান ধরনের জলসেচ ব্যবস্থা করতে গেলে তো চলে না, তাই দরকার পড়ল কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার, আর এই কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার দায় গ্রহণ করার জন্যে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ।
“খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর এক মার্জিত গ্রীক চিন্তাশীল মিশরের শাসক-স্বীকৃত ধর্মের দিকে চেয়ে দেখছেন আর আবিষ্কার করছেন। এর সামাজিক প্রয়োজনীয়তা। তিনি বলছেন, মিশরের আইনকর্তা এত সব নোংরা কুসংস্কার সৃষ্টি করেছিল, তার কারণ প্রথমত, তার ধারণায় উপরওয়ালার যে-কোন আদেশ জনগণ যাতে স্বীকার করে নেয়।
তার মানেই হলো কেন্দ্রীয় শাসক-তারই কবলে বিরাট বিরাট এলাকা। পুরো এলাকার সমস্ত মানুষের উপর যথেচ্ছাচার চালাবার ঢালাও সুযোগ। কোনো এলাকার মানুষ যদি কেন্দ্রীয় শাসকের মজিটা মানতে রাজি না হয়, তাহলে সেই এলাকার জল সরবরাহ বন্ধ করে তাদের অনায়াসেই জব্দ করে দেওয়া যাবে।
কেন্দ্রীয় শাসকদের শক্তি তাই প্রায় অসীম। এই শক্তির কথাটা মনে না রাখলে বুঝতে পারা যায় না, সেই সুদূর অতীতের মানুষ কেমন করে গড়ে তুলতে পারল রুক্ষ মরুভূমির বুকে পিরামিডের মতো অবিশ্বাস্য বিশাল পাথরের গাঁথনি, বা পাহাড়ের চুড়োয় পাথর দিয়ে গাথা বিরাট মন্দির।
তখনকার দিনে যান্ত্রিক কলাকৌশলের উন্নতি প্রায় নগণ্য, তাই এ-জাতীয় বিরাট কীতির মূল রহস্যটুকু খুঁজে পাওয়া সম্ভব শুধুমাত্র লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তজলকরা মেহনতের মধ্যে। কিন্তু অত লক্ষ মানুষকে অমন মূক পশুর মতো মেহনত করতে বাধ্য করা গেল কী করে?
তার কারণ, বিরাট বিরাট এলাকার উপর, অসংখ্য মানুষের জীবনের উপর কেন্দ্রীয় শাসকের অসীম-অগাধ প্রতিপত্তি : সমস্ত এলাকার জল সরবরাহটি যার মজির উপর নির্ভর করছে, সে নিশ্চয়ই পুরো এলাকার মানুষকে মুখ বুজে মেহনত করবার জন্যে ঝোঁটিয়ে আনতে পারে। পুরো এলাকার প্রধান নির্ভর চাষবাস, চাষবাসের প্রধান নির্ভর জল সরবরাহ।
এই হলো আদিম সভ্যতাগুলির আসল চেহারা। এ সভ্যতায় জ্যোতিষ বা জ্যামিতির জন্ম সম্ভব, কিন্তু বিজ্ঞানের আলোয় বিশ্বরহস্যকে বোঝবার অবসর নেই। জমির মাপজোখ করবার কাজে দরকার জ্যামিতি, শুবু আদায়ের কাজে দরকার পাটীগণিত, দিনক্ষণ আর সন-তারিখের খেয়াল রাখবার কাজে দরকার জ্যোতির্বিদ্যা; এইরকম আরো কিছু কিছু।
কিন্তু- আর এইটেই খুব বড় কথা–এ সভ্যতায় এই জাতীয় জ্ঞানের যে-রকম চাহিদা, সেইরকমই চাহিদা হলো ধর্মমোহের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখা। কেননা, এ-সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার জন্যে একান্ত দরকার ওই ধর্মমোহ, অন্ধ সংস্কার, পৌরাণিক বিশ্বাস।
