-দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
ভাববাদ খণ্ডন করলেন কাণ্ট। কিন্তু তারপর? তাঁর নিজের মতবাদ? তা নিয়ে অবশ্য টীকাকারদের মধ্যে অজস্ৰ মতভেদ আছে ; এবং মতভেদ এতই বেশি যে, তাঁদের মধ্যেই একজন, একজন শ্রদ্ধেয় টীকাকার, শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলেন যে, কাণ্ট তাঁর সমসাময়িক দর্শনের যে দুর্গতির বর্ণনা দিয়েছেন, কাণ্ট-দর্শনের উপর টীকার দুৰ্গতি তার চেয়ে কম নয়। সমসাময়িক দর্শনের দুৰ্গতি বর্ণনা করতে গিয়ে কাণ্ট বলেছিলেন-এ যেন এমন এক মল্লক্ষেত্র, যেখানে কিনা ভুয়ো মারপিটে হাত পাকাবার দেদার সুযোগ।
কাণ্ট-এর টীকা নিয়ে যে এত শোরগোল, তার আসল কারণ অবশ্য কাণ্ট নিজেই এক অদ্ভুত দোটানায় পড়েছিলেন। একদিকে ভাববাদ খণ্ডন করা সত্ত্বেও ভাববাদের কাছেই করুণ আত্মনিবেদন, অপরদিকে বৈজ্ঞানিক বিবেকের দংশনে অন্তত খিড়কি দোর দিয়ে বস্তুবাদের মূল কথাকে সসংকোচে আমন্ত্রণ।
এক বিশেষ যুগের, এক বিশেষ সমাজের জীব হিসাবে কাণ্ট যে কেন এমন দোটানায় পড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, সে প্রশ্নের জবাব মার্কসীয় আলোচনায় পাওয়া যায় ; কিন্তু এ-কথায় কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না যে, তার দর্শনের সচেতন দিকটুকু স্পষ্টই ভাববাদী : তার মতে এই মূর্ত ও দৃশ্য জগৎ বুদ্ধি-নির্মাণ।
কাণ্ট-এর দর্শনের ঐতিহাসিক পরিণতির দিকে চেয়ে দেখলেও বোঝা যায়, ভাববাদের প্রতি তার দর্শনের ঝোঁক কী দুর্নিবার, কত নিঃসন্দেহ! উত্তর কাণ্টীয় দার্শনিকেরা কাণ্ট-এর দর্শনকে প্রতিজ্ঞ হিসেবে ব্যবহার করে একটানা এগিয়ে চললেন সোজা ভাববাদের পথে।
জ্যাকবি, ফিক্টে, হার্বার্ট, সেলিঙ এবং শেষ পর্যন্ত হেগেল। হেগেলের সর্বগ্রাসী পরব্রহ্ম–সে যেন এক চিন্ময়, ভয়ঙ্কর আদিম দেবতা, তার ক্ষুধা কিছুতে মিটতে চায় না, সমগ্র মানব-ইতিহাসকে গ্রাস করবার পরও না।
শুধু ঐতিহাসিক পরিণতির কথাই বা কেন, কাণ্ট থেকে হেগেলীয় ভাববাদে পৌঁছবার পথ যে সোজা, তার নৈয়ায়িক তাৎপর্যটুকুও স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ। সাম্প্রতিক পরব্রহ্মবাদীরা তাই কাণ্ট থেকেই শুরু করেন এবং শেষ করেন হেগেলে। গ্রীন, কেয়ার্ড, এমন-কী এ যুগের অতবড় ভাববাদী ব্রাডলি পর্যন্ত এ কথার ব্যতিক্ৰম নন।
অথচ, দর্শনের ক্ষেত্রে এই অভিনব নামধারী আগন্তুকটি, এই তথাকথিত তৃতীয় অপক্ষপাতী সত্তা, আসলে ভাববাদীর পুরাতন মানস-অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ম্যাক-প্রমুখের এই সাড়ম্বর অতি-আধুনিক দর্শন আসলে বার্কলির মতবাদের ওপর নতুন রঙ চাপিয়ে তাকে অভিনব দর্শন বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টাই।
শেষ পর্যন্ত য়ুরোপীয় দর্শনের ইতিহাসে যেন এক অসম্ভব অবস্থার সৃষ্টি হলো। হেগেলের সর্বগ্রাসী ভাববাদ দার্শনিক মহলে যেন সহজবুদ্ধি হয়ে দাঁড়াল। তাকে প্রমাণ করবার দরকার বুঝি নেই, তাকে খণ্ডন করবার অস্ত্র বুঝি পাওয়া অসম্ভব।
অথচ উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে শুরু করে দার্শনিকেরা অনুভব করতে লাগলেন যে, ভাববাদের আবহাওয়ায় আধুনিক বৈজ্ঞানিক চেতনার শ্বাসরোধ হবার উপক্রম হয়েছে। তাই আবার শোরগোল পড়ে গেলা-ভাববাদকে খণ্ডন করতে হবে, যেমন করেই হোক।