এ-সমাজ এমন সমাজ নয়, যেখানে সুস্থ বুদ্ধি দিয়ে, বিজ্ঞানের অভিজ্ঞতা দিয়ে বিশ্বরহস্যের সমাধান-প্রচেষ্টাকে উৎসাহ, এমন-কী আমল, দেওয়া সম্ভব; তাতে কেন্দ্রীয় শাসকের অসীম দাপটট ক্ষুব্ধ হবার ভয়, ভয় জনজাগরণের।
“খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর এক মার্জিত গ্রীক চিন্তাশীল মিশরের শাসক-স্বীকৃত ধর্মের দিকে চেয়ে দেখছেন আর আবিষ্কার করছেন। এর সামাজিক প্রয়োজনীয়তা। তিনি বলছেন, মিশরের আইনকর্তা এত সব নোংরা কুসংস্কার সৃষ্টি করেছিল, তার কারণ প্রথমত, তার ধারণায় উপরওয়ালার যে-কোন আদেশ জনগণ যাতে স্বীকার করে নেয়।
বণিক শ্রেণীর কথাটা ভালো করে বুঝতে হবে। গ্রীক সভ্যতায়, অন্তত গ্রীক সভ্যতার প্রথম দিকে, বণিক শ্রেণী বলতে নেহাতই পরিশ্রমজীবী মুনাফাখোর কোনো শ্রেণীকে নিশ্চয়ই বোঝাত না। এই শ্রেণী সামাজিক মেহনন্তের ক্ষেত্রে অংশ গ্রহণ করেছে অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই। প্রকৃতিকে বেশি।
সেজন্যে তাদের অভ্যস্ত করা দরকার, আর দ্বিতীয়ত তার মনে হয়েছিল, যাদের মনে ধর্মভাব অন্যান্ত সব ব্যাপারে মনকে আইনের অনুগত করেছে তাদের উপর সহজে নির্ভর করা সম্ভব।”
তাই আদিম সামন্ত সভ্যতায় নিছক কৃষিকাজের তাগিদে যে-রকম কয়েকটি বিদ্যার দরকার, সেইরকমই দরকার হলো সংস্কারের, ধর্মমোহের। তাই বিশ্বের রহস্যটা পুরাণের আলোতেই বোঝবার সুযোগ, বিজ্ঞানের সঙ্গে তার মুখ দেখাদেখি নেই।
কিন্তু গ্রীকদের বেলায় অন্য রকম।
প্রথমত, গ্রীস-এর প্রাকৃতিক অবস্থাটা অন্য রকম। অনুর্বর দেশ। মিশর বা মেসোপটেমিয়ার বড় নদীর কিনারায় যে-রকম সহজে চাষবাস করা সম্ভব, গ্রীসের জমিতে বা গ্রীক উশনিবেশগুলির জমিতে মোটেই তা নয়। আর তাই গ্রীকদের মধ্যে শুরু থেকেই চাষ-বাসের চেয়ে পশুপালনের দিকেই ঝোক অনেক বেশি।
তারপর, সওদাগরির দিকে ঝোক। এশিয়াটিক সামন্ত সভ্যতায় সওদাগর যে ছিল না, তা নিশ্চয়ই নয়, কিন্তু সওদাগররা সভ্যতার সদর মহলে খুব বেশি প্রতিপত্তি পায়নি। তারা ছিল সামন্তদের আশ্রিত; নিজেদের যাতে আরো টাকাকড়ি জোটে, এই উদ্দেশ্যেই সামন্তরা সওদাগরদের কাজে লাগাত, একটু-আধটু প্রশ্রয়ও দিত।
কিন্তু গ্রীক দেশে সওদাগরিটাই প্রধান হয়ে দাড়াল, আর তাই এখানে সওদাগর শ্রেণী বলে একটা আলাদা সামাজিক শ্রেণী গড়ে উঠতে লাগল। সওদাগরদের এই প্রতিপত্তির মূলেও আসল কারণ কিন্তু দেশের প্রাকৃতিক অবস্থা : ওখানে পাহাড়ী জমিতে নানান রকম ধাতু, তাই দিয়ে নানান রকম জিনিস তৈরি করে রপ্তানি করবার সুযোগ।
তাছাড়া, শ্বেতপাথর, কাঠ, জলপাই তেল, বাসন গড়বার জন্যে একরকম ভালো মাটি ইত্যাদি অনেক কিছুর জোগান। গ্রীসের মাটি অনুর্বর বলে যে-রকম চাষবাসের উন্নতি কম, সেইরকমই এই সব জিনিসের প্রচুর জোগান বলেই এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে ওঠবার ঢালাও সুযোগ,–আর তারই দরুন বণিক শ্রেণীর সামাজিক প্রতিপত্তি।
বণিক শ্রেণীর কথাটা ভালো করে বুঝতে হবে। গ্রীক সভ্যতায়, অন্তত গ্রীক সভ্যতার প্রথম দিকে, বণিক শ্রেণী বলতে নেহাতই পরিশ্রমজীবী মুনাফাখোর কোনো শ্রেণীকে নিশ্চয়ই বোঝাত না। এই শ্রেণী সামাজিক মেহনন্তের ক্ষেত্রে অংশ গ্রহণ করেছে অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই। প্রকৃতিকে বেশি।
করে, ভালো করে জয় করবার উপরই তাদের সম্পদ নির্ভর করেছে, আর প্রকৃতিকে জয় করবার যে কৌশল তারই নাম যে-হেতু বিজ্ঞান, সেইহেতু বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে এই বণিক শ্রেণীর স্বাৰ্থ অত্যন্ত স্পষ্টভাবে জড়িত।
তাছাড়া, মনে রাখতে হবে, গ্রীক সভ্যতার গোড়ার দিকে (“গ্রীক আদিযুগের শেষের দিকে”) অভিজাত শ্রেণীর সঙ্গে সাধারণ জনগণের যে-সংগ্রাম, সেই সংগ্রামে সওদাগর শ্রেণী জনগণের তরফে অধিনায়কত্ব করেছে। তাই তখন পর্যন্ত, সওদাগর শ্রেণী বলতে সামাজিক অর্থে নানান দিক থেকে এক প্রগতিশীল শ্রেণীকেই বোঝায়।
অবশ্যই তখনকার দিনে বিজ্ঞানের যতটুকু উন্নতি, তার ভিত্তিতে বস্তুজগতের পরম সত্তাকে সঠিকভাবে শনাক্ত করবার সম্ভাবনা নেই, থ্যালিস তা পারেননি,–থ্যালিসের কাছে তা আশা করবার কথাও নয়। তবু, যেটা আসলে অনেক বড় কথা, এইভাবে শনাক্ত করবার চেষ্টা দেখা দিল থ্যালিসের মধ্যে, এবং এই চেষ্টাই তাঁর পরে কিছুদিন পর্যন্ত গ্রীক দর্শনকে সঞ্জীবিত করে রেখেছিল।
অবশ্যই, গ্রীক সভ্যতার ভিত্তিতে দাস প্রথা : পয়সা দিয়ে মানুষ কিনে তাদের অমানুষিক পরিশ্রম করানো আর তাদের মেহনত দিয়ে তৈরি জিনিস মালিকদের ভঁড়ারে গেলবার ব্যবস্থা। দাসসমাজ,-পরিশ্রমজীবী সমাজই। কিন্তু, মনে রাখতে হবে, দাস-সমাজেরও একটা ইতিহাস আছে।
গ্রীক সভ্যতার শুরু থেকেই দাস-সমাজের পরোপজীবী মূর্তি প্রকট হয়ে পড়েনি। দাস-প্রথার ইতিহাসকে মোটের উপর দুটো যুগে ভাগ করা যায়; প্রথম যুগটায় ক্রীতদাসদের শুধু গৃহস্থালির কাজে, অর্থাৎ চাকরিবাকির হিসাবে, নিয়োগ করা; অর্থাৎ সামাজিক মেহনন্তের যেটা প্রধান দায়িত্ব, সেটা তখন পর্যন্ত শুধু ক্রীতদাসদের কাধে চাপিয়ে দেবার ব্যবস্থা নয়। দ্বিতীয় যুগটায় দেখা দিয়েছে এই ব্যবস্থা, গ্রীকরা তখন নেহাতই পরশ্রমজীবী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গ্রীক দর্শনের ইতিহাস আলোচনায় দেখতে পাওয়া যায়, দাস-সমাজের প্রথম স্তরটা ছেড়ে যতই তারা দ্বিতীয় স্তরটার দিকে এগিয়েছে, ততই ওদের দর্শনে ফুটে উঠেছে শৌখিন চিন্তা-বিভোরতার লক্ষণ। কিন্তু থ্যালিস যে সময়টার দার্শনিক, যে সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে এবং যে সামাজিক শ্রেণীর সঙ্গে তার যোগাযোগ, তা দাস,সমাজের প্রথম দিককার কথা।
খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর আইয়োনিয়ায় তখন রাজনৈতিক শক্তি অনেকাংশেই এসেছে সওদাগর শ্রেণীর হাতে। এই সওদাগর শ্রেণী বিজ্ঞানের উন্নতি দিয়ে পৃথিবীকে আরো ভালো করে জয় করতে চায় এবং নিজেরাও অংশ গ্রহণ করে সামাজিক মেহনতে; দাসপ্রথা তখন এমন অবস্থায় পৌঁছয়নি যে, মেহনতজীবনকে ঘূণার চোখে দেখতে শেখার অভ্যাস।
এই আইয়োনিয়ার সবচেয়ে কর্মমুখর শহর হলো মিলেটাস। সেই মিলেটাস শহরে সওদাগর শ্রেণীর একজন হলেন ইওরোপের প্রথম দার্শনিক, থ্যালিস। আর তাই তার কাছে ধর্মমোহটা প্রয়োজনীয় নয়, ধর্মমোহের চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন বিজ্ঞানের।
আর তাই বিশ্বের রহস্য বোঝবার আশায় তিনি ধর্মমোহের দ্বারস্থ হতে রাজি নন, তার বদলে দ্বারস্থ হতে চাইলেন বিজ্ঞানের কাছে। ফলে বিশ্বের রহস্যবর্ণনায় শ্রষ্টা মাদুক-এর স্থান রইল না। থ্যালিস বললেন, এই বাস্তব দুনিয়ারই একটি পদার্থ–জল, শুধু জল, আধ্যাত্মিক কোন কিছু নয়–পরম সত্য।
কর্মজীবনের সঙ্গে, বিজ্ঞানের সঙ্গে থ্যালিসের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগই তাকে বস্তুবাদী করে তুলেছিল, কিংবা, যা একই কথা, তার মনকে অধ্যাত্মবাদ বা ভাববাদের মোহ থেকে সরিয়ে আনল। এর দরুনই তার আদি-দার্শনিকের গৌরব।
অবশ্যই তখনকার দিনে বিজ্ঞানের যতটুকু উন্নতি, তার ভিত্তিতে বস্তুজগতের পরম সত্তাকে সঠিকভাবে শনাক্ত করবার সম্ভাবনা নেই, থ্যালিস তা পারেননি,–থ্যালিসের কাছে তা আশা করবার কথাও নয়। তবু, যেটা আসলে অনেক বড় কথা, এইভাবে শনাক্ত করবার চেষ্টা দেখা দিল থ্যালিসের মধ্যে, এবং এই চেষ্টাই তাঁর পরে কিছুদিন পর্যন্ত গ্রীক দর্শনকে সঞ্জীবিত করে রেখেছিল।
সকলেই মিলেটাস শহরের বাসিন্দা বলে এদের দর্শনকে অনেক সময় মিলেসীয় দর্শন বলা হয়। আবার আইয়োনিয়ার নাম থেকে এঁদের দর্শনের নামকরণ হয়েছে আইয়োনীয় দর্শন। এই আইয়োনীয় দর্শনই ইওরোপীয় দর্শনের আদি পর্যায়। মনে রাখতে হবে, এ দর্শন বস্তুবাদী, বিজ্ঞান আর সামাজিক মেহনতের সঙ্গে সম্পর্কের জোরেই তা সম্ভব হয়েছিল।