দেখা গেল, একের পর এক দার্শনিকের দল মেতে উঠছে ভাববাদকে খণ্ডন করবার উৎসাহে, খোলা হচ্ছে একের পর এক আক্রমণকেন্দ্র। অভিজ্ঞতা-বিচারবাদ (Empirio Criticism), প্রয়োগবাদ (Pragmatism), নব্য-বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদ (Neo-Realism)–এইসব খাঁটি আধুনিক মতবাদ।
প্রত্যেকটিরই একান্ত উৎসাহ ভাববাদ খণ্ডন। অথচ তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, এইসব অতি-আধুনিক দার্শনিকেরা ভাববাদের বিরুদ্ধে নানা রকম কটূক্তি করবার পরও শেষ পর্যন্ত যেন গোপনভাবে ভাববাদের কথাই আত্মসাৎ করতে চাইছেন।
অভিজ্ঞতা-বিচারবাদের প্রধান নায়ক হলেন ম্যাক। বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে, নানান রকম দুরূহ পরিভাষার জাদু দেখিয়ে, সাড়ম্বরে তিনি দর্শন শুরু করলেন। এতদিন ধরে চিৎ ও অচিতের মধ্যে যে দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর গড়ে উঠেছে, তাকে ভূমিসাৎ করতে পারলেই নাকি দর্শনের আসল মুক্তি।
প্রথম কাজ তাই মনোবিজ্ঞান আর পদার্থবিজ্ঞানের মিলন ঘটিয়ে এক বর্ণসঙ্করের জন্ম দেওয়া, সেই বর্ণসঙ্করেরই নাম হবে দর্শন–এবং এই দর্শন অনুসারে জড়পদার্থও পরমসত্তা নয়, মানস-পদার্থও পরমসত্তা নয়, এক তৃতীয় অপক্ষপাতী সত্তা পরমসত্তা। ম্যাক তার নাম দিয়েছেন element, অর্থাৎ মৌলিক সত্তা।
অথচ, দর্শনের ক্ষেত্রে এই অভিনব নামধারী আগন্তুকটি, এই তথাকথিত তৃতীয় অপক্ষপাতী সত্তা, আসলে ভাববাদীর পুরাতন মানস-অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ম্যাক-প্রমুখের এই সাড়ম্বর অতি-আধুনিক দর্শন আসলে বার্কলির মতবাদের ওপর নতুন রঙ চাপিয়ে তাকে অভিনব দর্শন বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টাই।
লেনিন তাঁর প্রধান দার্শনিক গ্রন্থে ‘বস্তুবাদ ও অভিজ্ঞতা-বিচারবাদ’-এ এই বিষয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা করেছেন। এবং এই সিদ্ধান্ত এমন নিঃসংশয়ে প্রমাণ করেছেন যে, তারপর আর তাই নিয়ে সংশয়ের অবকাশ থাকে না।
যাথার্থ বা সত্যের একান্ত নির্ভর রুচিমাফিক অনুভূতি বা অভিজ্ঞতাই। মানুষের মধ্যে যেটা সবচেয়ে খামখেয়ালী, সবচেয়ে ব্যক্তিগত দিক-তারা ভালো-লাগা-না-লাগা–প্রয়োগবাদীর মতে তার উপরই পরমসত্তার চরম নির্ভর। সহজ কথা সন্দেহ নেই, কিন্তু এমন কিছু নতুন কথা নয়।
তারপর ধরা যাক প্রয়োগবাদীদের কথা। তাঁদের দর্শনের মূল উৎসাহ যে হেগেলীয় ভাববাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি খোঁজা, এ কথা তাঁরাই জোর গলায় জাহির করছেন। ভাববাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক দর্শন গড়ে তুলতে হলে প্রথম দরকার দর্শনের মূল ভিত্তিটারই বদল করা।
দর্শনকে আর শুদ্ধবুদ্ধির গজদন্তমিনারে কুমারী ব্ৰতচারিণী করে রাখলে চলবে না, তাকে নামিয়ে আনতে হবে ধুলোর পৃথিবীতে, যেখানে কাজের মানুষের কাঁধ ঘোষাঘোষি, যেখানে প্রয়োগের নগদ মূল্য চুকিয়ে তবেই কিছু কেনা-বেচা।