থ্যালিসের পর এ্যানেক্সিমেণ্ডার, তার পর এ্যানেক্সিমেনিস। ঐতিহাসিকেরা বলেন, এ্যানেক্সিমেণ্ডার খুব সম্ভব। থ্যালিসের সমসাময়িক ছিলেন, কিংবা তার শিষ্য ছিলেন। এ্যানেক্সিমেণ্ডারের সঙ্গে এ্যানেক্সিমেনিসের সম্পর্কটাও এই রকমেরই। এরা দুজনেও ওই একই শহরের বাসিন্দা, একই সামাজিক পরিবেশের মানুষ।
এবং দার্শনিক হিসাবে এদের দুজনের চেষ্টাও একই। রকম : বস্তুজগতের মধ্যেই পরম সত্তার প্রকৃত রূপকে শনাক্ত করবার চেষ্টা। এ্যানেক্সিমেণ্ডার ‘জল’ নামের স্থূল বস্তুকেই পরম বস্তু বলে মেনে নিতে রাজি নন। বস্তুজগতের মধ্যে তিনি এমন এক সুক্ষ্ম বস্তুকে পরম সত্তা মনে করতে চান, যার থেকে ক্ষিতি অপ, তেজ আদি সব রকম স্থূলভূত বা স্থূল বস্তুর উৎপত্তি।
এই জাতীয় সূক্ষ্মভুত বা সূক্ষ্ম বস্তুর তিনি নাম দিলেন ‘অনন্ত, অসীম, অবৰ্ণনীয় বস্তু, যার থেকেই কালে সব কিছুর জন্ম এবং যার মধ্যেই কালে সব কিছু বিলীন হয়ে যায়। অর্থাৎ, তাঁর মতে, এক আদিম অবর্ণনীয় সূক্ষ্মভুতই পরম সত্তা। কেবল মনে রাখতে হবে, এই পরম সত্তাটি আধ্যাত্মিক কিছু নয়, নেহাতই বাস্তব জিনিস, জড় জগতের পদার্থ।
কিন্তু এই জাতীয় বস্তুকে পরম সত্তা বলতে গেলে কথাটা যেন বড় বেশি। ধোঁয়াটে হয়ে যায়। বস্তুবাদীর পক্ষে মূর্ত বস্তুর দিকে আকৃষ্ট হবার তাগিদ। রয়েছে। অথচ মূর্ত বস্তু হিসাবে ‘জল’-এর মতো একটা কিছুকে সব কিছুর মূল সত্তা বলে মেনে নেওয়াও যেন স্থূল কথা।
এ্যানেক্সিমেনিস। তাই যেন দুয়ের মধ্যে মিল ঘটাবার চেষ্টা করে বললেন : “বায়ু হলো পরম পদার্থ। হাওয়া জিনিসটা মূর্ত, তবু সূক্ষ্ম। তা-ই। আর হাওয়া যে বস্তুজগতেরই জিনিস, অধ্যাত্মজগতের কিছু নয়, এ কথা তো স্পষ্ট কথা।
মোটের উপর বস্তুজগতের ঠিক কোন জিনিসটিকে পরম সত্তা হিসাবে এরা শনাক্ত করবার চেষ্টা করেছিলেন, সেইটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো এদের বস্তুবাদ, বিজ্ঞানের আলোয় বিশ্বব্রহস্যের সমাধান করবার চেষ্টা, পৌরাণিক চিন্তাধারা আর ধর্মমোহকে পিছনে ফেলে এগিয়ে আসবার আয়োজন।
সকলেই মিলেটাস শহরের বাসিন্দা বলে এদের দর্শনকে অনেক সময় মিলেসীয় দর্শন বলা হয়। আবার আইয়োনিয়ার নাম থেকে এঁদের দর্শনের নামকরণ হয়েছে আইয়োনীয় দর্শন। এই আইয়োনীয় দর্শনই ইওরোপীয় দর্শনের আদি পর্যায়। মনে রাখতে হবে, এ দর্শন বস্তুবাদী, বিজ্ঞান আর সামাজিক মেহনতের সঙ্গে সম্পর্কের জোরেই তা সম্ভব হয়েছিল।
…………………….
ভাববাদ খণ্ডন – মার্কসীয় দর্শনের পটভূমি : দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………….
আরও পড়ুন-
দর্শনের ইতিহাস বিচার
আইয়োনীয় দর্শন
টোটেম বিশ্বাস
নির্ধারণবাদ
বিতণ্ডাবাদী
অতীন্দ্রিয় রহস্যবাদ
জনগণের দর্শন ও বস্তুবাদী দর্শন
লোকায়ত ও সাংখ্য
লোকায়ত, বৈষ্ণব, সহজিয়া
প্রকৃতিবাদী দার্শনিকবৃন্দ