তাই কোন বিশেষ দার্শনিক মতবাদ বা ধারণা, নিছক নিজের জোরে যথার্থও নয়, অযথার্থও নয়,–যাথার্থ্য-দাবির একটি আবেদনমাত্র। ব্যবহারিক জীবনে তার প্রয়োগবৃত্তির ওপর যাথার্থ্য নির্ভর করে ; উক্ত ধারণা বা মতবাদ যদি জীবনে সুখানুভূতির সন্ধান দেয়, তবেই তাকে যথার্থ বলে মানা যাবে, যদি না দেয়, তাহলে বলতে হবে তা ভ্রান্ত।
হাজার বাকবিতণ্ডায় যে-তর্কের মীমাংসা নেই, প্রয়োগের জাদুস্পর্শে নিমেষে তার মীমাংসা হয়ে যায়। এই সহজ কথাটুকু এর আগে দার্শনিকেরা ধরতে পারেননি, তার কারণ এতদিনকার একটানা বুদ্ধিবাদের মোহে তাদের দৃষ্টি আচ্ছন্ন ছিল।
সহজ কথা সন্দেহ নেই। কিন্তু নতুন কথা কোথায় হলো? প্রয়োগের প্রসঙ্গটা অবশ্যই নতুন, তবু এ তো সুস্থ প্রয়োগের ওপর নির্ভর করা নয়, প্রয়োগের দোহাই-পাড়া মাত্র। কেননা, প্রয়োগবাদীদের মতে এই তথাকথিত প্রয়োগের আসল তাৎপর্য শেষ পর্যন্ত ঠিক কী? সুখানুভূতি-শেষ পর্যন্ত অনুভূতিই, মানস-অভিজ্ঞতাই!
যাথার্থ বা সত্যের একান্ত নির্ভর রুচিমাফিক অনুভূতি বা অভিজ্ঞতাই। মানুষের মধ্যে যেটা সবচেয়ে খামখেয়ালী, সবচেয়ে ব্যক্তিগত দিক-তারা ভালো-লাগা-না-লাগা–প্রয়োগবাদীর মতে তার উপরই পরমসত্তার চরম নির্ভর। সহজ কথা সন্দেহ নেই, কিন্তু এমন কিছু নতুন কথা নয়।
কর্নফোর্থ এর গ্রন্থ পড়ার পর বুঝতে পারা যায়, এ যেন এক অতি আধুনিক দিল্লির লাডু-শুধু যে না-খেলেই পস্তাতে হয় তাই নয়, খেতে গেলেও পস্তাতে হয়, কেননা খেতে গেলে শুধুই দাঁত ভাঙে, কিন্তু ভাববাদের চর্বিতচর্বণ ছাড়া নতুন কোনো আস্বাদ জোটে না।
গ্রীক যুগে সফিস্টদের মুখেও এই কথাই শুনতে পাওয়া গিয়েছিল, শোনা গিয়েছিল, সমস্ত সত্যের চরম কষ্টিপাথর হলো ব্যক্তিগত মানুষের ভালো-লাগা-না-লাগা ; কেবল তারা এমন আধুনিক ভাষায় প্রয়োগ শব্দের দোহাই দিতে জানতেন না। ভাববাদের পুরোনো কথাটুকুই, কেবল বাইরের দিকটাই নতুন। শুধু নবকলেবর।
ভাববাদীর ভাষা যেন গঁদের সঙ্গে করাতগুঁড়ো মিশিয়ে একটু ঘন করা হয়েছে, বললেন সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদী। অন্তত সাত সাতটা সরল অনুপপত্তির ওপর ভাববাদের ভিত, বললেন নব্য-বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীর দল। মনে হয়, মেজাজটা এবার রীতিমতো কড়া, আশা হয় এবার আর কোনো রকম আপসের কথাই উঠবে না।
ঠিক হলো, ভাববাদকে খণ্ডন করতে হবে রীতিমতো দল পাকিয়ে, সভা ডেকে। সভা ডাকলেন নব্য বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীরা ; সভা ডাকলেন বৈচারিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীর দল-বড় বড় নামজাদাদের সভা। ঠিক হলো, এমন-কী ন্যায়শাস্ত্রকেও সমূলে সংস্কার করতে হবে-পুরোনো ন্যায়শাস্ত্রের আবর্জনায় ভাববাদের আগাছা জন্মেছিলো, তাই সংস্কৃত বৈজ্ঞানিক নব্যন্যায় চাই। প্রবর্তিত হলো “গাণিতিক” নব্যন্যায়।
অনুষ্ঠানের এতটুকুও ত্রুটি নেই। আয়োজন দেখে মনে হয়, ভাববাদের পরমায়ু এবার সত্যিই শেষ হবে। ভাববাদ তবুও যেন মিশরের সেই পৌরাণিক পাখিই, নিজের ভস্মাবশেষের মধ্যেই তার নবজন্মের নিঃসন্দেহ সুচনা। সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীদের এত তোড়জোড়, এত শোরগোল, শেষ পর্যন্ত তারও পরিসমাপ্তি ভাববাদেই!
জানি, একথা প্রমাণ করা পরিসরসাপেক্ষ, বিশেষত এই কারণে যে, সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীরা জানেন, নিজেদেরওই গোপনভাববাদকে ঢাকবার জন্য জটিল তর্ক আর দুরূহ পরিভাষার ঠাসবুনোনি দিয়ে কী অপূর্ব আচ্ছাদন বুনতে হয়। সহজ কথাকে কঠিন করে প্রকাশ করবার দুর্লভ মেধা তাদের।
সুখের বিষয়, মরিস কর্নফোর্থ তার গ্রন্থ ‘বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে ভাববাদ’- এ এই আচ্ছাদনকে ছিন্নভিন্ন করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, অত দুরূহ জটিলতার পেছনে মোদ্দা কথাটুকু বার্কলিরই কথা। সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীদের তথাকথিত গাণিতিক নব্যন্যায়ের স্বরূপও তিনি উদঘাটন করেছেন।
আসলে সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীরা এই নব্যন্যায়-এর চারপাশে এমন দুৰ্বোধ্যতার আর জটিলতার আবহাওয়া সৃষ্টি করেছেন যে, সাধারণ পাঠক একে দূর থেকে সন্ত্রম করেন, কাছ-ঘোষবার সাহস বড় কারুর হয় না।
কর্নফোর্থ এর গ্রন্থ পড়ার পর বুঝতে পারা যায়, এ যেন এক অতি আধুনিক দিল্লির লাডু-শুধু যে না-খেলেই পস্তাতে হয় তাই নয়, খেতে গেলেও পস্তাতে হয়, কেননা খেতে গেলে শুধুই দাঁত ভাঙে, কিন্তু ভাববাদের চর্বিতচর্বণ ছাড়া নতুন কোনো আস্বাদ জোটে না।
তাই পূর্বপক্ষ এ কথা বলতে পারবেন না যে, একজাতীয় ভাববাদ খণ্ডন করে শঙ্করপ্রমুখ দার্শনিকেরা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র জাতের ভাববাদ প্রবর্তন করেন। আসলে বিভিন্ন ভাববাদের মধ্যে বর্ণভেদটুকু আপাতত যতই গুরুত্ব বলে মনে হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত তা নেহাতই অগভীর।
কর্নফোর্থ এর গ্রন্থ ছাড়াও এখানে শুধু একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদের গুরুদেব হলেন ইংরেজ দার্শনিক মূরি। “ভাববাদ খণ্ডন” নামে তাঁর ছোট প্রবন্ধ হালের য়ুরোপীয় দর্শনের ইতিহাসে নাকি যুগান্তর এনেছে। উত্তর-বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীরা সকলেই তার কাছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঋণী।
ভাববাদের বিরুদ্ধে গালিগালাজ করবার সময় মুর-এর কণ্ঠ সতেজ, যুক্তি যেন দুর্ধর্ষ। জ্ঞানের বিষয় জ্ঞাতার মনের ওপর নির্ভর করে, এ কথা বলা, মূর-এর মতে, নেহাতই নির্বোধের লক্ষণ। কিন্তু এ সমস্তই তো নেতিবাচক কথা। প্রশ্ন ওঠে, জ্ঞানের বিষয় তাহলে ঠিক কী রকম?
উত্তরে মূর ইন্দ্রিয়োপাত্ত (Sense-datum) নামের এক জাতীয় সত্তার আমদানি করলেন। এই ইন্দ্রিয়োপাত্ত হল দর্শনের জগতে অভিনব-তম আজব-চিড়িয়া, অভিজ্ঞতাবিচারবাদীর element-এর সাক্ষাৎ বংশধর। লেনিন দেখিয়েছিলেন, element জিনিসটা বার্কলির percipii ছাড়া আর কিছুই নয়।
মুর-এর ইন্দ্রিয়োপাত্তর বেলাতেও হুবহু একই কথা। এই ইন্দ্রিয়োপাত্তর স্বরূপ নির্ণয় করা নিয়ে যতই তিনি মাথা ঘামিয়েছেন, ততই তাঁকে বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদ ছেড়ে পেছু হটতে হয়েছে। বার্কলি-হিউমের ভাববাদের দিকে। মুর-এর দর্শনে এই যে বিপর্যয়, একে নিছক তাঁর ব্যক্তিগত খেয়ালখুশিও বলা চলে না।
সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্রাবাদীরা প্রায় প্রত্যেকেই এই দিক থেকেও গুরুদেব মূর-এর চরণচিহ্ন অনুধাবন করেন। জ্ঞানবিজ্ঞান (Epistemology) নিয়ে তাঁদের অন্য অজস্র বিতর্কের পেছনে তাই ভাববাদেরই বিচ্ছুরিত হাসি।
প্রাচীন মিশরে দেবতা আসিরিসের জীবন-মরণ-কাহিনী নিয়ে প্রতিবছর মরমী নাট্যের অভিনয় হতো। দেবতার পীড়ন, দেবতার মৃত্যু, তারপর আবার দেবতার পুনরুজ্জীবনের পর দেবতা দেখা দিতেন হয় তাঁর নিজের মূর্তিতেই, আর না হয় তো পুত্র হোরাস-এর মূর্তিতে।
কিন্তু মূর্তি যারই হোক, মূলে সেই দেবতাই, সেই অসিরিস। দর্শনের ইতিহাসেও যেন একই নাটকের অভিনয়। ভাববাদের পুনরুজ্জীবনও চিরকাল একই মূর্তিতে নয়, কিন্তু বিভিন্ন মূর্তির মধ্যে আপাত পার্থক্য যতই হোক না কেন, মূলে সেই পুরাতন ভাববাদই।
তাই পূর্বপক্ষ এ কথা বলতে পারবেন না যে, একজাতীয় ভাববাদ খণ্ডন করে শঙ্করপ্রমুখ দার্শনিকেরা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র জাতের ভাববাদ প্রবর্তন করেন। আসলে বিভিন্ন ভাববাদের মধ্যে বর্ণভেদটুকু আপাতত যতই গুরুত্ব বলে মনে হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত তা নেহাতই অগভীর।
একথা মূর এবং পেরীর মতো দার্শনিকদের দৃষ্টিও এড়ায়নি, যদিও তারা যে যুক্তি দিয়ে কথাটা প্রমাণ করবার চেষ্টা করেন, সে যুক্তি শেষ পর্যন্ত বিচারসহ নয়। ভাববাদের সামাজিক উৎস নিয়ে আলোচনা করবার সময় এ বিষয়ে দীর্ঘতর মন্তব্যের অবকাশ পাব।
(চলবে…)
…………………….
ভাববাদ খণ্ডন – মার্কসীয় দর্শনের পটভূমি : দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………………….
আরও পড়ুন-
ভাববাদ অনুসারে মানুষের মাথা নেই : এক
ভাববাদ অনুসারে মানুষের মাথা নেই : দুই
বুদ্ধি দিয়ে, তর্ক করে, ভাববাদকে খণ্ডন করা যায় না : প্রথম পর্ব
বুদ্ধি দিয়ে, তর্ক করে, ভাববাদকে খণ্ডন করা যায় না : দ্বিতীয় পর্ব
ভাববাদকে খণ্ডন করা যায়নি : পর্ব এক
ভাববাদকে খণ্ডন করা যায়নি : পর্ব দুই